কৃষ্ণের যুধিষ্ঠির-সান্ত্বনা—যজ্ঞানুষ্ঠানে উপদেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! ধীমান ধৃতরাষ্ট্র এই কথা কহিলে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তূষ্ণীম্ভাব° অবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন মহাত্মা বাসুদেব তঁাহাকে নিতান্ত বিমনায়মান দেখিয়া সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! পরলোকগত ব্যক্তিদিগের উদ্দেশে সমধিক শোক করিলে তঁাহারা নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া থাকেন। অতএব এক্ষণে আপনি শোক পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রভূত দক্ষিণাদানসহকারে বিধানানুসারে যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হউন। সোমরসদ্বারা দেবগণের, স্বধাদ্বারা পিতৃগণের, অপানদ্বারা অতিথিগণের এবং প্রার্থনাধিক অর্থদানদ্বারা দরিদ্রগণের তৃপ্তিসাধন করুন। যাহা জানিবার, তাহা জানিয়াছেন এবং যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহারও অনুষ্ঠান করিয়াছেন। মহাত্মা ভীষ্ম, ব্যাস, নারদ ও বিদুরের অনুগ্রহে রাজধৰ্ম্মসমুদয় আপনার শ্রুতিগোচর হইয়াছে। অতএব মূঢ়ের ন্যায় কাৰ্য্য করা আপনার বিধেয় হইতেছে না; এক্ষণে পূর্ব্বপুরুষগণের ন্যায় অধ্যবসায় সহকারে রাজ্যভার বহন করুন। যশোদ্বারা স্বর্গলাভ করাই ক্ষত্রিয়ের কৰ্ত্তব্য। যাঁহারা সংগ্রামে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহাদিগের নিশ্চয়ই স্বর্গলাভ হইয়াছে। যাহা হউক, ভবিতব্যই এই লোক্ষয়ের কারণ। অতএব এক্ষণে শোক পরিত্যাগ করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। রণক্ষেত্রে যাহাদিগের মৃত্যু হইয়াছে, আপনি কখনই তাহাদিগের দর্শনলাভ করিতে পারিবেন না।”
মহামতি বাসুদেব এই কথা কহিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বাসুদেব! তুমি আমার প্রতি কিরূপ প্রীতি প্রদর্শন কর, আমি তাহা বিলক্ষণ অবগত আছি। তুমি আমার প্রতি সুহৃদ্ভাব প্রদর্শন করিয়া আমাকে যথেষ্ট অনুগ্রহ করিয়া থাক। এক্ষণে তুমি যদি প্রীতমনে আমাকে তপোবনগমনে অনুমতি প্রদান কর তাহা হইলে আমার যারপরনাই প্রিয়ানুষ্ঠান করা হয়। মহাবীর কর্ণ ও পিতামহ ভীষ্মের লোকান্তরপ্রাপ্তি হওয়াতে আমি কিছুতেই শান্তিলাভ করিতে পারিতেছি না, এক্ষণে যে কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিলে আমি এই ঘোরতর পাপ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারি, যাহা দ্বারা আমার মনে পবিত্রতার সঞ্চার হইতে পারে, তুমি তাহারই উপায়বিধান কর।”
যুধিষ্ঠিরের প্রতি ব্যাস-সান্ত্বনা—কর্ত্তব্যের উদ্বোধ
ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এইরূপ শোকাবহ বাক্য প্রয়োগ করিলে মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন, “বৎস! তোমার বুদ্ধি অদ্যাপি পরিপক্ক হয় নাই। তুমি এখনও বাল্যভাবে বিমোহিত হইতেছ। কিন্তু আমরা তোমাকে এইরূপ দেখিয়াও বারংবার বৃথা বাক্যব্যয় করিতেছি। যাহাদিগের যুদ্ধই জীবিকা, তুমি সেই ক্ষত্রিয়দিগের ধর্ম্ম বিলক্ষণ অবগত আছ। স্বধৰ্ম্মনিরত নরপতিগণ কখনই শোক-দুঃখে নিমগ্ন হয়েন না। তুমি আমার নিকট মোক্ষধর্ম্মসমুদয় শ্রবণ করিয়াছ। আমি বারংবার তোমার বিবিধ বিষয়ে সন্দেহ দূর করিয়া দিয়াছি। এক্ষণে যখন উপদেশে কিছুমাত্র ফল দর্শে নাই, তখন বোধ হইতেছে যে তুমি আমার নিকট যাহা শ্রবণ করিয়াছ, তদ্বিষয়ে তোমার কিছুমাত্র শ্রদ্ধা না থাকাতে, তুমি তৎসমুদয় বিস্মৃত হইয়া গিয়াছ। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি আর শোকাকুল হইও না। অজ্ঞানতা তোমাকে অচিরাৎত পরিত্যাগ করুক। তুমি সকল বিষয়েরই প্রায়শ্চিত্ত অবগত আছ এবং রাজধৰ্ম্ম ও দানধৰ্ম্মও সম্যক্ জ্ঞাত হইয়াছ। অতএব সৰ্ব্বধৰ্ম্মজ্ঞ ও সৰ্ব্বশাস্ত্রবিশারদ হইয়া অজ্ঞানের ন্যায় বিমোহিত হওয়া নিতান্ত অনুচিত।