৩৫তম অধ্যায়
দ্রোণাক্রমণে ভীমসেনাদির অকৃতকার্য্যতা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে নরনাথ! অনন্তর ভীমসেনপ্রমুখ পাণ্ডবগণ, সাত্যকি, চেকিতন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, কুন্তিভোজ, দ্রুপদ, অভিমন্যু, শিখণ্ডী, উত্তমৌজা, বিরাট, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, শিশুপাল নন্দন, ক্ষত্ৰধৰ্ম্মা, বৃহৎক্ষত্র, চেদিপতি, ধৃষ্টকেতু, নকুল, সহদেব, ঘটোৎকচ ও যুধামন্যু, মহাবীর্য্য কৈকেয়গণ, শত সহস্র সৃঞ্জয় এবং অন্যান্য যুদ্ধৰ্ম্মদ সানুচর বীরবর্গ যুদ্ধার্থী হইয়া সহসা দ্রোণের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবল পরাক্রান্ত দ্রোণ অসম্ভ্রান্ত চিত্তে সন্নিহিত বীরগণকে শরবর্ষণ পূর্ব্বক নিবারণ করিলেন। যেমন প্রবল জলপ্রবাহ দুর্ভেদ্য পর্ব্বতকে অতিক্ৰম করিতে সমর্থ হয় না, যেমন সাগর সকল বেলাভূমি অতিক্রম করিতে পারে না, তদ্রূপ পাণ্ডবপক্ষ বীরগণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে উল্লঙ্ঘন করিতে পারিলেন না। ফলত পাণ্ডবেরা সৃঞ্জয়গণের সহিত দ্রোণচাপ-বিনিঃসৃত শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া দ্রোণাচার্যের সম্মুখে অবস্থান করিতে অসমর্থ হইলেন। আমরা তখন দ্রোণের অদ্ভুত ভুজবল অবলোকন করিতে লাগিলাম।
চক্রব্যূহ ভেদার্থ যুধিষ্ঠিরের নির্দেশ
অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির ক্রোধভরে দ্রোণকে আগমন করিতে অবলোকন করিয়া নানা প্রকার নিবারণোপায় চিন্তা করিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি দ্রোণকে নিবারণ করা অন্যের অসাধ্য বিবেচনা করত অর্জ্জুন ও বাসুদেবসম অমিততেজাঃ অভিমন্যুর উপর দুর্ব্বহ ভার সমর্পণ করিয়া কহিলেন, হে বৎস! আমরা কিরূপে চক্রব্যূহ ভেদ করিব, কিছুই হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইতেছি না; এক্ষণে অর্জ্জুন আসিয়া যাহাতে আমাদিগকে নিন্দা না করে, তুমি এইরূপ অনুষ্ঠান কর। তুমি, অর্জ্জুন, কৃষ্ণ ও প্রদ্যুম্ন তোমরা চারি জনই চক্রব্যূহ ভেদ করিতে সমর্থ, এ বিষয়ে পঞ্চম ব্যক্তি আর নয়নগোচর হইতেছে না। এক্ষণে পিতৃগণ, মাতুলগণ, সৈন্যগণ তোমার নিকট বর প্রার্থনা করিতেছেন, তুমি ইহাদিগকে বর প্রদান কর। তুমি অবিলম্বে অস্ত্র গ্রহণ পূর্ব্বক দ্রোণসৈন্য বিনষ্ট করিতে প্রবৃত্ত হও; নতুবা ধনঞ্জয় উপস্থিত হইয়া আমাদিগকে নিশ্চয়ই নিন্দা করিবে।
যুদ্ধার্থ দ্রোণানুসরণে অভিমন্যুর আগ্রহ
অভিমন্যু কহিলেন, আর্য্য! আমি পিতৃগণের জয়লাভার্থী হইয়া অবিলম্বে দ্রোণাচার্যের সুদৃঢ় ভয়ঙ্কর সৈন্যসাগরে অবগাহন করিব। আপনি আমাকে দ্রোণ সৈন্য বিনাশে আদেশ করিলেন; কিন্তু আমি কোন বিপদাবহ কার্যে অগ্রসর হইতে উৎসাহ করি না। রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন, বৎস! তুমি সৈন্য ভেদ করিয়া আমাদিগের প্রবেশ দ্বার প্রস্তুত কর; তুমি তথায় গমন করিলে আমরা তোমার অনুগমন করিব। তুমি যুদ্ধে অর্জ্জুনতুল্য, তোমাকে সমরে প্রেরণ করিয়া আমরা চতুর্দ্দিক্ রক্ষা করত তোমারই অনুগমন করিব। ভীম কহিলেন, বৎস! তুমি এক বার যে ব্যূহ ভেদ করিবে, আমরা তথায় সমুপস্থিত হইয়া বারংবার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বীরদিগকে বিনষ্ট করিব।
অভিমন্যু কহিলেন, আৰ্য্য! যেমন পতঙ্গ ক্রুদ্ধ হইয়া প্রজ্বলিত হুতাশনে প্রবেশ করে, তদ্রূপ আমি নিতান্ত দুরধিগম্য দ্রোণসৈন্য মধ্যে প্রবেশ করিব। আজি আমি মাতৃ-পিতৃ-কুলের হিতকর কাৰ্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইব; মাতুল ও পিতার প্রিয়কার্য্য অবশ্যই সংসাধন করিব। এক্ষণে সমস্ত প্রাণী এক মাত্র শিশুর হস্তে শত্রু সৈন্য সকল বিনষ্ট হইতে নিরীক্ষণ করিবেন। যদি কেহ আজি আমার হস্তে প্রাণ পরিত্যাগ না করে, তাহা হইলে আমি সুভদ্রার গর্ভসম্ভূত ও অর্জ্জুনের ঔরসে সঞ্জাত নই। যদি আমি একমাত্র রথে আরোহণ করিয়া সমস্ত ক্ষত্রিয় মণ্ডলকে অষ্টধা খণ্ড খণ্ড করিতে না পারি, তাহা হইলে আমি আর আপনাকে অর্জ্জুনের আত্মজ বলিয়া স্বীকার করিব না।
রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন, বৎস! তুমি আজি সাধ্য, রুদ্র ও দেবকল্প, মহাবল পরাক্রান্ত, বস, হুতাশন ও আদিত্য সম বিক্রমশালী, মহাবীরগণকর্ত্তৃক রক্ষিত নিতান্ত দুরধিগম্য দ্রোণসৈন্য বিনাশ করিতে উৎসাহিত হইয়াছি; অতএব তোমার বল বর্দ্ধিত হউক। মহাবীর অভিমন্যু রাজা যুধিষ্ঠিরের এই রূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া সারথিকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন, হে সুমিত্র! তুমি অবিলম্বে দ্রোণ সৈন্যাভিমুখে অশ্ব চালন কর।