৩৬তম অধ্যায়
ভীমের প্রতি কালজ্ঞ যুধিষ্ঠিরের সান্ত্বনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, রাজা যুধিষ্ঠির ভীমবাক্য শ্রবণ করিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক মনে মনে চিন্তা করিলেন, “আমি রাজধর্ম্ম ও বর্ণবিনিশ্চয়ে শ্রবণ করিয়াছি, যে ব্যক্তি উত্তর ও বর্ত্তমান কাল সম্যক পৰ্য্যালোচনা করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ তত্ত্বদর্শী। আমি ধর্ম্মের অতি সূক্ষ্ম দুর্ব্বিগাহ গতি জানিয়া বলপূর্ব্বক কিরূপে তদ্বিরুদ্ধাচরণে প্ৰবৃত্ত হইব?”
তিনি মুহুর্ত্তকাল এইরূপ
মহাবাহো! তুমি যাহা কহিতেছ, তাহা যথার্থ বটে; কিন্তু আমি আর একটি কথা বলি, অবহিত হইয়া শ্রবণ করা। হে ভারত! যে সকল কার্য্য কেবল সাহসপূর্ব্বক অনুষ্ঠিত হয়, তাহা সমুদয়ই মহাপাপে পরিপূর্ণ; সুতরাং তদ্দ্বারা অন্তরাত্মা যৎপরোনাস্তি ব্যথিত হয়েন। আর উত্তম মন্ত্রণাপূর্ব্বক পূর্ব্বাপর পৰ্য্যালোচনা করিয়া পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে অনায়াসেই অর্থ-সিদ্ধি হয় এবং দৈবও তদ্বিষয়ে আনুকূল্য প্রদর্শন করেন। তুমি বলদর্পিত হইয়া চপলতাপ্রযুক্ত যে অসমসাহসিক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইবার মানস করিতেছ, তাহাতে আমার যে কিছু বক্তব্য আছে, শ্রবণ করা।
“ভূরিশ্রবাঃ, শল্য, জলসন্ধ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৰ্ণ, মহাবল দ্রোণাত্মজ এবং দুৰ্য্যোধনপ্রমুখ অতি দুরাধর্ষ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ সকলেই অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ এবং সতত আততায়ী [গৃহে অগ্নিদানকারী বিষদাতা, নির্ব্বিচারে অস্ত্ৰক্ষেপকারী, সর্ব্বাধনহারী, পরক্ষেত্রগ্রাহী ও পরিনারীহারী]। যে-সকল রাজগণকে আমরা উৎপীড়িত করিয়াছি, এক্ষণে তাহারা জাতস্নেহ হইয়া কৌরবপক্ষ আশ্রয় করিয়াছে ও দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক পূর্ণকোষ ও সৈন্যসমেত হইয়া নিরন্তর তদীয় হিতসাধনে তৎপর রহিয়াছে, অতএব তাহারা রণস্থলে কোনক্রমেই আমাদিগের সহায়তা করিবে না। কৌরবেরা আপন সৈনিকদিগের পুত্র ও অমাত্য প্রভৃতি সকলকেই উত্তমরূপ পরিচ্ছদ এবং ভোগসুখে সন্তুষ্ট রাখিয়াছে। দুৰ্য্যোধন বীরপুরুষদিগের প্রতি যেরূপ সম্মান প্ৰদৰ্শন করে, তাহাতে আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে, তাঁহারা কৌর্যবহিতার্থে সংগ্রামস্থলে দুস্ত্যাজ্য প্ৰাণ পরিত্যাগ করিতেও পরাঙ্মুখ হইবেন না। ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপাচাৰ্য্যের স্নেহ উভয় পক্ষে সমান হইলেও রাজপ্রদত্ত গ্রাসাচ্ছাদনরূপ ঋণ পরিশোধ করিবার নিমিত্ত তাঁহারা প্ৰাণপণে যুদ্ধ করিবেন, সন্দেহ নাই। তাহারা সকলেই ধৈৰ্য্যপরায়ণ, দিব্যাস্ত্রবেত্তা ও বাসব্যসহ দেবগণেরও অজেয়। অস্ত্ৰবিশারদ মহারথ কর্ণ সর্ব্বদাই অমর্ষ-প্ৰদীপ্ত ও অভেদ্য কবচে তদীয় শরীর আবৃত হইয়া রহিয়াছে; তাহার সম্মুখীন হওয়া অতি দুরূহ ব্যাপার। তুমি সহায়বিহীন ও বলহীন হইয়া এই সকল দুৰ্য্যোধননিধনে কোনক্রমেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পরিবে না। হে বৃকোদর! অধিক কি বলিব, সকল ধনুৰ্দ্ধরাগ্রণী কর্ণের অলোকসামান্য রণনৈপুণ্য চিন্তা করিয়া এককালে আমার নিদ্রা উচ্ছিন্নপুরী হইয়া গিয়াছে।”
যুধিষ্ঠির-সমীপে ব্যাসের আগমন—প্রতিস্মৃতিনামী রহস্যবিদ্যা দীক্ষা
ক্ৰোধপরীতচেতাঃ ভীমসেন জ্যেষ্ঠের ঐ সকল বচন শ্রবণ করিয়া ত্ৰস্ত ও বিমনাঃ হইয়া তূষ্ণীম্ভাবে রহিলেন। পাণ্ডবদ্বয় এই সকল কথাপ্রসঙ্গে ব্যাপৃত রহিয়াছেন, ইত্যবসরে মহাযোগী ব্যাসদেব তথায় উপনীত হইলেন। মহর্ষি দ্বৈপায়ন পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক যথাযোগ্য পূজিত হইয়া যুধিষ্ঠিরের নিকট অভিগমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে নরর্ষভ! আমি স্বীয় শনীষাপ্রভাবে তোমার অন্তঃকরণের ভাব বুঝিতে পারিয়া শীঘ্ৰ সমাগত হইয়াছি। তুমি যে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কৰ্ণ, দ্রোণপুত্ৰ, দুৰ্য্যোধন ও দুঃশাসন হইতে ভয়াশঙ্কা করিয়াছ, আমি বিধিবোধিত কর্ম্মদ্বারা তাহার নিরাকরণ করিব। হে রাজেন্দ্র! যদ্দ্বারা উক্ত ভয় বিনাশিত হইতে পারে, তাহা শ্রবণ করিয়া সেই কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান কর, আর চিন্তার প্রয়োজন নাই।”
অনন্তর বাক্যবিশারদ ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে একান্তে লইয়া যুক্তিযুক্ত বাক্যে কহিতে লাগিলেন, “হে ভারতসত্তম! আমি তোমাকে মূর্ত্তিমতী সিদ্ধিস্বরূপ প্রতিস্মৃতিনামী বিদ্যা প্রদান করিতেছি, তুমি ইহা গ্রহণ কর। পরে মহাবাহু অর্জ্জুন এই বিদ্যা পাইয়া অস্ত্ৰহেতু সাধনা করিলে মহাদেব ও মহেন্দ্রের অনুগ্রহলাভ করিতে পরিবে। অর্জ্জুন তপস্যা ও বিক্রমপ্রভাবে বরুণ, কুবের ও ধর্ম্মরাজ প্রভৃতি সুরগণের সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হইবে। সে সামান্য মনুষ্য নহে, চিরন্তন মহাতেজঃ ঋষি; ভগবান নারায়ণ ইহার সহায়, ইহাকে কেহই জয় করিতে পরিবে না। এই অর্জ্জুন ইন্দ্র, রুদ্র ও লোকপালগণের নিকট হইতে অস্ত্ৰপ্ৰাপ্ত হইয়া মহৎকাৰ্য্য-সকল সম্পন্ন করিবে। হে কৌন্তেয়! এক্ষণে তুমি আপনাদিগের বাসোপযোগী অন্য এক বন অন্বেষণ কর। কারণ, একস্থানে চিরবাস প্রীতিকর হয় না। তুমি বেদবেদাঙ্গপারগ। অনেকানেক ব্ৰাহ্মণগণের ভরণপোষণ করিতেছ। তাহাতে তপস্বীদিগের উদ্বেগ জন্মে, লতা ও ওষধি-সকল বিনষ্ট হইতে থাকে এবং অনন্যগতি মৃগগণের জীবিকানির্ব্বাহ সুকঠিন হইয়া উঠে।”
পাণ্ডবগণের ব্যাসানুমোদিত কাম্যাকবনে গমন
লোকতত্ত্বজ্ঞ ভগবান ব্যাস প্রসন্ন্যহৃদয় ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে এইরূপে অনুত্তম বিদ্যা প্ৰদান করিয়া তাহার নিকট বিদায়। গ্রহণপূর্ব্বক সেই স্থানেই অন্তহিত হইলেন। মেধাবী যুধিষ্ঠিরও সংযতচিত্তে ঋষিদত্ত সেই মত্ত ধারণ করিলেন এবং নিবিষ্টমনাঃ হইয়া সময়ে সময়ে সেই বিদ্যা অভ্যাস করিতে লাগিলেন। তিনি ব্যাসবাক্যে মুদিত হইয়া দ্বৈতবান হইতে সরস্বতী নদীর উপকূলসন্নিহিত কাম্যাকবনে যাত্ৰা করিলেন। বেদবেদাঙ্গবিশারদ তাপস ও ব্রাহ্মণগণ তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। অনন্তর মহাত্মা পাণ্ডবেরা কাম্যাকবনে উত্তীর্ণ হইয়া অমাত্য ও ভৃত্যসমভিব্যাহারে বাস করিতে লাগিলেন। সেই ধনুর্ব্বেদপারগ বীরপুরুষেরা প্রতিদিন বেদশ্রবণ, মৃগার্থী হইয়া বিশুদ্ধ শর-শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক মৃগয়া-বিচরণ এবং পিতৃলোক ও দেবলোকদিগের যথাবিধি তৰ্পণ করিয়া সেই কাম্যাকবনে কিয়ৎকাল অতিবাহিত করিলেন।