বিমানটিকে চাইল্ড স্পেশাল বলা যায়। একসঙ্গে এত বাচ্চা আমি আর কোনও ফ্লাইটে দেখিনি।
সামনে, পেছনে, চতুর্দিকেই অনেক যাত্রীর কোলেই একটি করে শিশু, তারা একসঙ্গে কান্না জুড়েছে।
বাচ্চাদের প্রতি যত স্নেহই থাক, তাদের কান্না বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। বাচ্চারা তো কাঁদেই বড়দের তিতিবিরক্ত করার জন্য, যাতে বড়রা অন্য সব কাজ ফেলে শুধু তাদের প্রতি মন দেয়। বিমান যাত্রার শুরুতে অধিকাংশ বাচ্চাই কাঁদে, তার অন্য একটা কারণও আছে। বিমানের
উত্থান ও অবতরণের সময় কানে বাতাসের চাপ লাগে, বড়রা তা সহ্য করতে পারলেও বাচ্চাদের নিশ্চিত খুব কষ্ট হয়, তাই তারা চিল চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায়।
হঠাৎ উপলব্ধি হল, পৃথিবীর সব শিশুদের কান্না একইরকম। মানুষের মধ্যে কতরকম জাতি, কত ভাষা, কত সংস্কার, কতরকম বিভেদ, সবই কৃত্রিমভাবে তৈরি করা, সব মানুষই একইরকমভাবে জন্মায়, জন্মের পর অন্তত দু-তিন বছর মানবশিশুর হাসি ও কান্নায় কোনও প্রভেদ নেই। রকেফেলার পরিবারের কোনও বাচ্চা আর কলকাতার বস্তির কোনও গরিব মায়ের সন্তান ঠিক একই সুরে কাঁদে।
কলকাতায় ইদানীং শ্বেতাঙ্গ বিদেশিরা বিশেষ আসে না। এই ফ্লাইটে কিন্তু প্রচুর সাহেব মেম আর তাদের কোলেই একটি করে কালো কালো বাচ্চা। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এরা এসেছিল শিশু পুত্র-কন্যা দত্তক নিতে। নীল পাড় সাদা শাড়ি পরা একজন দিশি মহিলাকেও দেখা গেল। তিনি নিশ্চিত মাদার টেরিজার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। অন্তত কুড়ি-পঁচিশটি বাচ্চা কলকাতা ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে চিরকালের মতন।
আমার সুইডেনের একটি দৃশ্য মনে পড়ল।
স্টকহলম শহরের মেট্রো ট্রেনগুলি অনেক গভীর। ওসব দেশে অনেক ভূগর্ভ ট্রেন লাইন দোতলা-তিনতলা হয়। সে রকমই একটা স্টেশনে এসকেলেটর দিয়ে নামার সময় মনে হয়, প্ল্যাটফর্ম কত নীচে, তলার মানুষগুলোকে ছোট ছোট দেখায়।
পাশ দিয়ে সিঁড়িও আছে। কিন্তু কোনও কারণে এসকেলেটর বন্ধ হলে অতটা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে কারুর-কারুর হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে।
ছোট ছেলেমেয়েদের কথা অবশ্য আলাদা। তারা অনেক সময় খেলাচ্ছলে এসকেলেটরের বদলে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে-দৌড়ে ওঠা-নামা করে। একদিন আমি একটা এসকেলেটর দিয়ে নামছি, পাশের সিঁড়ি দিয়ে তিনটি কিশোরী সিঁড়ি দিয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় মেতেছে।
তাদের মধ্যে দুজনের গায়ের রং তুষার শুভ্র, অন্য জনের শ্যামলা। সেইজন্যই তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি যায়।
আমার সঙ্গী এক বাংলাদেশি যুবক বলল, ওই যে মেয়েটিকে দেখছেন, ও কিন্তু ইন্ডিয়ান। আমি চিনি ওকে। ওর এক বছর দু-মাস বয়েসে ওকে কলকাতা থেকে অ্যাডপট করে আনা হয়েছিল। বাঙালিও হতে পারে। ওর অবশ্য কিছুই মনে নেই।
একটুপরে সেই মেয়ে তিনটি নেমে এল নীচের প্ল্যাটফর্মে। হাসির দমকে-দমকে হিলহিল করছে তাদের সারা শরীর। খুব সম্ভবত শ্যামল রঙের মেয়েটিই জিতেছে। তার চেহারায় স্বাস্থ্যের চমৎকার দীপ্তি, মুখখানায় সারল্যের পবিত্রতা মাখানো! যেন সে মন্দ কিছু চেনেই না।
এক বছর দু-মাস বয়েসে কলকাতা থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। হতেও পারে সে কলকাতার কোনও বস্তিবাসিনীর মেয়ে, কিংবা অবাঞ্ছিত সন্তান হিসেবে তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল আঁস্তাকুঁড়ে। এরকম তো কতই হয়। যদি মেয়েটি বর্ধিত হত কোনও বস্তিতে, তা হলে এই তেরো-চোদ্দো বয়েসে সে নিশ্চিত ঝি-গিরি করত কয়েকটি বাড়িতে, এর মধ্যে যৌন অভিজ্ঞতা হয়ে যেত অবশ্যই। কিংবা হাত-ফেরতা হয়ে চলে যেত হয়তো কোনও বেশ্যাপল্লীতে, তার মুখের এরকম সারল্য মুছে যেত কবে! দৈবাৎ শব্দটার মধ্যে দৈব মিশে আছে, ভাগ্য বললেও ঠিক বোঝায় না, যাই হোক, যে-কোনও উপায়ে সে এসে পড়েছে সুইডেনের মতন প্রাচুর্যের দেশে, কোনও ধনী পরিবারের সন্তান হিসেবে শুধু যে খাদ্য-বস্ত্র পেয়েছে তাই-ই নয়, পেয়েছে শিক্ষা, পেয়েছে সমবয়েসিদের সঙ্গে মেলামেশার সমান অধিকার। একটা অভাবনীয়, নতুন জীবন সে লাভ করেছে।
মেয়েটির সঙ্গে আমার একটু কথা বলার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। ওসব দেশে অচেনা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার কোনও সামাজিক জড়তা নেই। আমি তাকে জিগ্যেস করেছিলাম, তোমার নাম কী?
সে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল ইনগ্রিড। তারপরই সঙ্গিনীদের সঙ্গে দৌড়ে উঠে গিয়েছিল ট্রেনের একটা কামরায়। আর কিছু বলার সুযোগ পাইনি। কিন্তু আমাদের কলকাতার একটি অবাঞ্ছিত, পরিত্যক্ত মেয়ে এদেশে এসে একটা পরিচ্ছন্ন, সুন্দর জীবন পেয়েছে দেখে আমার এতই ভালো লেগেছিল যে কান্না এসে গিয়েছিল হঠাৎ।
অনেকদিন আগে কলকাতার ফুটপাথবাসীদের সম্পর্কে একটি মর্মন্তুদ তথ্যচিত্র দেখে পল এঙ্গেলের প্রথমা পত্নী মেরি এমনই ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, আমার সামনে তর্জনী তুলে তিনি বারবার প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা কলকাতার যারা ভদ্রলোক, তারা সব পরিবারে অন্তত একটি
করে পথশিশুকে দত্তক নিতে পারো না! তা হলে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট হাজার বাচ্চা তো বেঁচে যেতে পারে। নাও না কেন, কেন, কেন?
আমি উত্তর দিতে পারিনি।
আমাদের দেশে রক্তের সম্পর্ক বিষয়ে কুসংস্কার আছে। সেইজন্যই বেশিরভাগ মানুষ অজ্ঞাতকুলশীল শিশুদের পালিত সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে চায় না। আগেকার দিনে নিজেরই বংশের শাখা-প্রশাখার কোনও বাচ্চাকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করা হত। রক্তের সম্পর্ক ব্যাপারটা গুজব মাত্র, বহু পরিবারের রক্তেই ভেজাল আছে। এখন জিন-তত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে। মানব শরীরে জিনের মানচিত্রও তৈরি হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের ক্রোমোজোম মিলনে শিশুরা জন্মায় বটে, কিন্তু দশ পুরুষ আগেকার জিনের স্বরূপও কোনও শিশুর মধ্যে বিকশিত হতে পারে। সুতরাং একটা ভিখিরির ছেলের দশ প্রজন্ম আগেকার পূর্বপুরুষ হয়তো ছিল কোনও বীর যোদ্ধা কিংবা দার্শনিক। এই জিন প্রভাবেই কোনও মুচির ছেলে এক শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারে, হয়েছেনও, যেমন জোসেফ স্তালিন। অবশ্য এর সঙ্গে পুরুষকারও যুক্ত করতে হবে। মহাভারতের কর্ণের উক্তি একেবারে অমোঘ, দৈবায়ত্ত কুলে জন্ম, কিন্তু পৌরুষ আমার নিজের করায়ত্ত। মেয়েদের ক্ষেত্রে পুরুষকারের কোনও সঠিক প্রতিশব্দ নেই, কিন্তু এই মানসিক শক্তির জোরেই খুঁটেকুড়ুনির মেয়ে হতে পারে রাজরানি।
পুরুষকারের এক বাস্তব, জীবন্ত, ঐতিহাসিক নিদর্শন হচ্ছেন চেঙ্গিজ খান। কৈশোরেই ক্রীতদাস, শুধু তাই নয়, তাঁর গলায় শিকল বেঁধে রাখা হত পশুদের মতন, সেই অবস্থা থেকে তিনি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন। অনেকের মতে, এই চেঙ্গিজ খানই দ্বিতীয় সহস্রাব্দে কোনও মানুষের একক প্রচেষ্টায় উচ্চতম কীর্তি স্থাপনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক।
নিঃসন্তান দম্পতিরাই যে শুধু দত্তক গ্রহণ করবে, তারও কোনও মানে নেই। উন্নত দেশগুলিতে দেখা যায়, এক পরিবারে নিজস্ব সন্তানের সঙ্গে প্রতিপালিত হচ্ছে একাধিক দত্তক। আমি নিজেই দেখেছি, আমেরিকায় একটি পরিবারে ঠিক সমবয়েসি চারটি ছেলেমেয়ে, তাদের মধ্যে একজন মাত্র গৃহকর্তার আত্মজ। সে যে কে তা চেনবার উপায় নেই, বাইরের লোকদের কাছে আলাদা করে তার পরিচয়ও দেওয়া হয় না। এঁদের যেহেতু অর্থ সামর্থ্য আছে, তাই আর তিনটি অনাথ শিশুকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ দিয়েছেন। আমাদের দেশে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও গীতা মুখোপাধ্যায় আপন কন্যা করে নিয়েছেন বেশ কয়েকটি বাইরের মেয়েকে।
নিঃসন্তান দম্পতি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর একটি দত্তক নিলে তারপর কোনও কোনও পরিবারে একটি অতি মধুর সুখকর ঘটনা ঘটে। আমি নিজেই অন্তত দুটি ক্ষেত্রে এরকম দেখেছি। যে বধূটি কখনও গর্ভবতী হবে না বলে ধরেই নেওয়া হয়েছিল, চিকিৎসকরাও সে রকম বলেছিলেন, কিন্তু দত্তক নেওয়া সন্তানটির প্রতি সেই বধূটির অবরুদ্ধ স্নেহ যেমন মুক্তি পায়, সেই সঙ্গে-সঙ্গে হরমোনের নিঃসরণও শুরু হয়। খুলে যায় রুদ্ধদ্বার, হঠাৎ সে সন্তানসম্ভবা হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশের অনাথ শিশুদের বিদেশিরা দত্তক নিয়ে যায়, তাতে আবার অনেকে ক্রুদ্ধ হয়, চাগিয়ে ওঠে দেশপ্রেম। সংবাদপত্রে দেখি, তাদের বক্তব্য, এ-ও এক ধরনের শিশু পাচার। এ দেশের ছেলেমেয়েদের বিদেশিরা পাইকারি হারে নিয়ে গেলে তাতে দেশের বদনাম হবে না? এই ধরনের দেশপ্রেম দেখালে আমার গা জ্বলে যায়। দেশ আবার কী? মহাবিশ্ব সম্পর্কে যেটুকু আমাদের জ্ঞান হয়েছে, তাতে আমরা বুঝতে পারি, কী দুর্লভ ও মূল্যবান এই মনুষ্য জন্ম। পরিচিত অন্য কোনও গ্রহ-উপগ্রহে তা নেই। এবং মাত্র একবারই এই সুযোগ পাওয়া যায়। এই মনুষ্য জন্মটাকে সার্থক করতে না পারাটাই সভ্যতার নিদারুণ ব্যর্থতা। অনেক দেশ তার সব মানুষদের এখনও সে সুযোগ দিতে পারে না। বেঁচে থাকাটাই বড় কথা, তা দেশগুলির কৃত্রিম সীমানা পেরিয়ে মানুষ যেখানে বাঁচতে পারবে, যেখানে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষার সুযোগ পাবে, সেখানেই যাবে।
এইসব প্রতিবাদী দেশপ্রেমিক বীরপুরুষরা পথশিশুদের দিকে ফিরেও তাকায় না। অবহেলায়, অপুষ্টিতে কত বাচ্চা মরে যাচ্ছে তা গ্রাহ্যও করে না। শুধু বিদেশিরা বাচ্চাদের নিয়ে গেলে তাদের মানে ঘা লাগে। এরা ঠিক গো হত্যা নিবারণের প্রচারকদের মতন। তাদের গো মাতারা যে কতরকম অত্যাচার সহ্য করে, কী নিদারুণ কষ্টের মধ্যে থাকে, তা নিবারণ করার কোনও উদ্যোগ নেই। কিন্তু কেউ গো-মাংস ভক্ষণ করলেই তারা গেল-গেল রব তোলে।
সুইডেনে যে শ্যামলা রঙের মেয়েটিকে দেখেছিলাম, সে মেয়েটি যদি কখনও অলিম্পিকে দৌড় প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক বিজয়িনী হয় কিংবা কোনও বিষয়ে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যায়, তখনই আমরা হ্যাংলার মতন তাকে ভারতীয় বলে দাবি করব! যাদের আমরা খেতে দিতে পারি না, যাদের শিক্ষার সুযোগ নেই, কিংবা এ দেশে যাদের জীবিকার সংস্থান হয় না, তারা যদি অন্য দেশে গিয়ে কোনও ব্যাপারে বিশেষ কৃতিত্ব দেখায়, অমনি তাদের কৃতিত্বের ভাগ নেওয়ার জন্য আমাদের নোলা শক শক করে।
আমার এ ফ্লাইটে যে-সব বাচ্চারা কাঁদছে, তাদের কোলে নিয়ে ঘুরে-ঘুরে কান্না থামাবার চেষ্টা করছে পুরুষরাই। একজন দীর্ঘকায় পুরুষ আমার কাছ দিয়েই যাতায়াত করছে, বাচ্চাটার পিঠ চাপড়াতে-চাপড়াতে মৃদু স্বরে একটা ছড়া বলছে, তার ভাষা ইংরিজি নয়। সম্ভবত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কোনও ভাষা। কলকাতার একটি দুধের শিশুকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ছড়া শোনানোও অবান্তর নয়। শিশুটির মুখে এখনও ভাষা ফোটেনি, অর্থাৎ তার নিজস্ব কোনও ভাষা নেই, ভবিষ্যতে সে তার পালক পিতার ভাষাতেই বর্ধিত হবে, এখন যে-কোনও স্নেহের শব্দ শোনাই তার পক্ষে যথেষ্ট।
মা ও বাবার মধ্যে সাধারণত বাবারা বাচ্চাদের কান্না-টান্না ঠিক সামলাতে পারে না। অনেক পিতাই শিশু সন্তানের কান্নাকাটিতে কিছুক্ষণ পরে বিরক্ত বা ধৈর্যহীন হয়ে ওঠে, স্ত্রীকে ডাকাডাকি করে। কোনও বাবা অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চার কান্না থামাতে পারছে না, রান্নাঘর থেকে মা ছুটে এসে বাচ্চাটাকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিয়ে কয়েকবার চাপড় দিতেই ম্যাজিকের মতন তার কান্না থেমে যায়। এর একটা জৈবিক কারণও আছে। সব জননীই তার শিশু সন্তানদের কোলে তুলে নিয়ে বুকের বাঁ-দিকে মুখটা চেপে ধরে। পৃথিবীর কোনও জননীই সন্তানদের বুকের ডান দিকে চেপে ধরে না। তার কারণ বাঁ-দিকেই জননীর হৃৎপিণ্ড। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বেশ কিছুদিন শিশু এই অপরিচিত পৃথিবীতে নানারকম শব্দ শুনে অসহায় বোধ করে, ভয় পায়। একমাত্র মায়ের হৃৎপিণ্ডের লাবডুব শব্দটাই তার চেনা, মাতৃগর্ভে থাকার সময় সে ওই শব্দটাই শুনেছে। সেই জন্যই মা তাকে বুকের বাঁ-দিকে চেপে ধরলে সে আবার ওই পরিচিত শব্দটা শুনে স্বস্তি পায়।
এক মায়ের সন্তানকে অন্য মা যদি বুকের বাঁ-দিকে চেপে ধরে তা হলেও কি শিশুটি একই রকম স্বস্তি বোধ করবে? কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ, ককেশিয়ান ও নিগ্রোবটু, ধনী ও দরিদ্র, সব মায়েদেরই কি হৃৎস্পন্দনের শব্দ একরকম? এ বিষয়ে আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই।
অনেকক্ষণ ধরে বাচ্চাদের চ্যাঁ ভ্যাঁ শোনা ও বাচ্চাদের পায়চারি দেখার একঘেয়ে দৃশ্য থেকে চক্ষু ফিরিয়ে যে আকাশ দেখব, তারও উপায় নেই। আমার পাশে, জানলার ধারে যে ভাগ্যবান ব্যক্তিটি বসে আছেন, তাঁর চেহারা আমার থেকেও বিপুল, তিনি পুরো জানলাটাই ঢেকে রেখেছেন। আমি লোভীর মতন তবু দু-একবার উঁকিঝুঁকি মেরেছি, যদি তাঁর বপুর ফাঁকফোকর থেকে একটুখানি আকাশ দেখা যায়! আমার জানলা-প্রিয়তার প্রধান কারণ এই, অনেকক্ষণ ধরে প্লেনের যাত্রীদের মুখ দেখার চেয়ে আকাশ দেখা অনেক ভালো। কারণ, আকাশ কখনও পুরোনো হয় না।
আমার অন্যপাশে আইল সিটে যিনি বসে আছেন, তিনি রোগ ও ছিমছাম, তবে প্রথম থেকেই তিনি একটা খাতা খুলে, না, কবিতা রচনা নয়, কীসব বড়-বড় টাকার অঙ্ক যোগ-বিয়োগ শুরু করেছেন। আমি প্রথম থেকেই ঠিক করে ফেলেছি, এই দুই সহযাত্রীর সঙ্গে একটি ব্যাক্যব্যয়ও করব না। সচরাচর বিমান যাত্রায় কথোপকথন নিতান্তই আমড়াগাছির মতন। অকারণ সময় নষ্ট হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তার চেয়ে বরং একেবারে চুপ করে থাকলে অনেক মৌলিক চিন্তা মাথায় আসতে পারে।
মহাত্মা গান্ধী যে সপ্তাহে একদিন মৌনব্রত পালন করতেন, তার উপকারিতা আমি অনুভব করতে পারি। কী করে? আমি তো ওই ব্রত নিইনি, সারাদিন বাক্যহীন থাকার সুযোগও আমার ঘটে না। একবার, একদিন মাত্র ঘটেছিল। ইস্তানবুলে।
তুরস্ক দেশ থেকে আমি কখনও আমন্ত্রণ পাইনি, ইস্তানবুল গিয়েছিলাম স্বেচ্ছায়। নিজের উদ্যোগে।
পুরো টিকিট কেটে যেতে হলে হয়তো সম্ভব হত না।
সেবারে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ছ’জন লেখক-লেখিকার একটি দল পাঠানো হয়েছিল চেকোশ্লোভাকিয়ায় (তখন এই দেশটি দু-ভাগ হয়নি, তার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল) এবং বুলগেরিয়ায়। সেই দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার খবর পেয়েই আমি ঠিক করেছিলাম, তা হলে ইস্তানবুলে যেতেই হবে। চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগ বা প্রাহা শহরে আমাদের সরকারি সফর শেষ হবে, সেখান থেকে ইস্তানবুল বেশি দূর নয়। বিমানের টিকিট সামান্য বদলে স্টপ ওভার পাওয়া যায়। তাতে দামের বিশেষ হেরফের হয় না। ইস্তানবুলের পূর্ব নাম ছিল কনস্টান্টিনোপোল, শহরটি একেবারে ইতিহাসের খনি। রোমান সভ্যতা, বাইজান্টাইন সভ্যতা এবং ইদানীংকালের আরব সভ্যতা স্তরে স্তরে বিধৃত হয়েছে এই একটি মাত্র শহরে। এখানেই রাস্তায় বসে গান গাইতেন মহাকবি হোমার, এককালের প্রখ্যাত ট্রয় নগরের ধ্বংসাবশেষও পাওয়া গেছে এর কাছাকাছি।
আমার সঙ্গে যে অন্য পাঁচজন লেখক-লেখিকা ছিলেন, আমি তাঁদের জনে-জনে অনুরোধ করেছিলাম আমার সঙ্গী হওয়ার জন্য, কেউ রাজি হননি। আমি লক্ষ করেছি, সাহিত্যিকরা, বিশেষত ভারতীয় সাহিত্যিকরা অনেকেই ভ্রমণে উৎসাহী নন। সরকার থেকে যখন প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়, তখন সরকার থেকে যেটুকু ব্যবস্থাপনা থাকে, শুধু সেইটুকুই সেরে নিয়ে তারা দেশে ফিরে আসতে চান অতি দ্রুত, এ আমি দেখেছি বহুবার। আর আমি প্রত্যেকবারই নিজের উদ্যোগে টুকটাক ঘুরে আসি কাছাকাছি অন্য দু-একটা দেশ। জীবনে প্রথমবার আমেরিকা এসে, ফেরার পথে, আর কখনও এমন ভ্রমণের সুযোগ পাওয়া যাবে না এই ভেবে, আমি রোম ও ইজিপ্ট গিয়েছিলাম অতি সামান্য অর্থ সম্বল করে। এবং সেসব শহরে কেউ পরিচিত ছিল না, কারুর সঙ্গে আমার যোগাযোগও করিয়ে দেওয়া হয়নি।
আমার সমসাময়িক এক বাঙালি লেখক একবার লন্ডনে গিয়েছিলেন একটি আমন্ত্রণ পেয়ে। আমি তাঁকে বলেছিলাম, ফ্রান্সে যাবেন না?লন্ডন থেকে প্যারিসের দূরত্ব মাত্র এক ঘণ্টা, সেখানে আমার বন্ধুবান্ধব আছে, থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দেব, খরচ প্রায় কিছুই লাগবে না, ফ্রান্সের আর্ট গ্যালারিগুলো দেখার এই সুযোগ ছাড়বেন কেন? তিনি নিমরাজি হয়েও শেষ পর্যন্ত গেলেন না, লন্ডন থেকেই ফিরে এলেন সরাসরি। আর কখনও প্যারিসে যাননি।
আমি যে নানান দেশে ঘোরাঘুরি করি, তা আমার লেখক সত্তার জন্য নয়। কৈশোর থেকেই একটা বাউণ্ডুলেপনা ছিল, আর অচেনা জায়গা দেখার দুরন্ত নেশা। অল্প বয়েসে যে-টানে আমি গিয়েছি সাঁওতাল পরগনার ছোট-ছোট পাহাড় অঞ্চলে কিংবা আসামের মার্গারিটায় কিম্বা বিনা টিকিটে বিশাখাপত্তনমে, সেই টানেই গেছি, আফ্রিকার কেনিয়ায়, সেরিংগেটি ফরেস্টে থেকেছি তাঁবুতে, প্রবল গ্রীষ্মে উটের পিঠে চেপে ইজিপ্টের মরুভূমিতে পিরামিড দেখতে। সেই টানেই ইস্তানবুলে। আমি এমন অনেক দেশে গেছি, যেসব দেশ সম্পর্কে এক লাইনও ভ্রমণকাহিনি লিখিনি।
আমার অবশ্য একটা সুবিধে আছে, যে-কোনও জায়গায় থাকতে পারি এবং খাদ্য সম্পর্কে কোনও বাছবিচার নেই। যে-কোনও খাদ্য আমি চেখে দেখতে রাজি আছি, জিহ্বার স্বাদে ভালো
লাগলে খেয়ে নিই, ভালো না লাগলে ফেলে দিই, কোনওরূপ পূর্ব সংস্কার মানি না। এই জন্যই হাঙর-কুমির-অক্টোপাস দিব্যি খেয়ে নিয়েছি। সাপ-ব্যাঙ-জেব্রা-ক্যাঙারুর মাংস অপছন্দ হয়নি, এমনকী নর্মান্ডি উপকূলে জীবন্ত ঝিনুক এবং জাপানের কাঁচা মাছও উপভোগ করেছি।
ইস্তানবুলে আমার পরিচিত কেউ ছিল না।
বিমানবন্দরে নেমে দেখলাম, পর্যটকদের সহায়তা করার জন্য একটা কাউন্টার রয়েছে। সেখানে গিয়ে বললাম, আমার দু-তিন দিনের জন্য একটা জায়গা চাই। একটা সস্তার হোটেলের সন্ধান দিতে পারো? সে আমাকে একটা ছাপানো চার্ট দিল, তাতে অসংখ্য হোটেলের নাম ঠিকানা, কোনওটির দৈনিক ঘরভাড়া সাতশো সাড়ে সাতশো ডলার, আবার কোনওটির দশ ডলার। আমি দশ ডলারের হোটেলের নামে আঙুল রাখতেই সে বলল, তুমি অত সস্তার হোটেলে থাকতে পারবে না, পাড়াগুলো খারাপ, তোমার মালপত্র ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। তুমি দৈনিক অন্তত পঞ্চাশ ডলার খরচ করতে পারবে? সেটা আমার পক্ষে বেশি, বললাম, আর একটু নীচে নামো। সে বলল, তা হলে অন্তত পঁচিশ থেকে তিরিশ ডলারের মধ্যে বাইরে খেয়ে নেবে, তাতে সস্তা হবে। আমি সম্মতি জানাতে সে আমাকে সে রকম পাঁচটি হোটেলের নামে দাগ দিয়ে বলল, এগুলোতে চেষ্টা করে দেখো, যদি খালি পাও, তবে ঘর আগে যাচাই করে নিও। কিছু কিছু হোটেলে খুব বাজে ঘর গছিয়ে দেয়।
হোটেলগুলি যে জনবহুল এলাকায়, তা বিমানবন্দর থেকে অনেকটা দূরে। ট্যাক্সি নিতেই হবে। কাউন্টারের যুবকটিই আমাকে সাবধান করে দিল, ট্যাক্সিওয়ালা তোমাকে ঘুর পথে নিয়ে গিয়ে ঠকাতে চাইবে। ন্যায্য ভাড়া হওয়া উচিত আট থেকে সাড়ে আট হাজার দিনার। (তুরস্কের মুদ্রা এখন দিনার, যা শুনলেই আরব্য উপন্যাসের কথা মনে কড়ে। তবে একালের দিনারের মূল্যবান খুবই কমজোরি। ভারতীয় মুদ্রার থেকেও বেশ কম।)
ট্যাক্সি চালকটির ইংরিজি জ্ঞান কহতব্য নয়, বাংলা বললেও একই রকম বুঝবে, তবে বেশ হাসিখুশি। দিলখোলা। সে আমাকে দু-তিনটি হোটেল ঘুরিয়ে দেখাল নিজেই গরজ করে। তৃতীয়টিতে পছন্দ হল ঘর, ভাড়াও আমার সঙ্গতির মধ্যে, শুনতে পনেরো-কুড়ি হাজার দিনার, আসলে আঠাশ ডলারের সমতুল্য। আমি ট্যাক্সি চালকের সঙ্গে দরাদরি করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে অবাক করে সে চাইলই মাত্র পৌনে আট হাজার দিনার। সে আমাকে ভারতীয় বলে জেনেছিল, এবং এই পরিচয়ের জন্য হোটেলের ম্যানেজার, কর্মচারী, রাস্তার দোকানদাররাও সহৃদয় ব্যবহার করেছে। ইজিপ্টেও রাষ্ট্রপতি নাসেরের আমল পর্যন্ত ভারতীয়দের বেশ খাতির ছিল, এখন কী অবস্থা তা জানি না।
ইস্তানবুলে শতকরা সাড়ে নিরানব্বই জনই ভালো ব্যবহার করলেও ব্যতিক্রম মাত্র একজনই ছিলেন এবং তিনি একজন বাঙালি। আমার এক শুভার্থী তাঁর টেলিফোন নাম্বারটি দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তুমি তার বাড়িতে উঠবে না, অন্য কিছু সাহায্য না চাও চেয়ো না। শুধু টেলিফোনে একটু যোগাযোগ করে রেখো। কারণ, যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো, তাহলে একজন অন্তত নিজের দেশের মানুষকে জানাতে পারবে। শেষের যুক্তিটা আমার মনে ধরেছিল। হঠাৎ অসুস্থ হওয়া কিংবা দুর্ঘটনা তো ঘটতেই পারে। যদিও আগে কখনও এ নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
হোটেলে থিতু হয়ে বসার পর সন্ধেবেলা সেই ভদ্রলোককে ফোন করলাম। একটি পুরুষ কণ্ঠ অত্যন্ত নিস্পৃহ গলায় সিকিভাগ বাংলা ও বাকিটা ইংরেজিতে আমাকে বললেন, হ্যাঁ, কী ব্যাপার বলুন? আমি আপনার জন্য কী করতে পারি? আমি কে, কেন এসেছি, কী বৃত্তান্ত, সে ব্যাপারে কোনও আগ্রহই প্রকাশ করলেন না। আমি বললাম, আমার নাম এই, আজই এখানে এসে পৌঁছছি, হোটেলে উঠেছি, অমুকদা আপনার ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিলেন খবর নিতে। আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি আবার বললেন, হ্যাঁ, বুঝলাম, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি বলুন?
তখনই আমার ফোন রেখে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ভদ্রতা বড় দায়। আমি বিনীতভাবে নিতান্ত কথার কথা হিসেবে বললাম, তা সেরকম কিছু নয়, আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। আমি নিছক বেড়াতে এসেছি, এখানে প্রধান প্রধান দ্রষ্টব্য স্থান কী আছে বলতে পারেন? তিনি বললেন, টুরিস্ট গাইড ধরনের বই অনেক দোকাকেই পাওয়া যায়, তার একটি কিনে নিন, তাতেই দ্রষ্টব্য স্থানগুলির কথা জানতে পারবেন।
টুরিস্ট গাইড ধরনের বই পড়ে যে-কোনও জায়গার দ্রষ্টব্য স্থানগুলির কথা জানা যায়। এই মহামূল্যবান উপদেশটি এ পর্যন্ত ভূ-ভারতে আর কেউ আমাকে দেয়নি। আশ্চর্য, আমি এতদিন এটা জানতাম না? এই মহা উপকার করার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম।
আমি ধরেই নিলাম, আজ কোনও কারণে ভদ্রলোকের মেজাজ খারাপ আছে, হয়তো স্ত্রীর
সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। এরকম তো হয়ই। কিংবা তিনি বাংলা এবং বাঙালিদের সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন করতে চান। সেরকমও দৃষ্টান্ত আছে। কিংবা, উনি ভেবেছিলেন, আমি ওঁর কাছে আশ্রয় চেয়ে বিব্রত করব। সে যাই হোক, লোকে যেমন বলে, দ্যাটস হিজ প্রবলেম, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে যাব কেন? তাঁর সম্পর্কে আমার সব সম্পর্কের ইতি।
হয়তো, কয়েক ঘণ্টা পরে ভদ্রলোকের ভাবান্তর হয়েছিল, তখন আমি বাথরুমে, তিনি হোটেলে একটা বার্তা রেখেছিলেন, আমি চাইলে তিনি তাঁর বাড়িতে আমাকে একদিন চা-পানে আপ্যায়ন করতে চান, আমি জানালেই তিনি গাড়ি পাঠাবেন।
আমার অত চায়ের নেশা নেই। কারুর গাড়িতে চেপে অনেক দূরের কোনও বাড়িতে গিয়ে চা পানের বদলে রাস্তার ধারের কোনও দোকানের সস্তার ভাঁড়ের চা খেয়ে আমি বেশি তৃপ্তি পাই। ভদ্রলোককে আর ফোন করিনি।
এই বঙ্গ পুঙ্গবের কথা এতখানি বলতে হল এই কারণে যে তাতে পরবর্তী দিনটির কথা বোঝা যাবে। পৃথিবীর নানান দেশের প্রবাসী বাঙালিদের কাছ থেকে এত অন্তরিক ও চমৎকার ব্যবহার পেয়েছি, যে এই একমাত্র ব্যতিক্রমটি মনে দাগ কেটে যাবেই। আমিও গোঁয়ার কম নই। এবং অন্যভাবে বিচার করতে গেলে এই ভদ্রলোক আমার বেশ উপকারই করেছিলেন। রাত্রে শোওয়ার সময়ই ঠিক করে নিয়েছিলাম, পরদিন সকালে ভদ্রলোকটি যদি আবার ফোন করেন, তাহলে আমি কোনওভাবেই তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপ করব না। আমি তাঁর নাম মন থেকে মুছে ফেলেছি।
সেইজন্যই পরদিন, ভোরবেলা ভালো করে আলো ফুটবার আগেই বাথরুম-টাথরুম সেরে নিতে হল, ফোন বাজবার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে। (এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও ইস্তানবুলের হোটেলের টয়লেট সম্পর্কে একটা অভিনব তথ্য দিতে প্রলুব্ধ হচ্ছি। সব মুসলমান দেশেই টয়লেটে মগের বদলে একটা গাড়ু থাকে। বাংলাদেশেও এরকম দেখেছি। পশ্চাদ্দেশ শোধন করার জন্য মগ ও গাড়ুর মধ্যে কী ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা থাকে, তা আমার বুদ্ধির অগম্য। ইস্তানবুলের হোটেলের টয়লেটে গাড়ু ছিল না, মগও ছিল না। শুধু টয়লেট পেপার থাকলে সেটাকে পাশ্চাত্যদেশীয় কায়দা মনে করা যেত। হঠাৎ দেখি, কমোডের মধ্যে একটা লোহার নল, তার মুখটা গাডুর মতন। সেই গোপন গাড়ু-মুখো নল এসে জলের তোড়ে পশ্চাদ্দেশ পরিষ্কার করে দেয়।)
আগে জানতাম না। টার্কিতে জনসংখ্যার আটানব্বই শতাংশ এখন মুসলমান হলেও সেটি সংবিধানগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সেখানে অসংখ্য মসজিদ, গির্জা ও পেগান আমলের ধর্মস্থানের সহাবস্থান। আরও একটি ব্যাপারে ইস্তানবুল শহরটি অনন্য। পৃথিবীর অনেক আধুনিক শহরই এখন অনেকটা দৃশ্যত একই রকম, আমেরিকায় বহু শহরের ডাউনটাউন যেন কার্বন কপি, সেদিক থেকে ইস্তানবুল একেবারে পৃথক এবং সুন্দর তো বটেই। তা ছাড়াও ইস্তানবুলই পৃথিবীর একমাত্র শহর যা দুটি মহাদেশে বিস্তৃত। সত্যিই তাই, ইস্তানবুল শহরের কিছু অংশ এশিয়ায়, কিছুটা ইওরোপে। ব্রিজ পেরিয়ে যখন তখন এশিয়া থেকে ইওরোপে যাওয়া যায়। কোনও ভিসা-টিসার প্রয়োজন হয় না।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ছোট গল্পে একজন গ্রামের মানুষ হাঁটতে-হাঁটতে একটা গাছতলায় এসে জেনেছিল, সেখান থেকে অন্য একটি জেলার শুরু। জেলাগুলির মধ্যে সীমানা ভাগ করার কোনও চিহ্ন থাকে না। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় হরদম বহু লোক যাতায়াত করে, কিছু খেয়ালই করে না। শুধু সেই মানুষটি, এক জেলা অতিক্রম করছে জেনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিল। এখানেও ব্রিজ পেরিয়ে পায়ে হেঁটে এশিয়া থেকে ইওরোপ মহাদেশে যাওয়ার সময় আমার অবস্থাও হয়েছিল ওই গ্রামের মানুষটির মতন।
সেই বাঙালি ভদ্রলোকটির সঙ্গে আর কথা বলব না ঠিক করার পর রাস্তার বেরিয়ে কিছুক্ষণ বাদে ভাবলাম, আজ সারাদিন কারুর সঙ্গেই একটাও কথা না বললে কীরকম হয়? দেখাই যাক না!
দোকান-টোকানে ইংরিজি বোবাঝাতে গেলে এত ধস্তাধস্তি করতে হয় যে তার বদলে আকারে ইঙ্গিতে কাজ চালানো অনেক সহজ। পায়ে হেঁটেই একটা শহর সবচেয়ে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা যায়। প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে বড়-বড় গাছগুলি দেখে হকচকিয়ে গেলাম। চিনতে অসুবিধে হয় না, ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা! এত বড় গাছ! আর প্রত্যেক গাছে প্রচুর ফুল ফুটে আছে। আমাদের দেশের ম্যাগনোলিয়া এত বড় হয় না আর ফুল খুবই দুর্লভ। শহরের মাঝখান দিয়ে গোল্ডেন হর্ন নামে একটি প্রণালী আর বিখ্যাত বসফরাস। এই বসফরাসে কত রণতরী ভেসেছে, কত রক্তাক্ত ইতিহাস আছে। এখন অবশ্য এর ওপর ব্রিজ বানিয়ে দিয়েছে জাপানিরা।
ইস্তানবুলের বেশ কাছেই তুরস্কের চির শত্রু গ্রিস, আর একদিকে বুলগেরিয়া, সে দেশ তো তুর্কিরা বহুঁকাল দখল করে রেখেছিল ছেলেবেলার ইতিহাস-ভূগোলে পড়া নামগুলি চোখের সামনে জাজ্বল্যমান হতেই রোমাঞ্চ বোধহয়। স্টিমার সারভিস নিয়ে যখন তখন ঘুরে আসা যায় কৃষ্ণ সাগর (ব্ল্যাক সি) কিংবা মর্মর সাগর (সি অফ মারমারা)।
সন্ধেবেলা হঠাৎ খেয়াল হল, ভোর থেকে আমি কারুর সঙ্গে কথা বলিনি তো বটেই, মুখ দিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। এটা কোথাও নির্জনে বসে মৌনীবাবা সেজে থাকা নয়, সকাল থেকে ঘুরছি জনারণ্যে, দুবার দু-জায়গায় টিকিট কেটেছি, সব কাজ সারা হচ্ছে নিঃশব্দে, অথচ কেউ বোবা বলে মনে করছে না, একবারের বেশি দুবার তাকাচ্ছে না। দুপুরে খাবার খেয়েছি। সঙ্গে এক বোতল বিয়ার। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনে সেই নৌকো থেকেই মাছ ভেজে বিক্রি করা হয়। এত টাটকা মাছের স্বাদই আলাদা, কী মাছ জানি না। এক একটি প্রায় পাঁচশো গ্রাম ওজন, ভেতরে একটি মাত্র সরল কাঁটা, সঙ্গে হাতে-গড়া হৃষ্টপুষ্ট ফুলকো রুটি ও স্যালাড। এ একেবারে অমৃতবৎ এবং সস্তা। এসব কেনার জন্যও আমাকে একটি কথা খরচ করতে হয়নি, খানিকক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি, অন্য খদ্দেররা কত পয়সা দিচ্ছে। তারপর ঠিকঠাক সেই পয়সা বার করে বিক্রেতার সামনে গিয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ।
সন্ধেবেলা কৃষ্ণ সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। এশিয়ার দিকটায় আগে অন্ধকার নামে, ইওরোপের দিকটায় তখনও কিছু আলো থাকে। আলো নয়, পশ্চিমের আকাশ যেন জ্বলছে দাউদাউ করে। প্রাচ্য দেশ অন্ধকার, পাশ্চাত্যে আগুন!
সারাদিন একটিও শব্দ উচ্চারণ না করলে শরীরটা অনেক হালকা লাগে, সকল মানুষের মধ্যে থেকেও এক মনোরম একাকিত্বের সুখ অনুভব করা যায়। অন্যের সঙ্গে কথা না বললে বেশি করে কথা বলা যায় নিজের সঙ্গে। সভ্যতার এই তো অভিশাপ, নিজের সঙ্গে কথা বলার সময়ই পায় না অধিকাংশ মানুষ। তা হলে আর আত্মানং বিদ্ধি হবে কী করে?
আমি এখানে তুরস্ক ভ্রমণের কথা লিখতে বসিনি। লিখতে চাইছি এক নিঃসঙ্গতার অভিযানের কথা।
তবু, ইস্তানবুলের একটি সৌধের কথা না বললেই নয়।
রোমান সম্রাটরা এই কনস্তান্তিনোপোলে একটি গির্জা বানিয়েছিল, সেটা যেমন সুদৃশ্য তেমনই সুবিশাল। এর নাম সোফিয়া, বা হাজিয়া সোফিয়া। হাজিয়া শব্দটির অর্থ পবিত্র, আর সোফিয়ার একটি অর্থ মূর্তিমতী দিব্যজ্ঞান। খ্রিস্টানদের জগতে রোমের ভ্যাটিকানের পরই এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মস্থান। প্রায় পাঁচশো বছর এই গির্জাটি খ্রিস্ট ধমাবলম্বীদের প্রার্থনাভবন ছিল। তারপর রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর মুসলমানরা এটি দখল করে। বাইরে চারপাশে চারটি গম্বুজ বানিয়ে এটি রূপান্তরিত হয় মসজিদে। প্রায় এক হাজার বছর ধরে এই মসজিদে মুসলমানরা নামাজ পড়েছে।
তারপর তুরস্কে আধুনিকতার প্রবর্তক কামাল আতার্তুক এসে ঘোষণা করে দেন, এই হাজিয়া সোফিয়া আর শুধু মসজিদ থাকবে না, গির্জাও হবে না। এটি একটি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি। এর সংরক্ষণ করবে সরকার এবং যে-কোনও ধর্মের মানুষদের এখানে প্রবেশ ও প্রার্থনা করার অধিকার থাকবে।
যখন গির্জা হিসেবে নির্মিত হয়েছিল, তখন এর দেওয়ালে-দেওয়ালে ছিল অসংখ্য রঙিন রেখাচিত্র, বড়-বড় শিল্পীদের কাজ। মানুষের ছবি বা মূর্তি ইসলামে নিষিদ্ধ। সুতরাং মসজিদ হওয়ার পর তাতে ওইসব ছবি রাখা যায় না। কিন্তু তঙ্কালীন মুসলমান শাসকদের এটুকু অন্তত সুবুদ্ধি ও শিল্পবোধ ছিল, তারা ওই মহামূল্যবান ফ্রেসকোগুলি ধ্বংস করেননি। ঘষে ঘষে মুছেও ফেলেননি, পুরু চুনকাম দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন।
এখন আবার খুব যত্নে সেই চুনকাম তুলে তুলে ছবিগুলি পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। এই ছবিগুলি অমূল্য ইতিহাসের উপাদান। এক জায়গায় এক রাজা-রানির ছবিতে রাজার মুখখানা যেন তাঁর শরীরের সঙ্গে ঠিক মানানসই নয়। ঐতিহাসিকরা খুঁজে বার করেছেন তার কারণটি। রাজার মৃত্যুর পর রানি তাঁর প্রথম স্বামীর ধড়ের ওপর দ্বিতীয় স্বামীর মুণ্ডুটা জুড়ে দিয়েছিলেন।
এই সোফিয়াতে টুরিস্টদের ভিড়ের মধ্যেও আমি মুসলমান ও খ্রিস্টানদের কাছাকাছি বসে প্রার্থনায় মগ্ন থাকতে দেখেছি। অযোধ্যার রামমন্দির ও বাবরি মসজিদের কথা মনে পড়ে না? আমাদের দেশে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই বড় বেশি উগ্র ও যুক্তিহীন। মুসলমানরা রামমন্দির সম্পর্কে হিন্দুদের সেন্টিমেন্ট মানসিকতার মূল্য না দিয়ে বাবরি মসজিদ বজায় রাখার জন্য জেদ ধরেছিল, আর হিন্দু মৌলবাদীরা বাবরি মসজিদ ভাঙার মতন অন্যায় অসভ্যতায়
মেতে উঠতে দ্বিধা করেনি। ওই বিতর্কিত স্থানটিকে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত প্রার্থনাস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা যেত না? অবশ্য তার জন্য একজন কামাল আতাতুর্কের দরকার, সেরকম মেরুদণ্ড দিল্লির কোনও নেতারই আছে কি?
বিমান যাত্রায় সহযাত্রীদের সঙ্গে খেজুরে আলাপে সময় নষ্ট না করলে বই পড়ারও অনেকটা সময় পাওয়া যায়। আমি বড় আকারের বই এনেছি, বহুদূর যেতে হবে। এ বছর যে চিনা লোকটি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, সেই গাও জিংজিয়ান-এর (উচ্চারণ অন্যরকম হতে পারে, Gao Xingjian) উপন্যাস, সোল মাউন্টেন (আত্মা পর্বত।)
কলকাতা থেকে একটানা লন্ডন, উড়ান সময় প্রায় সাড়ে দশ ঘণ্টা। এর মধ্যে একবার ব্রেকফাস্ট ও পরে লাঞ্চ খেতে দেবে। সব বিমানের খাবারই এখন চরিত্রহীন হয়ে গেছে। জলের জাহাজ থেকে যখন প্রথম-প্রথম উড়োজাহাজে যাত্রী বাড়তে শুরু করে, তখন উড়োজাহাজের খাদ্য পরিবেশনে নানান বৈচিত্র্য ও বিশেষ যত্ন ছিল, এখন নিতান্তই দায়সারা। এখন তেমন খেতে ইচ্ছেও করে না।
তবু, একঘেয়ে যাত্রার মধ্যে খাবার পরিবেশনের সময়টায় মনে হয় কিছু একটা ঘটেছে। এয়ার হোস্টেসদের ব্যস্তভাবে ঘোরা ফেরা, ট্রলির আওয়াজ, নানা ধরনের কথা।
প্রত্যেক মানুষের পিঠে এমন একটা জায়গা আছে, যেখানে ডান হাত কিম্বা বাঁ-হাত, কোনওটাই পৌঁছোয় না। সেই জায়গাটায় চুলকোতে গেল অন্যের সাহায্য নিতে হয়। আমাদের প্রিয় ডাক্তার কালী চট্টোপাধ্যায় বলতেন মানুষ বিয়ে করে কেন জানিস তো? রাত্তিরবেলা ওই জায়গাটায় কুটকুট করলে বউ চুলকে দেবে! (একটি নাটকে আমি এই সংলাপটি ব্যবহার করেছি আগে।)
প্রত্যেক বিমানেই এরকম একটি প্রায় নো-ম্যানস ল্যান্ড আছে। অর্থাৎ সামনের দিক থেকে একটা খাদ্যের ট্রলি আসছে, পেছন দিক থেকেও একটা ট্রলি আসছে, তারা ওই জায়গাটায় পৌঁছোয় একেবারে শেষে। আমি বসেছি সেরকম একটা সিটে। মনে হয় যেন অনন্তকাল ধরে সুন্দরীরা আসছে তো আসছেই, প্রতীক্ষার আর শেষ নেই।
শেষ পর্যন্ত যে এসে পৌঁছোল, সে সুন্দরী নয়, একজন পুরুষ!
এদের গলায় আওয়াজে একটা খুব যান্ত্রিক ভদ্রতা থাকে, যা নিশ্চয়ই বেশ কষ্ট করে শিখতে হয়।
যেহেতু ভারতীয় যাত্রীরা অনেকেই নিরামিষ খায়, তাই প্রত্যেকেকে এরা জিগ্যেস করে, আমিষ, না নিরামিষ?
আমাকে সেই যন্ত্র-পুরুষটি বলল, আমিষ খাবার ফুরিয়ে গেছে, আপনি কি নিরামিষ খাবেন? নিরামিষ খাবারের বিরুদ্ধে আমার কোনও বক্তব্যই নেই, আমি বেশ পছন্দই করি। আমিষ ভক্ষকদের তো এই এক সুবিধে, তারা গাছেরও খায়, তলারও কুড়োয়। শুক্তো, লাউঘণ্ট দিব্যি লাগে, আবার মাছ ভাজা, কষা মাংসও চাই। সকালবেলা আমি অবশ্য মাছ-মাংস কখনও খাই না, প্রাতরাশের সময়, তবে মাঝে-মাঝে একটা ডিমসেদ্ধ ভদ্রলোক মাত্রই খায়। বিমানের প্রাতরাশে একটা ওমলেট ও দু-এক টুকরো সসেজ থাকে। তার বদলে পুরি-তরকারি খেলেও কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমাকে নিরামিষ খেতে বাধ্য করা হবে কেন? এতেই বিরক্ত লাগে।
এবারে যাত্রাটাই যে অশুভ হয়েছে, তার প্রমাণ, দুপুরে ঠিক একই ব্যাপার ঘটল। আবার খাবারের ট্রলি আমাদের সারিতে এসে পৌঁছোল সবচেয়ে শেষে। এবং যন্ত্র-মানবটি আবার বলল একই কথা, আমিষ ফুরিয়ে গেছে। নিরামিষ খাবেন?
কেন আমিষ ফুরিয়ে যায়? এয়ারলাইনস পয়সা বাঁচাচ্ছে?
আমি রাগারাগি না করে মৃদু গলায় জানালাম, না, আমি নিরামিষ খাই না। আপনারা আমাকে যদি না খাইয়ে রাখতে চান, রাখুন।
লোকটি আমাকে কিছু না দিয়েই চলে গেল।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে এই সেকটারের ফ্লাইটে বাংলায় অনেক ঘোষণা হয়, তাতে কিছুটা পুলকিত বোধ করছিলাম। এয়ার ইন্ডিয়া বাংলার ধার ধারে না, কলকাতা থেকে ফ্লাইটই বন্ধ করে দিয়েছে।
এখন উপলব্ধি হল, শুধু বাংলায় পেট ভরে না।