২য় অধ্যায় – শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকায় গমন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, ভগবান বাসুদেব পরামপ্রীত পাণ্ডবগণ কর্তৃক অভিপূজিত হইয়া কিয়দ্দিন খাণ্ডবপ্রন্থে বাস করিলেন। পরিশেষে পিতৃদর্শনে সাতিশয় উৎসুক হইয়া স্বভবনে গমন করিতে নিতান্ত অভিলাষী হইলেন। তিনি প্রথমতঃ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্ৰণ করিয়া পশ্চাৎ স্বীয় পিতৃম্বসা কুন্তী দেবীর চরণবন্দন করিলেন। ভোজরাজদুহিতা তাহার মস্তকাঘ্রাণপূর্ব্বক তাহাকে আলিঙ্গন করিলেন। তখন বাসুদেব-সাক্ষাৎকরণমানসে স্বীয় ভগিনী সুভদ্রার সমীপে উপস্থিত হইয়া অর্থযুক্ত, যথার্থ হিতকর, অল্পাক্ষর ও অখণ্ডনীয় বাক্যে তাঁহাকে নানাপ্রকারে বুঝাইলেন; ভদ্রভাষিণী [মঙ্গলকর বাক্যালাপকারিণী] সুভদ্ৰাও তাঁহাকে জননী প্রভৃতি স্বজনসমীপে বিজ্ঞাপনীয় বাক্য-সমুদয় কহিয়া দিয়া বারংবার পূজা ও অভিবাদন করিলেন। বৃষ্ণিবংশাবতংস তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া দ্রৌপদী ও ধৌম্যের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; ধৌম্যকে যথাবিধি বন্দন এবং দ্রৌপদীকে সম্ভাষণ ও আমন্ত্ৰণ করিয়া অর্জ্জুন সমভিব্যাহারে তথা হইতে যুধিষ্ঠিরাদি ভ্ৰাতৃচতুষ্টয়ের নিকট উপস্থিত হইলেন। তথায় ভগবান বাসুদেব পঞ্চপাণ্ডব কর্তৃক বেষ্টিত হইয়া অমরগণপরিবৃত মহেন্দ্রের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।
তৎপরে কৃষ্ণ যাত্রাকালোচিত কাৰ্য্য করিবার মানসে স্নানান্তে অলঙ্কার পরিধান করিয়া মাল্য, জপ, নমস্কার ও নানাবিধ গন্ধদ্রব্য দ্বারা দেবদ্বিজগণের পূজা সমাধা করিলেন। তিনি ক্রমে ক্ৰমে তৎকালোচিত সমস্ত কাৰ্য্য সমাপন করিয়া স্বপুরগমনোদযোগে বহিঃকক্ষায় [হির্ব্বাটী-পুরের বাহিরের অংশ] বিনির্গত হইলেন। স্বস্তিবাচক ব্ৰাহ্মণগণ দধিপাত্ৰ, ফল, পুষ্প ও অক্ষত প্রভৃতি মাঙ্গল্যবস্তু হস্তে করিয়া তথায় উপস্থিত ছিলেন। বাসুদেব তাহাদিগকে ধনদানপূর্ব্বক প্ৰদক্ষিণ করিলেন। পরে অত্যুৎকৃষ্ট তিথি-নক্ষত্ৰযুক্ত মুহুর্তে গদা, চক্র, অসি, শার্ঙ্গ প্রভৃতি অস্ত্রশাস্ত্রে পরিবৃত, গরুড়কেতন [গরুড়চিহ্নিত], বায়ুবেগগামী, কাঞ্চনময় রথে আরোহণ করিয়া স্বপুরে গমন করিতেছেন, এমন সময়ে মহারাজ যুধিষ্ঠির স্নেহপরতন্ত্র হইয়া সেই রথে আরোহণপূর্ব্বক দারুক সারথিকে তৎস্থান হইতে স্থানান্তরে উপবেশন করাইয়া স্বয়ং সারথি হইয়া বলগা গ্রহণ করিলেন। মহাবাহু অর্জ্জুনও তাঁহাতে আরোহণ করিয়া স্বর্ণদণ্ডবিরাজিত শ্বেতচামর ধারণপূর্ব্বক শ্ৰীকৃষ্ণকে বীজন করিয়া প্ৰদক্ষিণ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন নকুল এবং সহদেব ঋত্বিক ও পুরোহিতগণসমভিব্যাহারে তাহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। শত্রুবলান্তক বাসুদেব যুধিষ্ঠিরাদি ভ্রাতৃগণ কর্তৃক অনুগম্যমান হইয়া শিষ্যগণানুগত গুরুর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তিনি অর্জ্জুনকে আমন্ত্রণ ও গাঢ় আলিঙ্গন, যুধিষ্ঠির ও ভীমসেনকে পূজা এবং নকুল ও সহদেবকে সম্ভাষণ করিলেন। যুধিষ্ঠির, ভীমসেন ও অর্জ্জুন তাঁহাকে আলিঙ্গন এবং নকুল ও সহদেব তাঁহাকে অভিবাদন করিলেন। তৎপরে ক্রমে ক্ৰমে অৰ্দ্ধ-যোজন গমন করিয়া শত্রুনিসূদন কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক ‘প্রতিনিবৃত্ত হউন’ বলিয়া তাহার পাদদ্বয় গ্ৰহণ করিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির চরণে পতিত পতিতপাবন কমললোচন কৃষ্ণকে উত্থাপিত করিয়া তাহার মস্তকাম্রাণপূর্ব্বক স্বভবনে গমন করিতে অনুমতি করিলেন। তখন ভগবান বাসুদেব পাণ্ডবগণের সহিত যথাবিধি প্রতিজ্ঞা করিয়া অতিকষ্টে দ্বারাবতী প্ৰতিগমন করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ কৃষ্ণকে যতক্ষণ দেখিতে পাইলেন, ততক্ষণ তাঁহারা নিমেষশূন্যনয়নে তাঁহাকে নিরীক্ষণ ও মনে মনে তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। কৃষ্ণকে দেখিয়া তাহাদিগের মন পরিতৃপ্ত না হইতে হইতেই তিনি তাহাদিগের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলেন। তখন পাণ্ডবগণ কৃষ্ণদৰ্শনে নিতান্ত নিরাশ হইয়া তদ্বিষয়িণী চিন্তা করিতে করিতে স্বপুরে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। দেবকীনন্দন কৃষ্ণও অনুগামী মহাবীর সাত্বত এবং দারুক সারথির সহিত বেগবান গরুড়ের ন্যায় সত্বরে দ্বারকাপুরে সমুপস্থিত হইলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে সুহৃজনপরিবৃত হইয়া স্বপুরে প্রবেশ করিলেন এবং ভ্রাতা, পুত্র ও বন্ধুদিগকে বিদায় দিয়া দ্রৌপদীর সহিত আমোদ-প্রমোদে কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এদিকে কৃষ্ণও পরমহ্লাদিতচিত্তে দ্বারকাপুরে প্রবেশ করিলেন। উগ্রসেন প্রভৃতি যদুশ্রেষ্ঠগণ তাঁহার পূজা করিতে লাগিলেন। বাসুদেব পুরপ্রবেশ করিয়া অগ্ৰে বৃদ্ধ পিতা, আহুক ও যশস্বিনী মাতাকে, পরে বলভদ্রকে অভিবাদন করিলেন। অনন্তর তিনি প্ৰদ্যুম্ন, শাম্ব, নিশঠ, চারুদেষ্ণ, গদ, অনিরুদ্ধ ও ভানুকে আলিঙ্গন করিয়া বৃদ্ধগণের অনুমতি গ্রহণপূর্ব্বক রুক্মিণীর ভবনে উপস্থিত হইলেন।