২৯তম অধ্যায়
কৃষ্ণকর্ত্তৃক যুধিষ্ঠিরের শোক সান্ত্বনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাত্মা বেদব্যাস এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে ধৰ্ম্মরাজ তাঁহার বাক্যে কিছুমাত্র উত্তর করিলেন না। তখন মহামতি অর্জ্জুন বাসুদেবকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “সখে! ধৰ্ম্মরাজ শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়াছেন, তুমি উহাকে আশ্বাস প্রদান কর। ইহার শোকনিবন্ধন আমরা সকলেই পুনরায় ঘোরতর বিপদগ্রস্ত হইয়াছি, অতএব ইহার শোকনিবারণ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য।” তখন পুণ্ডরীকাক্ষ ভগবান্ বাসুদেব মহাত্মা অৰ্জ্জুনকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া যুধিষ্ঠিরসমীপে গমন করিলেন। ধৰ্ম্মরাজ বাল্যকালাবধি অৰ্জ্জুন অপেক্ষা কৃষ্ণের প্রতি প্রীতি প্রদর্শন করিতেন এবং কিছুতেই তাঁহার বাক্য অতিক্রম করিতেন না। মহাবাহু মধুসূদন ধৰ্ম্মরাজের সমীপে গমনপূর্ব্বক শৈলশৃঙ্গসদৃশ চন্দনচর্চিত হস্ত ধারণ করিয়া সান্ত্বনাবাক্যে কহিলেন, “নরনাথ! শোকদ্বারা গাত্রশোষণ করা আপনার কর্ত্তব্য নহে। এই সমরাঙ্গনে যেসকল বীর নিহত হইয়াছেন, আপনি কোনরূপেই তাঁহাদিগকে পুনরায় প্রাপ্ত হইতে পারিবেন না। তাঁহারা স্বপ্নলব্ধ অর্থের ন্যায় এককালে বিনষ্ট হইয়া গিয়াছেন। উহারা সকলেই ক্ষাত্রধর্ম্মানুসারে মহারণে সম্মুখীন হইয়া বীরগণের সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে প্রাণ পরিত্যাগপুৰ্ব্বক বীরজনোচিত পরম পবিত্র গতিলাভ করিয়াছেন। উঁহাদের কেহই রণপরাঙ্মুখ বা পলায়মান হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করেন নাই। অতএব তাঁহাদিগের নিমিত্তও শোক করা আপনার কর্ত্তব্য নহে। এই স্থলে আমি একটি পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।
কৃষ্ণোক্ত নারদ সৃঞ্জয় সংবাদ—মরু মাহাত্ম্য
“তপোধনাগ্রগণ্য নারদ সৃঞ্জয়কে পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর দেখিয়া কহিয়াছিলেন, “মহারাজ! কি আমি, কি তুমি, কি অন্যান্য ব্যক্তিগণ সকলকেই সুখদুঃখ ভোগ করিতে হয় এবং পরিণামে সকলকেই মৃত্যু প্রাপ্ত হইতে হইবে; তবে তুমি কি নিমিত্ত অনুতাপ করিতেছ! আমি এক্ষণে পূর্ধ্বতন মহীপালগণের মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিতেছি, তুমি অবহিত হইয়া ইহা শ্রবণ কর, তাহা হইলেই তোমার শোকসন্তাপ নিবারণ হইবে। যে ব্যক্তি সেই মহানুভব ভূপালগণের মনোহর চরিত্র শ্রবণ করে, তাহার আয়ুবৃদ্ধি ও শুভগ্রহসঞ্চার হয়। অবিক্ষিততনয় মহারাজ মরুও অতি সৌভাগ্যশালী ছিলেন। ইন্দ্রাদি দেবগণ বৃহস্পতিসমভিব্যাহারে ঐ মহাত্মার যজ্ঞে সমাগত হইতেন। উনি স্পৰ্দ্ধাসহকারে দেবরাজকেও পরাজয় করিয়াছিলেন। সুরগুরু বৃহস্পতি ইন্দ্রের প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত ঐ মহাত্মার যজ্ঞক্রিয়া-সম্পাদনে অস্বীকার করাতে সুরাচার্য্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহর্ষি সংবৰ্ত্ত ঐ কাৰ্য্য নির্ব্বাহ করেন। উঁহার রাজ্যশাসনকালে পৃথিবী অনাকৃষ্ট হইয়াও শস্যশালিনী হইত। ঐ মহাত্মার যজ্ঞে বিশ্বদেবগণ সভাসদ এবং সাধ্য ও মরুদগণ পরিবেষ্টা হইয়াছিলেন। দেবগণ ঐ যজ্ঞে সোমরসপানে যারপরনাই তৃপ্তিলাভ করিয়াছিলেন। ঐ রাজা দেবতা, মনুষ্য ও গন্ধৰ্ব্বগণকে এত দক্ষিণা দান করিয়াছিলেন যে, তাঁহারা উহা বহন করিতে পারেন নাই। হে সৃঞ্জয়! সেই সমস্ত রাজা তোমার অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানী, বৈরাগ্যযুক্ত ও ঐশ্বর্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান ছিলেন। যখন তাঁহাকেও মৃত্যুগ্রস্ত হইতে হইয়াছে, তখন তুমি কেন পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
সুহোত্রাদি নৃপতি বৃত্তান্ত
“অতিথীর পুত্র মহারাজ সুহোত্রকেও কালগ্রাসে পতিত হইতে হইয়াছে। দেবরাজ ইন্দ্র ঐ মহাত্মার রাজ্যে এক বৎসর সুবর্ণ বর্ষণ করেন। বসুমতী ঐ রাজার অধিকারসময়ে যথার্থনামা হইয়াছিলেন। ঐ সময় নদী-সমুদয়ের প্রবাহে হিরণ্য প্রবাহিত হইত। লোকপূজিত দেবরাজ ঐ সকল নদীতে সুবর্ণময় কূৰ্ম্ম, কর্কটক, নক্র, মকর ও শিশুমার নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। মহারাজ সুহোত্র নদীতে সহস্র সহস্র, সুবর্ণময় মকর, মৎস্য ও কচ্ছপ প্রবাহিত হইতে দেখিয়া নিতান্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিলেন। তিনি পরিশেষে তৎসমুদয় গ্রহণ ও কুরুজাঙ্গলে সংস্থাপনপূর্ব্বক বিপুল যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া সমস্তই ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করেন। তিনি তোমার অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানী, বৈরাগ্যযুক্ত ও ঐশ্বৰ্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনিও প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন সেই অযাজ্ঞিক পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
“অঙ্গাধিপতি মহারাজ বৃহদ্রথও কালকবলে নিপতিত হইয়াছেন। ঐ মহাত্মা বিশাল যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া ব্রাহ্মণগণকে দশ লক্ষ শ্বেত অশ্ব, দশ লক্ষ সুবর্ণালঙ্কৃত কন্যা, দশ লক্ষ দ্বিগগজতুল্য মাতঙ্গ, এক কোটি হেমমালাবিভূষিত বৃষ ও সহস্র গাভী দক্ষিণা প্রদান করিয়াছিলেন। ঐ মহাত্মা বিষ্ণুপদনামা পৰ্ব্বতে যজ্ঞ আরম্ভ করিলে দেবরাজ সোমরস পান ও ব্রাহ্মণগণ দক্ষিণা গ্রহণ করিয়া মত্ত হইয়াছিলেন। ঐ রাজা ক্রমে ক্রমে এক শত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া দেবতা, মনুষ্য ও গন্ধৰ্ব্বগণকে এত দক্ষিণা প্রদান করিয়াছিলেন যে, তাঁহারা তাহা বহন করিতে পারেন নাই। অঙ্গ রাজ অগ্নিষ্টোম প্রভৃতি সাতটি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া যে ধন বিতরণ করিয়াছিলেন, তত ধন দান করিতে পারে, এমন পুরুষ অদ্যাপিও জন্মগ্রহণ করে নাই, করিবেও না। হে সৃঞ্জয়! সেই বৃহদ্রথ তোমার অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানী, বৈরাগ্যযুক্ত ও ঐশ্বর্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনিও প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
শিবি ও দুষ্মন্তপুত্র ভরতের বিবরণ
“উশীনরতনয় মহাত্মা শিবিকেও কালগ্রাসে নিপতিত হইতে হইয়াছে। ঐ মহাবীর একমাত্র রথে আরোহণ ও সমুদয় পৃথিবী পরিভ্রমণপূৰ্ব্বক ভূপালগণকে পরাজয় করেন। ঐ মহাত্মা যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া আপনার সমুদয় গো, অশ্ব ও অন্যান্য আরণ্য পশু প্রদান করিয়াছিলেন। প্রজাপতি উহাকে অদ্বিতীয় ধুরন্ধর বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন; ফলতঃ রাজমণ্ডলে অদ্যাপি শিবির ন্যায় গুণসম্পন্ন আর কেহই হয় নাই, হইবেও না। হে সৃঞ্জয়! সেই ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী শিবিরাজ তোমা অপেক্ষা বলবান, ধাৰ্ম্মিক, বিষয়বাসনাশূন্য ও ঐশ্বৰ্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনি কলিকবলে নিপতিত হইয়াছেন, তখন তুমি কেন সেই অযাজ্ঞিক পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
“বিপুল বিভবশালী শকুন্তলাগৰ্ভজাত দুষ্মন্তপুত্র মহাত্মা ভরতরাজাকেও মৃত্যুমুখে পতিত হইতে হইয়াছে। ঐ মহাত্মা দেবগণের উদ্দেশে যমুনাপুলিনে তিন শত, সরস্বতীতটে বিংশতি এবং গঙ্গাতীরে চতুর্দ্দশ অশ্ব বন্ধন করিয়া সহস্র অশ্বমেধ ও এক শত রাজসূয়-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তৎকালে কোন নরপতিই ভরতের ন্যায় কার্য্যানুষ্ঠানে সমর্থ হন নাই। ঐ মহাত্মা যজ্ঞবেদী বিস্তার ও তাহাতে অসংখ্য অশ্ব বন্ধন করিয়া যজ্ঞাবসানে মহর্ষি কণ্বকে পদ্ম সহস্র[এক-সহস্র পদ্মসংখ্যক] অশ্ব প্রদান করেন। হে সৃঞ্জয়! দুষ্মন্তপুত্র তোমা অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানবান, নিস্পৃহ ও ঐশ্বৰ্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনিও কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কি নিমিত্ত পুত্রের জন্য বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
দশরথতনয় রামচন্দ্রের বিবরণ
“দশরথতনয় রামচন্দ্রকে কলেবর পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। ঐ মহাত্মা নিয়ত অপত্যনির্ব্বিশেষে [পুত্রের ন্যায়] প্রজাগণকে প্রতিপালন করিতেন। তাঁহার রাজত্বসময়ে কোন কামিনীই বিধবা বা অনাথ ছিল না। জলদাবলী যথাকালে বারিবর্ষণ করাতে তাঁহার রাজ্যে প্রচুর শস্য সমুৎপন্ন হইত, কখনই দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয় নাই। অকালমৃত্যু, অগ্নিদাহ বা রোগভয়ের সম্পর্কও ছিল না; প্রজাগণ পুত্রগণে পরিবৃত হইয়া সহস্র বর্ষ পৰ্য্যন্ত সুস্থশরীরে জীবিত থাকিত। ঐ সময় সকলেই কৃতকর্ম্মা [কৰ্ম্মপটু করিতকর্ম্মা] ছিল। পুরুষদিগের পরস্পর বিবাদ হওয়া দূরে থাকুক, কামিনীগণের মধ্যেও কখনও কলহ উপস্থিত হইত না। প্রজাগণ সকলেই ধার্ম্মিক, সন্তুষ্টচিত্ত, নির্ভীক ও স্বেচ্ছাচারী ছিল। পাদপ-সকল নিয়মিত ফল-পুষ্পে সুশোভিত থাকিত। সকল গাভীরই কলস-পরিমিত দুগ্ধ হইত। মহাতপাঃ রামচন্দ্র চতুর্দ্দশ বৎসর অরণ্যে বাস ও অবাধে ত্রিগুণ দক্ষিণাযুক্ত দশ অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। ঐ মহাত্মা শ্যামাঙ্গ, লোহিতনেত্র, আজানুলম্বিতবাহু[জানু পর্য্যন্ত লম্বিত বাহুদীর্ঘবাহু], সিংহস্কন্ধ ও সুন্দর মুখশ্রীসম্পন্ন এবং মাতঙ্গতুল্য পরাক্রমশালী ছিলেন। তিনি অযোধ্যার অধিপতি হইয়া একাদশ সহস্র বৎসর রাজ্য প্রতিপালন করেন। ঐ মহাত্মা তোমা অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানবান, নিস্পৃহ ও ঐশ্বৰ্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনিও কালকবলে নিপতিত হইয়াছেন, তখন তুমি কি জন্য আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
ভগীরথ-দিলীপাদি নৃপতি বৃত্তান্ত
“রাজা ভগীরথকেও কলেবর পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার অতি বিস্তীর্ণ যজ্ঞে সোমরস পান করিয়া ভুজবলে অসংখ্য অসুরগণকে সংহার করিয়াছেন। সেই মহীপাল যজ্ঞানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক সুবর্ণালঙ্কৃত দশ লক্ষ কন্যা দক্ষিণ প্রদান করেন। ঐ কন্যাগণ প্রত্যেকে অশ্বচতুষ্টয়সংযোজিত রথে আরোহণ করিয়াছিল এবং প্রত্যেক রথের পশ্চাৎ সুবর্ণমালপরিশোভিত এক শত হস্তী, প্রত্যেক হস্তীর পশ্চাৎ সহস্র অশ্ব, প্রত্যেক অশ্বের পশ্চাৎ সহস্র গাভী ও প্রত্যেক গাভীর পশ্চাৎ সহস্র মেষ ও ছাগ গমন করিয়াছিল। পূৰ্ব্বে একদা রাজা ভগীরথ নির্জ্জনে উপবেশন করিলে, গঙ্গা তাঁহার উৎসঙ্গে উপবেশন করিয়াছিলেন। এই নিমিত্তই গঙ্গার নাম উর্বশী হইয়াছে। গঙ্গা ঐ রাজাকে পিতৃত্বে, অঙ্গীকার করিয়া অদ্যাবধি ভাগীরথী নামে অভিহিত হইতেছেন। হে সৃঞ্জয়! সেই মহাত্মা ভগীরথ তোমা অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানবান, ঐশ্বৰ্য্যশালী ও বিষয়বাসনাশূন্য এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনিও দেহত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
“মহাত্মা দিলীপকেও মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে হইয়াছে। ব্রাহ্মণগণ অদ্যাপি ঐ মহাত্মার বিচিত্র চরিত্রসমুদয় কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। ঐ মহাত্মা যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক ব্রাহ্মণদিগকে এই ধনরত্নপরিপূর্ণ বসুন্ধরা প্রদান করিয়াছিলেন। তাঁহার পুরোহিত প্রত্যেক যজ্ঞে সুবর্ণময় সহস্র হস্তী দক্ষিণ প্রাপ্ত হইতেন। ঐ মহাত্মার যজ্ঞে বিপুল কনকময় ঘূপ নিখাত [মৃত্তিকায় প্রোথিত—যজ্ঞান্তে ঘূপ মাটীতে পোতা] হইত। ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ তাঁহার সুবর্ণনিৰ্ম্মিত যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হইয়া সমস্ত যজ্ঞীয় কার্য্যানুষ্ঠান, গন্ধৰ্ব্বগণ নৃত্য ও গন্ধৰ্ব্বরাজ বিশ্বাবসু স্বয়ং উপস্থিত হইয়া সপ্তস্বর [ষড়ূজ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ] অনুসারে বীণাবাদন আরম্ভ করিলে সকলেই বিবেচনা করিত, যেন গন্ধৰ্ব্বরাজ আমারই সমক্ষে বীণাবাদন করিতেছেন। এ পর্য্যন্ত কোন ভূপালই সেই দিলীপের কাৰ্য্যকলাপের অনুকরণ করিতে সমর্থ হয়েন নাই। ঐ মহারাজের মত্তমাতঙ্গগণ সুবর্ণালঙ্কারে বিভূষিত হইয়া পথিমধ্যে শয়ান থাকিত। যাঁহারা সেই সত্যবাদী মহাত্মা দিলীপকে দৃষ্টিগোচর করিয়াছেন, তাঁহাদিগেরও স্বর্গলাভ হইয়াছে। ঐ মহাত্মার আবাসে বেদাধ্যয়নধ্বনি, জ্যানির্ঘোষ ও ‘দীয়তাং[দান কর]’ এই শব্দটি কদাচ বিলুপ্ত হয় নাই। হে সৃঞ্জয়! সেই প্রবল প্রতাপসম্পন্ন দিলীপ তোমা অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানী, ঐশ্বর্য্যশালী ও বিষয়বাসনাশূন্য এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনিও তনুত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
যযাতি মান্ধাতা নৃপতি বৃত্তান্ত
“যুবনাশ্বতনয় মান্ধাতাও কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন। ঐ মহাত্মা স্বীয় পিতা যুবনাশ্বের উদরমধ্যে দধিমিশ্রিত ধৃত হইতে উৎপন্ন হইলে দেবগণ যুবনাশ্বের পার্শ্বদেশ ভেদ করিয়া উহাকে নিষ্কাশিত করেন। ঐ দেবতুল্য রূপসম্পন্ন বালক পিতার উদর হইতে নিঃসৃত হইয়া তাঁহার ক্রোড়ে শয়ান হইলে দেবগণ তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া পরস্পর কহিতে লাগিলেন, এই বালক কি পান করিয়া জীবন ধারণ করিবে?’ দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহাদের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘এই বালক আমার অঙ্গুলি পান করিয়া জীবন ধারণ করিবে। আমি উহার নাম মান্ধাতা রাখিলাম।’ সুররাজ এই বলিয়া ঐ বালকের মুখে অঙ্গুলি প্রদান করিলে উহার দেহপুষ্টির নিমিত্ত ইন্দ্রের অঙ্গুলি হইতে দুগ্ধধারা নির্গত হইতে লাগিল। বালক সেই ইন্দ্রের অঙ্গুলিনিঃসৃত দুগ্ধ পান করিয়া এক দিবসের মধ্যেই বিলক্ষণ হৃষ্টপুষ্ট হইলেন। তিনি দ্বাদশ দিবসের মধ্যে দ্বাদশ বৎসর বয়ঃক্রমযুক্ত বালকের ন্যায় পরিবর্দ্ধিত হইয়া ছিলেন। ঐ ইন্দ্রতুল্য বলশালী মান্ধাতা এক দিবসেই সমগ্র পৃথিবী অধিকার করেন। ঐ মহাত্মা নৃপতি অঙ্গার, মরুত্ত, অসিত, গয়, অঙ্গ ও বৃহদ্রথকে সমরে পরাজিত করিয়াছিলেন। তিনি মহারাজ অঙ্গারের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে দেবগণ তাঁহার শরাসনের টঙ্কারশব্দ শ্রবণে বোধ করিয়াছিলেন যে, নভোমণ্ডল বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে। সূর্য্যের উদয়স্থান হইতে অস্তমিত হইবার স্থান পর্য্যন্ত সমুদয় প্রদেশই মান্ধাতার অধিকৃত। তিনি এক শত অশ্বমেধ ও শত রাজসূয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া ব্রাহ্মণগণকে দীর্ঘে দশ যোজন ও প্রস্থে এক যোজন সুবর্ণময় রোহিত-মৎস্য-সকল দান করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণগণকে দান করিয়া যে সমস্ত মৎস্য অবশিষ্ট ছিল, অন্যান্য লোকে তাহা বিভাগ করিয়া লয়। হে সৃঞ্জয়! সেই রাজা মান্ধাতা তোমা অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানবান্, ঐশ্বৰ্য্যশালী ও বিষয়বাসনাশূন্য এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা পুণ্যবান্ ছিলেন। তিনিও যখন লোকান্তরিত হইয়াছেন, তখন তুমি কেন আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
“নহুষাত্মজ মহারাজ যযাতিকেও কলেবর পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। ঐ মহাত্মা এক স্থানে দণ্ডায়মান হইয়া বলপূৰ্ব্বক যুগকীলক [যোয়ালির খিল] নিক্ষেপ করিতেন। সেই নিক্ষিপ্ত কীলক যত দূরে নিপতিত হইত, তিনি স্বীয় অবস্থান স্থান হইতে তত দূর পর্য্যন্ত এক একটি যজ্ঞবেদী নির্ম্মাণ করাইতেন। ঐরূপ কীলকনিক্ষেপকে শম্যাপাত কহে। মহাত্মা যযাতি ঐরূপে শম্যাপিত সহকারে বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে করিতে সমুদ্র পর্য্যন্ত গমন করিয়াছিলেন। তিনি এক সহস্র প্রধান যজ্ঞ ও এক শত বাজপেয়যজ্ঞের । অনুষ্ঠানপূর্ব্বক সুবর্ণপর্ব্বত[সুবর্ণ দ্বারা নির্ম্মিত পর্ব্বত] দান করিয়া ব্রাহ্মণগণকে পরিতৃপ্ত করেন। ঐ মহাত্মা অসুরগণকে সংগ্রামে নিহত করিয়া পরিশেষে যদু, দ্রুহ্য প্রভৃতি স্বীয় তনয়গণকে অংশক্রমে সমুদয় পৃথিবী প্রদান এবং পুরুকে স্বীয় রাজ্যে অভিষেকপূৰ্ব্বক সহধর্ম্মিণী সমভিব্যাহারে বনে প্রস্থান করেন। হে সৃঞ্জয়! সেই মহাত্মা যযাতি তোমা অপেক্ষা ধর্ম্মশীল, জ্ঞানবান, বিষয়বাসনাশূন্য ও ঐশ্বৰ্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনি কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
অম্বরীষপ্রমুখ নৃপতি বিবরণ
“মহারাজ নাভাগতনয় অম্বরীষকেও কলেবর পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। ঐ মহাত্মার প্রজাগণ উহার প্রতি নিতান্ত অনুরক্ত ছিল। ঐ মহাত্মা স্বীয় যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া দশ লক্ষ যাজ্ঞিক ভূপতিকে দ্বিজগণের দাস্যকার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। অদ্যাপি কোন ব্যক্তিই অম্বরীষের ন্যায় কার্য্যানুষ্ঠান করিতে পারেন নাই এবং পরেও কেহ পারিবেন না। যে সকল ভূপতি যজ্ঞকালে ব্রাহ্মণদিগের দাসত্ব করিয়াছিলেন, মহাত্মা অম্বরীষ তাঁহাদিগকে দক্ষিণস্বরূপ ব্রাহ্মণহস্তে সমর্পণ করেন। হে সৃঞ্জয়! সেই মহাত্মা নাভাগতনয় তোমা অপেক্ষা ধৰ্ম্মশীল, জ্ঞানবান, বিষয়বাসনাশূন্য ও ঐশ্বর্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন সেই মহাত্মাও দেহত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন আর গুণবিহীন পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
‘মহারাজ শশবিন্দুকে দেহত্যাগ করিতে হইয়াছে। ঐ মহাত্মার এক লক্ষ মহিষী ও দশ লক্ষ পুত্র ছিল। রাজকুমারগণ সকলেই সুবৰ্ণবর্মধারী ও ধনুর্ব্বিদ্যায় সুশিক্ষিত ছিলেন। উঁহারা প্রত্যেকে এক এক শত কন্যা বিবাহ করেন। ঐ কন্যাগণের প্রত্যেকের পশ্চাৎ এক এক শত হস্তী, প্রতি হস্তীর পশ্চাৎ এক এক শত রথ, প্রতি রথের পশ্চাৎ হেমমালাবিভূষিত এক এক শত অশ্ব, প্রতি অশ্বের পশ্চাৎ এক এক শত বেগবান্ গাভী, প্রতি গাভীর পশ্চাৎ এক এক শত মেষ ও ছাগ আগমন করিয়াছিল। মহারাজ শশবিন্দু অশ্বমেধযজ্ঞে সেই অপরিমিত ঐশ্বৰ্য্য ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করেন। হে সৃঞ্জয়! মহারাজ শশবিন্দু তোমা অপেক্ষা জ্ঞানবান, ধৰ্ম্মশীল, বিষয়বাসনাশূন্য ও ঐশ্বর্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন সেই মহাত্মারও মৃত্যু হইয়াছে, তখন তুমি কেন আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা শোক করিতেছ?
“অমূৰ্ত্তররার পুত্র মহারাজ গয়কেও কলেবর পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। ঐ ভূপাল শত বর্ষ হুতাবশিষ্ট ভোজন করিয়াছিলেন। হুতাশন প্রীত হইয়া তাঁহাকে বর প্রদান করিতে সমুদ্যত হইলে তিনি কহিয়াছিলেন, ভগবন্! আপনার প্রসাদে আমার যেন ধৰ্ম্মে শ্রদ্ধা ও সত্যে অনুরাগ পরিবর্দ্ধিত হয় এবং আমি অনবরত দান করিলেও যেন আমার ধনক্ষয় না হয়। ভগবান্ হুতাশন গয়রাজের প্রার্থনা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে অভিলষিত বর প্রদান করিয়াছিলেন। মহাত্মা গয় সহস্র বৎসর অনবরত দশপৌৰ্ণমাস, চাতুর্ম্মাস্য ও অশ্বমেধ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া দ্বিজগণকে বারংবার এক লক্ষ গাভী ও শত অশ্বতর প্রদান করেন। ঐ মহাত্মা সোমরস দ্বারা দেবগণের, ধন দ্বারা দ্বিজগণের, স্বধা দ্বারা পিতৃগণের এবং অভিষ্টসাধন দ্বারা নারীগণের তৃপ্তি সাধন করিয়াছিলেন। ঐ মহাত্মা অশ্বমেধ-যজ্ঞে দীর্ঘে বিংশতি ব্যাম [বিস্তারিত বাহুদ্বয়ের এক বাহুর অঙ্গুলির অগ্রভাগ বাহুর অঙ্গুলির অগ্রভাগ পর্য্যন্ত দীর্ঘ পরিমাণ বাঁও] ও প্রস্থে দশ ব্যাম সুবর্ণময় পৃথিবী ব্রাহ্মণগণকে দক্ষিণা দান করেন। গঙ্গায় যতগুলি বালুকা আছে, মহাত্মা গয় বিপ্রদিগকে ততগুলি গাভী প্রদান করিয়াছিলেন। হে সৃঞ্জয়! ঐ মহাত্মা তোমা অপেক্ষা জ্ঞানবান, ধর্ম্মপরায়ণ, বিষয়বাসনাশূন্য ও ঐশ্বৰ্য্যশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনিও প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
রন্তিদেব-সগরাদি নৃপতি বৃত্তান্ত
“হে সৃঞ্জয়! সঙ্কৃতিনন্দন রন্তিদেবকেও কলেবর পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। ঐ মহাত্মা ঘোরতর তপানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক সুররাজ ইন্দ্রের আরাধনা করিয়া তাঁহার নিকট এইরূপ বর প্রার্থনা করিয়াছিলেন যে, হে দেবরাজ! আপনার প্রসাদে যেন আমার গৃহে প্রচুর অন্ন ও অতিথির সমাগম হয়। আমার শ্রদ্ধা যেন কদাচ অপনীত না হয় এবং আমি যেন কদাচ কাহারও নিকট প্রার্থনা না করি। ঐ মহাত্মার ক্রিয়ানুষ্ঠানকালে গ্রাম্য ও আরণ্যক পশু-সকল স্বয়ং তাঁহার নিকট সমুপস্থিত হইয়া আমাকে পিতৃকাৰ্য্যে নিয়োগ করুন’ বলিয়া উপাসনা করিত। উঁহার যজ্ঞনিহত পশুগণের চৰ্ম্মরাশি হইতে ক্লেদ নির্গত হওয়াতে এক নদী উৎপন্ন হইয়াছে। ঐ মহানদী তন্নিবন্ধন অদ্যাপি চৰ্ম্মবতী নামে প্রখ্যাত আছে। মহাত্মা রন্তিদেব অতি বিস্তীর্ণ সভামধ্যে ব্রাহ্মণগণকে নিষ্ক [সুবর্ণ পরিমাণ—৯ তোলা সোণায় ১ নিষ্ক] প্রদান করিতেন। সভামধ্যে তোমাকে শত নিষ্ক প্রদান করা যাইতেছে, ‘গ্রহণ কর’ এই কথা বলিলে কোন ব্রাহ্মণই তাহা গ্রহণ করিতেন না। পরে, ‘তোমাকে সহস্র নিষ্ক প্রদান করা যাইতেছে, গ্রহণ কর’, এই কথা বলিলে তত্রস্থ সকল ব্রাহ্মণই উহা গ্রহণ করিতেন। মহাত্মা রন্তিদেবের গৃহে অন্ন ও অন্যান্য দ্রব্যের আহরণোপযোগী পাত্র, ঘট, কটাহ[কড়া], স্থালী[থালা] ও পিঠর[হাঁড়ী] প্রভৃতি সমুদয় দ্রব্যই সুবর্ণময় ছিল। অতিথিরা রন্তিদেবের গৃহে যে রাত্রি বাস করিত, সেই রাত্রিতে তথায় বিংশতি সহস্র এক শত গো ছেদন করা হইত। তথাপি মণিকুণ্ডলধারী পাচকেরা ‘অদ্য সূপভূয়িষ্ঠ [ব্যঞ্জনবহুল] অন্ন ভক্ষণ কর, পূৰ্ব্ববৎ মাংস ভোজন করিতে পাইবে না’ বলিয়া চীৎকার করিত। হে সঞ্জয়! সেই মহারাজ রন্তিদেব তোমা অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানবান্, ঐশ্বর্য্যশালী ও বৈরাগ্যযুক্ত এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান ছিলেন। যখন তিনিও দেহত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
“ইক্ষাকুবংশীয় অলৌকিক পরাক্রমশালী মহাত্মা সগরকেও কলেবর পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। শরৎকালীন মেঘনির্ম্মুক্ত নভোমণ্ডলে জ্যোতিঃপদার্থ সমুদয় যেমন চন্দ্রের অনুগমন করিয়া থাকে, তদ্রূপ সগররাজের গমনকালে ঐ মহাত্মার ষষ্টি সহস্র পুত্র অনুগমন করিত। তিনি প্রতিনিয়ত পদ্মপলাশাক্ষী [পদ্মপত্রবৎ বিস্তৃত] রমণীগণে পরিপূর্ণ, মহাৰ্হ শয্যাসমাকুল, সুবর্ণসুশোভিত, কাঞ্চনময় প্রাসাদ ও অন্যান্য দ্রব্যজাত ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করিতেন। ঐ পরাক্রমশালী ভূপতি ক্রোধভরে পৃথিবী খননপূৰ্ব্বক সমুদ্র প্রস্তুত করিয়াছিলেন। উহার নামানুসারে সমুদ্র ‘সাগর’ নামে বিখ্যাত হইয়াছে। হে সৃঞ্জয়! মহাত্মা সগর তোমা অপেক্ষা ধর্ম্মপরায়ণ, জ্ঞানবান্, ঐশ্বৰ্য্যশালী ও বিষয়বাসনাশূন্য এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান ছিলেন। যখন তিনিও দেহত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ?
পৃথুরাজ বৃত্তান্ত
“বেণনন্দন মহাত্মা পৃথুরাজকেও কলেবর পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে; মহর্ষিগণ একত্র সমবেত হইয়া ঐ মহাত্মাকে দণ্ডকারণ্যে অভিষেক করিয়াছিলেন। তিনি সমুদয় লোক প্রথিত করিবেন বলিয়াই পৃথু নাম ধারণ করেন। তিনি ক্ষত বা বিনাশ হইতে লোক-সকলকে পরিত্রাণ করিতেন বলিয়া ক্ষত্রিয় হইয়াছিলেন। প্রজারা তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার প্রতি অতিশয় অনুরক্ত হইয়াছিল বলিয়াই তিনি রাজপদবী প্রাপ্ত হয়েন। তাঁহার রাজ্যশাসনকালে ভূমি হলদ্বারা কর্ষিত না হইয়াও প্রচুর ফলপুষ্প প্রসব করিত। প্রতি পত্রেই মধু উৎপন্ন এবং ধেনু দোহন করিবামাত্র দুগ্ধে কলস পরিপূর্ণ হইত। মনুষ্যেরা নীরোগ, নির্ভয়, পূর্ণকাম হইয়া স্বেচ্ছানুসারে ক্ষেত্র ও গৃহে বাস করিত। পৃথুরাজ সমুদ্রযাত্রা করিলে সাগরের জল স্তব্ধ হইয়া থাকিত এবং তিনি নদীতে গমন করিলে নদীসকল সমুচ্ছ্রিত না হইয়া স্থিরভাব অবলম্বন করিত। কুত্রাপি ঐ মহাত্মার আজ্ঞাভঙ্গ হইত না। তিনি অশ্বমেধ-যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে তিন নল[১নলে ৫ হাত] উন্নত সুবর্ণময় একবিংশতি পর্ব্বত প্রদান করিয়াছিলেন। হে সৃঞ্জয়! সেই মহারাজ পৃথু তোমা অপেক্ষা ধার্ম্মিক, জ্ঞানবান, ঐশ্বৰ্য্যশালী ও বিষয়বাসনাশূন্য এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান্ ছিলেন। যখন তিনিও তনুত্যাগ করিয়াছেন, তখন তুমি কেন আর পুত্রের নিমিত্ত বৃথা অনুতাপ করিতেছ? এক্ষণে আর মৌনভাব অবলম্বনপূৰ্ব্বক চিন্তা করিও না। আমার কথা কি তোমার কর্ণগোচর হইল না? আমি যাহা কহিলাম, উহা মুমূর্ষু ব্যক্তির হিতকর ঔষধের ন্যায় সম্যক্ ফলোপধায়ক সন্দেহ নাই।
“তখন মহাত্মা সৃঞ্জয় নারদের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধন-পূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! আমি শোকাপনোদনার্থ পুণ্যশীল কীৰ্ত্তিসম্পন্ন রাজর্ষিগণের অতি বিচিত্র কাহিনীসকল শ্রবণ করিলাম। আপনি যে সকল কথা কহিলেন, তৎসমুদয় কোনওক্রমেই নিষ্ফল হইবার নহে। অধিক কি কহিব, আপনার দর্শনমাত্রেই আমি শোকশূন্য হইয়াছি। অমৃত পান করিলে যেমন তৃপ্তিলাভ না হইয়া প্রত্যুত পিপাসা পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকে, তদ্রূপ আপনার বাক্যশ্রবণে আমার শ্রবণেচ্ছা পরিবর্দ্ধিত হইয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে আমি পুত্রশোকে একান্ত কাতর হইয়াছি। যদি আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে অদ্য আমার পুত্র যাহাতে পুনরুজ্জীবিত হয় তাহার উপায় করুন। তখন নারদ কহিলেন, “হে সৃঞ্জয়! তোমার পুত্র স্বর্ণষ্ঠীবী [স্বর্ণনিষ্ঠীবনকারী—যাঁহার থুথু নিক্ষেপমাত্র সুবর্ণে পরিণত হয়] মহর্ষি পৰ্ব্বতের বরপ্রভাবে জন্মগ্রহণ করিয়া অকালে কালকবলে নিপতিত হইয়াছে। এক্ষণে আমি উহাকে পুনর্জ্জীবিত করিতেছি। অতঃপর তোমার পুত্র সহস্র সহস্র বৎসর জীবিত থাকিবে।”