৩৮তম অধ্যায়
অর্থাদি বিবিধ নীতি
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে বিদুর! বিধাতা পুরুষকে দৈবের বশীভূত করিয়াছেন; যেমন সূত্রগ্রথিত দারুময়ী যোষা আত্মবশ নহে, তদ্রূপ স্বীয় ঐশ্বৰ্য্য বা অনৈশ্বৰ্য্যে পুরুষের কিছুমাত্র ক্ষমতা নাই। অতএব তুমি পুনরায় এইসকল বিষয় কীর্ত্তন কর, আমি সাবধান হইয়া শ্রবণ করিতেছি।”
বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! যদি সুরগুরু বৃহস্পতি অনুপযুক্ত সময়ে বান্বিন্যাস করেন, তাহা হইলে তাঁহাকেও অবজ্ঞা ও অবমানের ভাজন হইতে হয়। কেহ কেহ দান করিয়া প্রিয় হয়, কেহ কেহ বা প্ৰিয়বাক্য প্রয়োগ করিয়া প্রিয় হয়; কিন্তু যে ব্যক্তি মন্ত্রণা ও ধনপ্রদানদ্বারা প্রিয় হয়, সেই যথার্থ প্রিয়। লোকে দ্বেষ্য ব্যক্তিকে সাধ, মেধাবী বা পণ্ডিত জ্ঞান করে না। ফলতঃ লোকের স্বভাবই এই যে, তাহারা প্রিয় ব্যক্তিকে সমস্ত শুভকাৰ্য্য ও দ্বেষ্য ব্যক্তিকে পাপকাৰ্য্যের আধার জ্ঞান করিয়া থাকে। হে রাজন! দুৰ্য্যোধন জন্মিবামাত্র আপনাকে কহিয়াছিলাম যে, মহারাজ! আপনি এই পুত্রকে পরিত্যাগ করুন, তাহা হইলে অন্যান্য পুত্ৰগণের অভ্যুদয় হইবে, নচেৎ আপনার শতপুত্ৰই বিনষ্ট হইবে, সন্দেহ নাই। হে ভারতবংশাবতংস! যে বুদ্ধিদ্বারা উত্তরকালে ক্ষয় হইবার সম্ভাবনা, তাহা বুদ্ধি বলিয়া জ্ঞান করা কর্ত্তব্য নহে; আর যে ক্ষয়দ্বারা চরমে বৃদ্ধিলাভ হয়, সে ক্ষয়কেও শ্রেয়স্কর জ্ঞান করা উচিত। কারণ, যে ক্ষয়দ্বারা বৃদ্ধি হয়, সে ক্ষয় নহে; কিন্তু যে অল্পলাভদ্বারা বহু বস্তু বিনষ্ট হয়, সেই লাভই ক্ষয়স্বরূপ। হে মহারাজ! কোনো কোনো ব্যক্তি ধনদ্বারা, কেহ কেহ বা গুণদ্বারা সমৃদ্ধ হইয়া থাকে; আমার মতে ধনাঢ্য গুণবিহীন ব্যক্তিগণকে পরিত্যাগ করা আপনার কর্ত্তব্য।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে বিদুর! তুমি যাহা কহিলে, তৎসমুদয়ই প্ৰজ্ঞসম্মত ও পরিণামে হিতকর; কিন্তু আমি পুত্ৰপরিত্যাগবিষয়ে প্রবৃত্ত হইতে সমর্থ নই। দেখ, যে স্থানে ধর্ম্ম, সেইস্থানেই জয় নিৰ্দ্ধারিত আছে।”
বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! প্রভূত গুণসম্পন্ন বিনয়ী ব্যক্তি প্রাণীগণের অতি অল্পমাত্র ক্লেশও সহ্য করিতে পারেন না। যাহারা সতত পরের অপবাদে নিরত থাকে, পরের দুঃখ ও পরস্পরের বিরোধের নিমিত্ত যত্নবান হয়, যাহাদের দৃষ্টি সদোষ ও সহবাস ভয়াবহ যাহাদের নিকট হইতে অর্থগ্রহণ করিলে মহৎ দোষ উৎপন্ন হয়, যাহাদিগকে ধন প্ৰদান করিলে মহাভয় জন্মে এবং যাহারা ভেদকারী, কামপরায়ণ, নির্লজ্জ, শঠ ও অন্যান্য মহাদোষে দূষিত, তাহারা পাপাত্মা বলিয়া বিখ্যাত; তাহাদের সহবাস কদাচ কর্ত্তব্য নহে, তাহাদিগকে পরিত্যাগ করাই শ্ৰেয়ঃ। নীচ লোকেরা কোন কারণবশতঃ প্ৰণয় করিয়া থাকে। সেই কারণ বিলীন হইলেই তাহারা প্রণয়ভঙ্গ করে, সৌহার্দ্যের ফল ও সৌহার্দ্যজনিত সুখেরও সম্পর্ক থাকে না। প্রত্যুত তাহারা অপবাদ প্ৰদান ও ক্ষয়বিষয়ে যথাসাধ্য যত্ন করে। অজ্ঞানবশতঃ উহাদের অণুমাত্র অপকার করিলেই উহারা আর শান্তিপথ অবলম্বন করে না। বিদ্বান ব্যক্তি নৈপুণ্যসহকারে বিবেচনা করিয়া দূর হইতে এতাদৃশ লোকের সংসৰ্গ পরিত্যাগ করিবেন।
জ্ঞাতির সহিত সদভাবে স্বার্থরক্ষা
“হে রাজন! যে ব্যক্তি দীন, দরিদ্র, আতুর ও জ্ঞাতির প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করে, তাহার পুত্র ও পশু বৃদ্ধি হয়; সে অনন্তকাল শ্ৰেয়োলাভ করে। আত্মশুভাকাঙক্ষী ব্যক্তিগণের জ্ঞাতি ও কুলবৰ্দ্ধন করা অবশ্য কর্ত্তব্য; অতএব আপনি সৎকর্ম্মানুষ্ঠানে যত্নবান হউন। জ্ঞাতিগণ সংক্রিয়া করিলে মহান শ্রেয়োলাভ হয়। হে রাজন! জ্ঞাতিগণ গুণহীন হইলে অতি যত্নসহকারে তাঁহাদিগকে রক্ষা করা কর্ত্তব্য। দেখুন, পাণ্ডবগণ অশেষগুণালঙ্কৃত ও আপনার প্রসাদাকাঙক্ষী; তাহাদিগের প্রতি প্ৰসন্ন হওয়া আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। আপনি অনুগ্রহ করিয়া পাণ্ডবগণকে কতিপয় গ্রাম প্ৰদান করুন, তাহা হইলে লোকমধ্যে যশোলাভ করিতে পরিবেন। হে মহাশয়! আপনি বৃদ্ধ হইয়াছেন, এক্ষণে পুত্ৰগণকে শাসন করা আপনার নিতান্ত কর্ত্তব্য। আমি সতত আপনাকে হিতোপদেশ প্রদান করিতেছি; আপনি আমাকে হিতৈষী বলিয়া জ্ঞান করিবেন। মঙ্গলাভিলাষী ব্যক্তিগণের জ্ঞাতিবর্গের সহিত বিবাদ করা সর্ব্বতোভাবে অকর্ত্তব্য, উহাদিগের সহিত একত্র মিলিত হইয়া সুখসম্ভোগ করা বিধেয়। জ্ঞাতিদিগের সহিত সতত ভোজন, মিষ্টালাপ ও প্রণয় করাই কর্ত্তব্য; বিরোধ করা কদাচি উচিত নহে। জ্ঞাতি সদ্যবৃত্ত হইলে বিপদ হইতে পরিত্রাণ করে আর দুৰ্বত্ত হইলে বিপদে নিমগ্ন করে। হে মহারাজ! আপনি পাণ্ডবগণের প্রতি সদ্ব্যবহার করিলে সেই সমুদয় বীরপুরুষ আপনার চতুর্দ্দিকে থাকিবে, তাহা হইলে শত্ৰুগণ কখনই আপনাকে পরাভব করিতে পরিবে না। যদি কোন ব্যক্তি সম্পত্তিশালী জ্ঞাতির আশ্রয়ে থাকিয়াও কষ্টভোগ করে, তাহা হইলে সেই সম্পন্ন ব্যক্তিকেই তন্নিবন্ধন পাপভাগী হইতে হয়। যাহা হউক, কিয়দ্দিবস পরে আপনাকে হয় পাণ্ডবগণ, না হয় স্বীয় পুত্ৰগণের নিধনবার্ত্তা শ্রবণে অনুতাপ করিতে হইবে, অতএব এক্ষণে উত্তমরূপ বিবেচনা করিয়া কাৰ্য্য করুন। মনুষ্যের জীবিতকালের নিশ্চয় নাই, অতএব যে কর্ম্ম করিলে পশ্চাৎ চিন্তাসাগরে প্রবেশপূর্ব্বক পরিতাপ করিতে হয়, সে কর্ম্ম না করাই কর্ত্তব্য।
“হে মহারাজ! নীতিশাস্ত্রকর্ত্তা শুক্রাচাৰ্য্য ব্যতীত আর সমুদয় লোকই নীতিবিগৰ্হিত কাৰ্য্য করিয়া থাকে, কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণ মোহবশতঃ অনুষ্ঠিত অনীতির আশুপ্রতিবিধান করেন। দুৰ্য্যোধন পূর্ব্বে পাণ্ডবগণের প্রতি যে পাপাচরণ করিয়াছে, আপনি এক্ষণে তাহার প্রতিবিধান করুন। আপনি পাণ্ডুনন্দনগণকে রাজ্য প্রদান করিলে পাপবিমুক্ত হইয়া ভূমণ্ডলে মনীষিগণের পরম পূজনীয় হইবেন। যে ব্যক্তি পণ্ডিতগণের হিতবাক্য বিশেষরূপে চিন্তা করিয়া কাৰ্য্যে অধ্যবসায় করে, তাহার যশোরাশি এই মেদিনীমণ্ডলে চিরকাল দেদীপ্যমান থাকে। সুকুশল ব্যক্তি অপাত্রে জ্ঞানোপদেশ প্রদান করিলে তাহাও বিফল হয়, কেন না, তাদৃশ ব্যক্তি প্রায়ই উপদেশ বুঝিতে পারে না, বুঝিতে পারিলেও তদনুসারে কাৰ্য্য করে না। যে ব্যক্তি পাপজনক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত না হয়, তাহার অভ্যুদয় হয়। যে দুর্ম্মতি পূর্ব্বকৃত পাপের প্রতিবিধান না করিয়া তাহার অনুসরণ করে, সে বিষম অগাধ নরকে নিপতিত হয়। চিত্তবৈক্লব্য, নিদ্রা, শক্রগণের গূঢ় চরকে না জানা, রাজার ভাবভঙ্গী, দুষ্ট অমাত্যে বিশ্বাস ও কাৰ্য্যক্ষণ দূত-এই ছয়টি মন্ত্রভেদের দ্বারস্বরূপ। অর্থবৰ্দ্ধনাভিলাষী প্ৰজ্ঞ ব্যক্তির এই সমুদয় বিশেষরূপে লক্ষ্য করা কর্ত্তব্য। যে ভূপতি বিলক্ষণরূপে অবগত হইয়া এই সকল পরিত্যাগপূর্ব্বক ধর্ম্মার্থকামাচরণে সতত নিযুক্ত থাকেন, তিনি অনায়াসে শত্ৰুগণকে পরাজয় করিতে পারেন। বৃহস্পতিসদৃশ ব্যক্তিগণও শাস্ত্ৰাধ্যয়ন ও বৃদ্ধগণের সেবা না করিয়া কখনই ধর্ম্মার্থের তত্ত্ব অবগত হইতে পারে না। দ্রব্য সমুদ্রে পতিত হইলে বিনষ্ট হয়, অশ্রোতার নিকট বাক্য প্রয়োগ করিলে তাহা বিনষ্ট হয়, মূঢ় ব্যক্তি বেদাধ্যয়ন করিলে তাহা বিনষ্ট হয় এবং অগ্নি ভিন্ন অন্য পদার্থে আহুতি প্ৰদান করিলে তাহা বিনষ্ট হয়। মেধাবী ব্যক্তি যুক্তিসহকারে প্রাজ্ঞগণের পরীক্ষা, বুদ্ধিপূর্ব্বক তাঁহাদের যোগ্যতানিশ্চয়, অন্যের নিকট তাঁহাদের বৃত্তান্ত শ্রবণ এবং আকার-ইঙ্গিতদ্বারা পুনঃ পুনঃ তাঁহাদের প্রাজ্ঞতা নির্দ্ধারিত করিয়া তাঁহাদিগের সহিত মিত্রতা করিবে। বিনয় অকীর্ত্তি বিনাশ করে, পরাক্রম অনৰ্থ বিনাশ করে, ক্ষমা ক্ৰোধ বিনাশ করে এবং আচার অলক্ষণ বিনাশ করে। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ভোগ্যবস্তু, জন্মস্থান, বাসস্থান, আচার ও গ্রাসাচ্ছাদন লক্ষ্য করিয়া লোকের কুল পরীক্ষা করিবেন।
“হে মহারাজ! কামপর ব্যক্তির কথা দূরে থাকুক, জীবন্মুক্ত মহাত্মারাও কাম উপস্থিত হইলে প্রতিনিবৃত্ত হয় না। রাজপ্রিয়, বিদ্বান, ধাৰ্মিক, প্রিয়দর্শন, মিত্ৰসম্পন্ন ও সুবক্তা সুহৃৎকে । প্রতিপালন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। অকুলীন ব্যক্তিও যদি মৃদু ও লজ্জাশীল হয় এবং মৰ্য্যাদা প্রতিপালন ও ধর্ম্মানুযায়ী কর্ম্ম সম্পাদন করে, তাহাকে শত কুলীন ব্যক্তি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা উচিত। যে দুর্জ্জনের চিত্তবৃত্তি, গূঢ়াচার ও প্রজ্ঞা সমান, তাহাদের উভয়ের মৈত্রী কদাচ বিনষ্ট হইবার নহে। দুর্বুদ্ধি অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি তৃণাচ্ছন্ন কূপের ন্যায়, তাহার সহিত সৌহৃদ্য কখনই চিরস্থায়ী হয় না, অতএব জ্ঞানবান ব্যক্তি এবংবিধ লোককে পরিত্যাগ করিবেন। পণ্ডিতগণ গর্ব্বিত, মূখ, কোপনস্বভাব, সাহসিক ও ধর্ম্মবিহীন ব্যক্তিদিগের সহিত কদাচ বন্ধুতা করিবেন না। যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞ, ধাৰ্মিক, সত্যাচার, উদারচিত্ত, অতিশয় ভক্তিপরায়ণ, জিতেন্দ্ৰিয়, মৰ্য্যাদাপালক এবং কদাপি স্বীয় পুত্ৰকে পরিত্যাগ করেন না, তাঁহার সহিতই বন্ধুতা করা কর্ত্তব্য। ইন্দ্ৰিয়গণকে বিষয় হইতে নিবৃত্ত করা নিতান্ত দুষ্কর; কিন্তু উহাদিগকে একান্ত বিষয়াসক্ত করিলে দেবগণকেও উৎসাদিত হইতে হয়। পণ্ডিতগণ মৃদুত্ব, অনসূয়া, ক্ষমা, ধৈৰ্য্য ও মিত্ৰগণের মাননা-এইসমুদয় আয়ুষ্কর বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন। অধ্যবসায় সহকারে অপনীত [বিনষ্ট] বিষয় প্রত্যুদ্ধার করিতে চেষ্টা করাই সৎপুরুষের ধর্ম্ম। যিনি ভবিষ্যৎ দুঃখের প্রতীকার করিতে পারেন, অধ্যবসায়সহকারে বর্ত্তমান দুঃখ সহ্য করেন এবং ‘ভোগ না করিলে দুঃখ বিনষ্ট হয় না’ এই বিবেচনা করিয়া অতীত দুঃখের নিমিত্ত অনুতাপ করেন না, কদাপি তাঁহার অর্থবিনাশ হয় না। কায়মনোবাক্যে সতত যে কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করা যায়, তাহাতেই একান্ত অনুরক্ত হইতে হয়, অতএব নিরন্তর মঙ্গলকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করাই কর্ত্তব্য। মাঙ্গলিক দ্রব্য-স্পর্শ, সহায়সম্পত্তি, অধ্যয়ন, উদ্যম, সরলতা এবং সতত সজনসন্দৰ্শন-এইসকল ঐশ্বৰ্য্যের নিদান। উদযোগপরায়ণতালাভ সম্পত্তি ও মঙ্গলের মূল; উদযোগী ব্যক্তি সর্ব্বপ্রধান হইয়া চিরকাল সুখ সম্ভোগ করেন। ক্ষমতাশালী ব্যক্তির পক্ষে সতত সকল বিষয়ে ক্ষমা-প্রদর্শন অপেক্ষা শ্রেয়স্কর ও হিতজনক কাৰ্য্য আর কিছুই নাই। অশক্ত ব্যক্তির সকলকেই ক্ষমা করা কর্ত্তব্য; শক্ত ব্যক্তির ধর্মোপার্জ্জনের নিমিত্ত ক্ষমা করা উচিত; আর যাহার বিপদ সম্পদ উভয়ই সমান, তাহার পক্ষে ক্ষমার তুল্য আর কিছুই নাই। যে সুখ-সম্ভোগদ্বারা ধর্ম্মার্থ বিনষ্ট না হয়, সেই সুখই ভোগ করিবে; মূঢ় ব্যক্তিরাই ভোজনাদি সুখে একান্ত অনুরক্ত হইয়া স্বীয় ধর্ম্মার্থের ব্যাঘাত করিয়া থাকে। দুঃখার্ত্ত, লিপ্সাহীন, নাস্তিক, অলস, আদান্ত [অসংযমী] ও উৎসাহবিবর্জিত ব্যক্তিগণের সম্পত্তি কদাপি স্থায়ী হয় না। দুর্ম্মতি ব্যক্তিগণ বিনয়নম্র ও বিনয়লজ্জিত মানবদিগকে অশক্ত জ্ঞান করিয়া সতত পরাভব করে। লক্ষ্মী অতিসরল, অতিদাতা, অতিশূর, অতিব্ৰতশীল ও প্রজ্ঞাভিমানী ব্যক্তির নিকট ভয়ে গমন করেন না এবং অতি গুণবান ও নিতান্ত নিগুৰ্ণ-এই উভয়কেই পরিত্যাগ করেন। ইনি সগুণ বা নিগুণের বশীভূত নহেন, উন্মত্তা ধেনুর ন্যায় একস্থানে বহুকাল বাস করিতে পারেন না।
“হে মহারাজ! বেদের ফল অগ্নিহোত্ৰ, অধ্যয়নের ফল সৎস্বভাব ও সদাচরণ, নারীর ফল রতি ও পুত্র এবং ধনের ফল দান ও ভোজন। যে ব্যক্তি অধর্মোপার্জিত অর্থদ্বারা পরলোকহিতকর যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করে, তাহার পরলোকে স্বাভিলষিত ফললাভ হয় না। সত্ত্বশালী ব্যক্তিগণ কি কান্তার, কি বনদুর্গ কি আপদজনক স্থান, কি উদ্যত শস্ত্ৰ, কিছুতেই ভীত হয়েন না। উদ্যম, সংযম, দক্ষতা, অপ্ৰমাদ, ধৈৰ্য্য, স্মৃতি ও সমীক্ষ্যকারিতা [সকল দিকে সম্যকপ্রকারে দৃষ্টি রাখিয়া করা]—এইসমুদয় ঐশ্বৰ্য্যের মূলীভূত। তপস্যা তাপসাগণের বল, ব্ৰহ্ম ব্ৰহ্মজ্ঞদিগের বল, হিংসা অসাধুগণের বল ও ক্ষমা গুণবানদিগের বল। জল, মূল, ফল, দুগ্ধ, ঘৃত, ঔষধ এবং ব্রাহ্মণ ও গুরুর আজ্ঞা-এই আটটি ব্ৰতবিনাশী নহে। যাহা করিলে আপনার অনিষ্ট হয়, তাহা অন্যের প্রতিও করিবে না। উক্ত ধর্ম্ম সম্যক জ্ঞানদ্বারা ও অন্য ধর্ম্ম কামনাদ্বারা উৎপন্ন হইয়া থাকে। আক্ৰোধদ্বারা ক্ৰোধ পরাজয় করিবে, সৎকর্ম্মদ্বারা অসৎকর্ম্ম পরাজয় করিবে, দানদ্বারা কদৰ্য্য কাৰ্য্য পরাজয় করিবে এবং সত্যদ্বারা মিথ্যা পরাজয় করিবে। স্ত্রী, ধূর্ত্ত, অলস, ভীরু, ক্রুদ্ধ, পুরুষাভিমাননী, চৌর, কৃতঘ্ন ও নাস্তিক—এই সমুদয় লোককে বিশ্বাস করিবে না। অভিবাদনশালী বৃদ্ধোপসেব ব্যক্তির কীর্ত্তি, আয়ু, যশ ও বল বৃদ্ধি হয়। যে অর্থ উপার্জ্জন করিবার নিমিত্ত সাতিশয় ক্লেশভোগ, ধর্ম্ম অতিক্রম বা শত্রুকে প্ৰণিপাত করিতে হয়, তাদৃশ অর্থোপার্জ্জনের কদাচ মনোনিবেশ করিবে না। বিদ্যাশূন্য পুরুষ, ভূপতিশূন্য রাজ্য, প্রজাশূন্য মৈথুন এবং আহারশূন্য প্রজা— ইহাদিগের নিমিত্ত সতত শোক করিতে হয়। পথ দেহিগণের, জল পর্ব্বতের, অসম্ভোগ স্ত্রীদিগের এবং দুর্ব্বাক্য মনের জরাস্বরূপ। বেদের মল অনভ্যাস, ব্রাহ্মণের মল অব্রত, পৃথিবীর মল বাহ্লীক [বহু নদনদীর সঙ্গমস্থল] দেশসকল, পুরুষের মল অমৃত, পতিব্ৰতার মল কৌতুহল, স্ত্রীলোকের মল প্রবাস [স্বগৃহ ভিন্ন অন্যত্র বাস], সুবর্ণের মল রৌপ্য, রৌপ্যের মল রঙ্গ, রঙ্গের মল সীস ও সীসের মল মল মাত্র, তাহাতে আর কিছুই নাই। কেহই শয়নদ্বারা নিদ্রা, কাষ্ঠীদ্বারা অগ্নি, পানদ্বারা সুরা ও কামদ্বারা স্ত্রীদিগকে পরাজয় করিতে পারে না। যিনি দানদ্বারা মিত্র, যুদ্ধে শত্ৰুগণ ও অন্নপান প্ৰদান করিয়া জায়াকে পরাজয় করিতে পারেন, তাহারই জন্ম সার্থক।
“হে মহারাজ! যিনি সহস্র মুদ্রার অধীশ্বর, তিনিও স্বীয় জীবিকানির্ব্বাহ করেন, আর যিনি শত মুদ্রার অধীশ্বর, তিনিও স্বীয় জীবিকানির্ব্বাহ করেন; ফলতঃ এই ভূমণ্ডলে আপনার জীবিকানির্ব্বাহ করিতে না পারে, এমন কেহই নাই। অতএব আপনি দুরাশা পরিত্যাগ করুন। যদি এক ব্যক্তি এই পৃথিবীস্থ সমুদয় ধান্য, যব, হিরণ্য, পশু ও স্ত্রী প্রাপ্ত হয়, তথাপি তাহার তৃপ্তিলাভ হয় না, সাধুগণ ইহা বিবেচনা করিয়াই মোহগর্তে নিপতিত হয়েন না। হে রাজন! যদি আপনি স্বীয় পুত্র ও পাণ্ডুপুত্ৰগণকে তুল্যজ্ঞান করেন, তবে উভয় পক্ষের প্রতি সমান ব্যবহার করুন।”