৩৭তম অধ্যায়
ত্রয়োদশ অধ্যায় – ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞযোগ
“অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! আমি প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয়, এই কয়েকটি বিষয় শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! এই শরীরই ক্ষেত্র বলিয়া অভিহিত হয়; যিনি ইহা বিদিত হইয়াছেন, তিনি ক্ষেত্রজ্ঞ; আমি সকল ক্ষেত্রেরই ক্ষেত্রজ্ঞ; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যে বৈলক্ষণ্য-জ্ঞান [বিশেষ ধারণা], তাহাই আমার অভিপ্রেত যথার্থ জ্ঞান। এক্ষণে ক্ষেত্র যে প্রকার ধর্ম্মবিশিষ্ট, যে সমস্ত ইন্দ্রিয়বিকারযুক্ত, যেরূপে প্রকৃতি-পুরুষের সংযোগে উদ্ভূত হয়, যেরূপে স্থাবরজঙ্গমাদিভেদ বিভিন্ন হয়, স্বরূপতঃ যেরূপ এবং যে প্রকার প্রভাবসম্পন্ন, তাহা সংক্ষেপে কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষিগণ হেতুবিশিষ্ট নির্ণীতার্থ [যাহার অর্থ নির্ণীত হইয়াছে] বহুবিধ বেদ, তটস্থলক্ষণ [কল্পিত নিদর্শনে প্রকৃত নির্ণয়] ও স্বরূপলক্ষণ [সহজ পরিচয়] দ্বারা উহা নিরূপিত করিয়াছেন। পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি, মূল প্রকৃতি, একাদশ ইন্দ্রিয়, পাঁচ ইন্দ্রিয়বিষয়, ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, শরীর, জ্ঞানাত্নিকা মনোবৃত্তি ও ধৈর্য্য–এই কয়েকটি ক্ষেত্রধর্ম্ম। হে অর্জ্জুন! উক্ত ধর্ম্মবিশিষ্ট ইন্দ্রিয়াদি বিকারশালী ক্ষেত্র সংক্ষেপে কীর্ত্তন করিলাম। অমানিতা, অদাম্ভিকতা, অহিংসা, ক্ষমা, আর্জ্জব, আচার্য্যোপাসনা, শৌচ, স্থৈর্য্য, আত্মসংযম, বিষয়বৈরাগ্য, নিরহঙ্কারিতা এবং জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, দুঃখ ও দোষের বারংবার সমালোচনা, প্রীতিত্যাগ এবং পুত্র, কলত্র ও গৃহাদির প্রতি অনাসক্ত এবং ইষ্ট ও অনিষ্টাপাতে সমচিত্ততা, আমার প্রতি অব্যভিচারিণী [অনন্যা], ভক্তি, নির্জ্জনে অবস্থান, জনসমাজে বিরাগ, আত্মজ্ঞানপরায়ণতা এবং তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শন [যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানে দৃষ্টি], ইহাই জ্ঞান; ইহার বিপরীত অজ্ঞান।
“এক্ষণে জ্ঞেয় বিষয় কীর্ত্তন করি, শ্রবণ কর। উহা বিদিত হইলে লোকে মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। অনাদি ও নির্বিশেষস্বরূপ ব্রহ্মই জ্ঞেয়; তিনি সৎও নহেন, অসৎও নহেন; সর্ব্বত্রই তাহার কর, চরণ, কর্ণ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ বিরাজিত আছে। তিনি সকলকে আবৃত করিয়া [সমস্ত ব্যাপিয়া] অবস্থান করিতেছেন। তিনি ইন্দ্রিয়বিহীন, কিন্তু সমস্ত ইন্দ্রিয় ও রূপ, রস প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের গুণ সকল প্রকাশ করেন; তিনি আসক্তিশূন্য ও সকল বস্তুর আধার; তিনি নির্গুণ, কিন্তু সর্ব্বগুণপালক [সকল গুণের পোষক]; তিনি চরাচর এবং সকল ভূতের অন্তরে ও বহির্ভাগে অবস্থান করিতেছেন। তিনি অতি সূক্ষ্মত্ব প্রযুক্ত অবিজ্ঞেয়; তিনি অতি সন্নিকৃষ্ট ও দূরবর্ত্তী; তিনি ভূতমধ্যে অবিভক্ত থাকিয়া বিভক্তের ন্যায় অবস্থান করিতেছেন। তিনি ভূতদিগের ভর্ত্তা [প্রভু–পালক], তিনি প্রলয়কালে সমুদয় গ্রাস করেন, সৃষ্টিকালে নানা রূপ পরিগ্রহ করিয়া উৎপন্ন হইয়া থাকেন। তিনি জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর জ্যোতি ও অন্ধকারের অতীত; তিনি জ্ঞান, তিনি জ্ঞেয়, তিনি জ্ঞানপ্রাপ্য। তিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থান করিতেছেন। হে অর্জ্জুন! আমি তোমার নিকট ক্ষেত্র, জ্ঞান ও জ্ঞেয়, এই তিনটি সংক্ষেপে কীর্ত্তন করিলাম। আমার ভক্তগণ ইহা অবগত হইয়া আমার ভাব হৃদয়ে বদ্ধমূল করিতে সমর্থ হয়।
“প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ই অনাদি; দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি বিকার এবং সুখ-দুঃখাদি গুণ-সমুদয় প্রকৃতি হইতে সমুদ্ভূত হইয়াছে। শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের কর্ত্তৃত্ব-বিষয়ে প্রকৃতি এবং সুখ-দুঃখ-ভোগ -বিষয়ে পুরুষই কারণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছেন। পুরুষ দেহে অধিষ্ঠান করিয়া তজ্জনিত সুখ-দুঃখ ভোগ করেন। ইন্দ্রিয়গণের সহিত তাঁহার সম্পর্কই সৎ ও অসৎ যোনিতে জন্মগ্রহণের একমাত্র কারণ তিনি এই দেহে বর্ত্তমান থাকিয়াও দেহ হইতে ভিন্ন; কারণ, তিনি সাক্ষিস্বরূপ, অনুগ্রাহক, বিধানকর্ত্তা, প্রতিপালক, মহেশ্বর ও অন্তর্যামী। যে ব্যক্তি এইরূপে পুরুষ ও সমগ্র গুণের সহিত প্রকৃতিকে অবগত হয়েন, তিনি শাস্ত্রসম্মত পথ [বিধিনিষেধ] অতিক্রম করিলেও মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন। কেহ কেহ ধ্যান ও মন দ্বারা দেহমধ্যে আত্মাকে সন্দর্শন করে; কেহ কেহ বা প্রকৃতি-পুরুষের বৈলক্ষণ্যরূপ যোগ দ্বারা, কেহ কেহ বা কর্ম্মযোগ দ্বারা তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ; কেহ কেহ বা আত্মাকে বিদিত না হইয়া অন্যের নিকট উপাসনায় প্রবৃত্ত হয়, সেই সমস্ত শ্রুতিপরায়ণ ব্যক্তিরা মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া থাকে। হে অর্জ্জুন! ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগে স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থই উৎপন্ন হয়; সেই সমস্ত পদার্থ বিনাশ প্রাপ্ত হইলেও ঈশ্বর কদাচ বিনষ্ট হয়েন না; তিনি সকল ভূতে নির্বিশেষরূপে [তুল্যভাবে] অবস্থান করিতেছেন। যিনি পরমেশ্বরকে ঐরূপ দেখেন, তিনি যথার্থই দেখিয়া থাকেন। লোক-সকল সর্ব্বভূতে সমভাবে অবস্থিত ঈশ্বরকে নিরীক্ষণ করিলে অবিদ্যা দ্বারা আত্মাকে বিনষ্ট করে না; এই নিমিত্ত মোক্ষপদ প্রাপ্ত হয়। প্রকৃতি সর্ব্বপ্রকার কর্ম্মসম্পাদন করেন, কিন্তু আত্মা স্বয়ং কোন কর্ম্ম করেন না; যিনি ইহা সন্দর্শন করিয়াছেন, তিনি সম্যগ্দর্শী। যখন লোকে একমাত্র প্রকৃতিতে অবস্থিত ভূতসকলের ভিন্ন ভাব প্রত্যক্ষ করে, তখন সেই প্রকৃতি হইতেই পূর্ণব্রহ্ম প্রাপ্ত হইয়া থাকে। এই অব্যয় পরমাত্মা দেহে অবস্থান করিলেও অনাদিত্ব নির্গুণত্বপ্রযুক্ত কোন ধর্ম্মানুষ্ঠান করেন না এবং কোন প্রকার কর্ম্মফল দ্বারাও কদাচ লিপ্ত হয়েন না। যেমন আকাশ সকল পদার্থে অবস্থান করিলেও কোন পদার্থ দ্বারা উপলিপ্ত হয় না, তদ্রূপ আত্মা সকল দেহে অবস্থান করিলেও দৈহিক গুণ-দোষ দ্বারা কখনই লিপ্ত হয়েন না। হে অর্জ্জুন! যেমন সূর্য একমাত্র হইলেও সমস্ত বিশ্বকে সুপ্রকাশিত করেন, তদ্রূপ একমাত্র আত্মা সমস্ত দেহ প্রকাশিত করিয়া থাকেন। যাহারা জ্ঞানচক্ষু দ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের অন্তর [প্রভেদ] এবং ভৌতিক প্রকৃতি হইতে মোক্ষোপায় বিদিত হয়েন, তাঁহারা পরমপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।’ “