২৮তম অধ্যায়
কৃষ্ণকর্ত্তৃক যুধিষ্ঠিরের কর্ত্তব্যের ইঙ্গিত
বাসুদেব কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি নিরন্তর পাণ্ডবগণের অবিনাশ সমৃদ্ধি ও হিত সপুত্র রাজা ধৃতরাষ্ট্রের অভ্যুদয় বাসনা করিয়া থাকি। কৌরব ও পাণ্ডবদিগের পরস্পর সন্ধিসংস্থাপন হয়, ইহা আমার অভিপ্রেত, আমি উহাদিগকে ইহা ব্যতীত আর কোন পরামর্শ প্ৰদান করি না। অন্যান্য পাণ্ডবগণসমক্ষে রাজা যুধিষ্ঠিরের মুখেও অনেকবার সন্ধিসংস্থাপনের কথা শুনিয়াছি, কিন্তু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁহার পুত্ৰগণ সাতিশয় অর্থলোভী; পাণ্ডবগণের সহিত তাঁহার সন্ধিসংস্থাপন হওয়া নিতান্ত দুষ্কর; সুতরাং বিবাদ যে ক্রমশঃ পরিবৰ্দ্ধিত হইবে, তাহার আশ্চৰ্য্য কি? হে সঞ্জয়! ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠির ও আমি কদাচ ধর্ম্ম হইতে বিচলিত হই নাই, ইহা জানিয়া শুনিয়াও তুমি কি নিমিত্ত স্বকৰ্মসাধনোদ্যত, উৎসাহসম্পন্ন, স্বজনপরিপালক, রাজা যুধিষ্ঠিরকে অধাৰ্মিক বলিয়া নির্দ্দেশ করিলে?
“শুচি ও কুটুম্বাপরিপালক হইয়া বেদাধ্যয়নপূর্ব্বক জীবনযাপন করিবে, এইরূপ শাস্ত্ৰনির্দ্দিষ্ট বিধি বিদ্যমান থাকিলেও ব্রাহ্মণগণের নানাপ্রকার বুদ্ধি জন্মিয়া থাকে। কেহ কর্ম্মবশতঃ, কেহ বা কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া, একমাত্ৰ বেদজ্ঞানদ্বারা মোক্ষলাভ হয়, এইরূপ স্বীকার করিয়া থাকেন; কিন্তু যেমন ভোজন না করিলে তৃপ্তিলাভ হয় না, তদ্রূপ কর্ম্মানুষ্ঠান না করিলে কেবল বেদজ্ঞ হইলে ব্রাহ্মণগণের কদাচ মোক্ষলাভ হয় না। যে সমস্ত বিদ্যাদ্ধারা কর্ম্মসংসাধন হইয়া থাকে, তাহাই ফলবতী; যাহাতে কোনো কর্ম্মানুষ্ঠানের বিধি নাই, সে বিদ্যা নিতান্ত নিস্ফল; অতএব যেমন পিপাসার্ত্ত ব্যক্তির জলপান করিবামাত্র পিপাসাশান্তি হয়, তদ্রূপ ইহকালে যেসকল কর্মের ফল প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে, তাহারই অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য। হে সঞ্জয়! কর্ম্মবশতঃই এইরূপ বিধি বিহিত হইয়াছে, সুতরাং কৰ্মই সর্ব্বপ্রধান। যে ব্যক্তি কর্ম্ম অপেক্ষা অন্য কোন বিষয়কে উৎকৃষ্ট বিবেচনা করিয়া থাকে, তাহার সমস্ত কমই নিষ্ফল হয়।
“দেখ, দেবগণ কর্ম্মবলে প্রভাবসম্পন্ন হইয়াছেন, সমীরণ কর্ম্মবলে সতত সঞ্চরণ করিতেছেন, দিবাকর কর্ম্মবলে আলস্যশূন্য হইয়া অহোরাত্র পরিভ্রমণ করিতেছেন, চন্দ্ৰমা কর্ম্মবলে নক্ষত্রমণ্ডলিপরিবৃত্ত হইয়া মাসার্দ্ধ উদিত হইতেছেন, হুতাশন কর্ম্মবলে প্ৰজাগণের কর্ম্মসংসাধন করিয়া নিরবচ্ছিন্ন উত্তাপ প্ৰদান করিতেছেন, পৃথিবী কর্ম্মবলে নিতান্ত দুর্ভর ভার অনায়াসেই বহন করিতেছেন। শ্রোতস্বতীসকল কর্ম্মবলে প্রাণিগণের তৃপ্তিসাধন করিয়া সলিলরাশি ধারণ করিতেছে। অমিতবলশালী দেবরাজ ইন্দ্র দেবগণের মধ্যে প্রাধান্য লাভ করিবার নিমিত্ত ব্ৰহ্মচর্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তিনি সেই কৰ্মবলে দশদিক ও নভোমণ্ডল প্ৰতিধ্বনিত করিয়া বারিবর্ষণ করিয়া থাকেন এবং অপ্ৰমত্তচিত্তে ভৌগভিলাষ বিসর্জ্জন ও প্রিয়বস্তুসমুদয় পরিত্যাগ করিয়া শ্রেষ্ঠত্ব লাভ এবং দম, ক্ষমা, সমতা, সত্য ও ধর্ম্ম প্রতিপালনপূর্ব্বক দেবরাজ্য অধিকার করিয়াছেন। ভগবান্ বৃহস্পতি সমাহিত হইয়া ইন্দ্ৰিয়নিরোধপূর্ব্বক ব্ৰহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, এই নিমিত্তই তিনি দেবগণের আচাৰ্য্যপদ প্রাপ্ত হইয়াছেন; রুদ্র, আদিত্য, যম, কুবের, গন্ধৰ্ব, যক্ষ, অপ্সর, বিশ্বাবসু নক্ষত্রগণ কর্ম্মপ্রভাবে বিরাজিত রহিয়াছেন, মহর্ষিগণ ব্রহ্মবিদ্যা, ব্ৰহ্মচৰ্য্য ও অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের অনুষ্ঠান করিয়া শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিয়াছেন।
ধৃতরাষ্ট্রনিকটে সঞ্জয়ের বক্তব্য নির্দ্দেশ
“হে সঞ্জয়! তুমি কি নিমিত্ত ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য প্রভৃতি সকল লোকের ধর্ম্ম সবিশেষ জ্ঞাত হইয়াও কৌরবগণের হিতসাধন-মানসে পাণ্ডবদিগের নিগ্রহচেষ্টা করিতেছি? ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠির বেদজ্ঞ, অশ্বমেধ ও রাজসূয়-যজ্ঞের অনুষ্ঠানকর্ত্তা, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী এবং হস্তি-অশ্বরথচালনে সুনিপুণ। এক্ষণে পাণ্ডবেরা যদি কৌরবগণের প্রাণহিংসা না করিয়া, ভীমসেনকে সান্ত্বনা করিয়া রাজ্যলাভের অন্য কোন উপায় অবধারণা করিতে পারেন তাহা হইলে ধর্ম্মরক্ষা ও পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান হয়; অথবা ইহারা যদি ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্ম প্রতিপালনপূর্ব্বক স্বকৰ্মসংসাধন করিয়া দূরদৃষ্টবশতঃ মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়েন, তাহাও প্রশস্ত। বোধহয়, তুমি সন্ধিসংস্থাপন শ্ৰেয়ঃসাধন বিবেচনা করিতেছ, কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ক্ষত্রিয়দিগের যুদ্ধে ধর্ম্মরক্ষা হয় কি যুদ্ধ না করিলে ধৰ্মরক্ষা হয়? ইহার মধ্যে যাহা শ্রেষ্ঠ বলিয়া বিবেচনা করিবে, আমি তাঁহারই অনুষ্ঠান করিব।
“তুমি বর্ণচতুষ্টয়ের বিভাগ, স্বীয় কর্ম্ম ও পাণ্ডবগণের কাৰ্য্য পৰ্য্যালোচনা করিয়া স্বেচ্ছানুসারে নিন্দা বা প্রশংসা কর। ব্রাহ্মণ অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন, যাজন, দান, পরিচিত ব্যক্তি হইতে প্রতিগ্রহ ও তীর্থপর্য্যটন করিবেন। ক্ষত্ৰিয় ধর্ম্মানুসারে প্রজাপালন, দান, যজ্ঞ ও সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করিয়া দারপরিগ্রহপূর্ব্বক গৃহে বাস করিবেন। বৈশ্য কৃষি, গোরক্ষণ ও বাণিজ্যদ্বারা বিত্তোপার্জ্জন এবং সাবধানে তাহার রক্ষণাবেক্ষণপূর্ব্বক গৃহে বাস করিবেন; ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয়ের প্রিয়ানুষ্ঠান এবং পরিচর্য্যাই তাহার কর্ত্তব্য কর্ম্ম; বেদাধ্যয়ন ও যজ্ঞানুষ্ঠান করা তাহার পক্ষে নিতান্ত নিষিদ্ধ। শূদ্র শ্রেয়োলাভের নিমিত্ত আলস্যশূন্য ও নিত্য অভ্যুদয় [উন্নতি] সম্পন্ন হইবে, ইহাই তাহাদিগের পরম্পরাগত সনাতন ধর্ম্ম।
“রাজা অপ্ৰমত্তচিত্তে ইহাদিগের প্রতিপালনপূর্ব্বক স্ব স্ব ধর্মে নিয়োগ করিবেন, প্ৰজাগণের প্রতি সমদৰ্শী হইবেন, এবং পাপসঙ্কল্পে কদাচ অনুরক্ত হইবেন না। এইরূপে রাজার নিকট হইতে জ্ঞানতঃ ও ধর্ম্মতঃ মঙ্গললাভের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। রাজা যুধিষ্ঠির এই সমস্ত গুণগ্রামে অলঙ্কৃত, তাহাতে অধর্মের লেশমাত্ৰও নাই; সুতরাং তিনিই ধর্ম্মতঃ রাজ্যের অধিকারী। নৃশংস ব্যক্তি দূরদৃষ্টবশতঃ সৈন্যসংগ্ৰহ করিয়া পরস্বগ্রহণে উদ্যত হইয়া থাকে, তাহাতেই যুদ্ধের সৃষ্টি ও অস্ত্রশস্ত্রের সৃষ্টি হইয়াছে।
“দেবরাজ ইন্দ্র দসু্যদলসংহারার্থ ধনু ও বর্ম্ম প্রস্তুত করিয়াছেন; অতএব তাহাতে দস্যুবধ করিলেই পুণ্যলাভ হইয়া থাকে। অধৰ্মপরায়ণ কৌরবগণ যে দুরপনেয় [দুর্মোচ্য-যাহা সহজে লোপ করা যায় না] দোষানুষ্ঠান করিয়াছেন, তাহা নিতান্ত নিন্দনীয়; রাজা দুৰ্য্যোধনও চিরন্তন রাজধর্ম্ম অতিক্রম করিয়া অকস্মাৎ পাণ্ডবগণের পৈতৃকরাজ্য অপহরণ করিয়াছেন এবং অন্যান্য কৌরবগণও তাহার অনুসরণ করিয়া থাকেন। তস্কর দৃশ্য বা অদৃশ্য হইয়া হঠাৎ যে পরস্ব অপহরণ করে, তাহার ঐ উভয় ভাবই নিন্দনীয়। সুতরাং দুৰ্য্যোধনের কাৰ্য্যও একপ্রকার তস্করকাৰ্য্য বলিয়া প্ৰতিপন্ন করা যাইতে পারে; তিনি ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া ইহা প্রকৃত ধর্ম্ম বলিয়া বিবেচনা করিতেছেন, কিন্তু তাহা অন্যায়; পাণ্ডবগণের ন্যাস্ত সমস্ত রাজ্যসম্পত্তি কি নিমিত্ত অন্যে গ্ৰহণ করিবে? এই বিষয়ের নিমিত্ত যুদ্ধ করিয়া যদি প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিতে হয়, তাহাও শ্লাঘনীয়; তথাপি পৈতৃক-রাজ্যের পুনরুদ্ধারণে বিমুখ হওয়া কোনক্রমে উচিত নহে। হে সঞ্জয়! তুমি সভামধ্যে কৌরবদিগকে বারংবার এই প্রাচীন ধর্মের উপদেশ প্রদান করিবে। দেখ, কৌরবগণের কি অত্যাচার! তাহারা কতকগুলি ভূপালকে মৃত্যুমুখে নিক্ষেপ করিবার নিমিত্ত আনয়ন করিয়াছে এবং ভীষ্মপ্রভৃতি সকলেই রজঃস্বলা পাণ্ডবপ্রণয়িণী দ্রুপদনন্দিনীকে সভামধ্যে বাস্পাকুলালোচনে রোদন করিতে দেখিয়াও তৎকালে উপেক্ষা করিয়াছিলেন, ইহা তাঁহাদিগের পক্ষে নিতান্ত অন্যায্য ও গর্হিত হইয়াছে। তাঁহারা যদি আবালবৃদ্ধের সহিত সমবেত হইয়া এই অত্যাচার নিবারণ করিতেন, তাহা হইলে আমার ও ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের একান্ত প্রিয়ানুষ্ঠান হইত। দুরাত্মা দুঃশাসন যৎকালে সভামধ্যে শ্বশুরগণসমক্ষে দ্রৌপদীকে আনয়ন করিয়াছিল, তখন তিনি বারংবার বিলাপ ও অশ্রু পরিত্যাগ করিলেও বিদুর ব্যতিরেকে আর কাহারও আশ্রয় প্রাপ্ত হয়েন নাই। যখন দীনতাবশতঃ সভাস্থ ভূপালগণের বাক্যস্ফুর্ত্তি হইল না, তখন কেবল বিদুরই ধর্ম্মবুদ্ধিপরতন্ত্র হইয়া সেই দুৰ্মতি দুঃশাসনকে ধর্ম্ম ও অর্থের সবিশেষ উপদেশ প্ৰদান করিয়াছিলেন।
“হে সঞ্জয়! তুমি এক্ষণে রাজা যুধিষ্ঠিরকে ধর্মোপদেশ প্রদান করিতে অভিলাষী হইয়াছ; কিন্তু তৎকালে সভামধ্যে দুঃশাসনকে ধর্মোপদেশ প্রদান কর নাই। কৃষ্ণা সমুপস্থিত হইয়া ধর্মোপদেশ প্রদানপূর্ব্বক আপনাকে ও পাণ্ডবগণকে দুস্তর দুঃখসাগর হইতে উদ্ধার করিয়াছেন। সেই সভায় সূতপুত্র শ্বশুরগণসন্নিধানে দ্ৰৌপদীকে কহিয়াছিল, “হে যাজ্ঞসেনি! তোমার গত্যন্তর নাই; তুমি এক্ষণে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের ভবনে দাসীভাব অবলম্বন কর। পাণ্ডবগণ পরাজিত হইয়াছেন, তাঁহারা আর তোমার ভর্ত্তা নহেন, তুমি এক্ষণে অন্য পতিকে বরণ কর।” মর্মোপঘাতী [হৃদয়বিদারক] অতি কঠোর কর্ণের বাঙ্ময় শর মহাবীর অর্জ্জুনের হৃদয়গ্ৰন্থি ছেদন করিয়া আপনি জাগরকে রহিয়াছে। যখন পাণ্ডবগণ বনে গমন করিবার নিমিত্ত কৃষ্ণাজিন পরিধান করেন, তখন দুঃশাসন কহিয়াছিল, “এই সকল ষণ্ডতিল [সারশূন্য তিল—তিলের খোসা] বিনষ্টপ্ৰায় হইয়া অতি দীর্ঘকালের নিমিত্ত নরকে গমন করিল।” গান্ধাররাজ শকুনি দূতক্রীড়াকালে ছলপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজকে কহিয়াছিল,“হে ধর্ম্মরাজ! নকুল পরাজিত হইয়াছে, তোমার আর কিছুই নাই; এখন দ্ৰৌপদীকে পণ রাখিয়া ক্রীড়া কর।” হে সঞ্জয়! দূতক্ৰীড়াকালে কৌরবগণ যেসকল গৰ্হিত বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিল, তাহা তোমার অবিদিত নাই। এক্ষণে আমি এই বিপদ্বহ [বিপদ-আনয়নকর] কাৰ্য্য করিবার নিমিত্ত হস্তিনানগরে গমন করিব, কিন্তু যাহাতে পাণ্ডবগণের অর্থহানি না হয় এবং কৌরবেরাও সন্ধিসংস্থাপনে সম্মত হয়েন, এক্ষণে তদ্বিষয়ে যত্ন করিতে হইবে। তাহা হইলে সুমহৎ পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান হয় এবং কৌরবগণ মৃত্যুপাশ হইতে বিমুক্ত হইতে পারেন।
“আমি যখন নীতিসঙ্গত ধর্ম্মাৰ্থযুক্ত উপদেশ প্রদান করিব, তখন ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ আমাকে সমাদর ও অর্চ্চনা করিবেন, ইহার অন্যথা হইলে সেই সমস্ত উদ্ধত পাপাত্মা ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা স্ব স্ব কর্ম্মদোষে মহারথ অর্জ্জুন ও ভীমসেনের শরহুতাশনে নিঃসন্দেহ দগ্ধ হইবে। দুৰ্য্যোধন দূতাবসানে পাণ্ডবগণকে সম্পদবিহীন বলিয়া উপহাস করিয়াছিল। কিন্তু সময় উপস্থিত হইলে অপ্ৰমত্ত গদাধারী সেই ভীমসেন তাঁহাকে এই কথা স্মরণ করাইবেন;- দুৰ্য্যোধন মন্যুময় মহাবৃক্ষ, কৰ্ণ তাহার স্কন্ধ, শকুনি শাখাস্বরূপ, দুঃশাসন পুষ্প ও ফল এবং আমনীষী ধৃতরাষ্ট্র তাহার মূল। রাজা যুধিষ্ঠির ধর্ম্মময় মহাবৃক্ষ, অর্জ্জুন তাহার স্কন্ধ, ভীমসেন শাখাস্বরূপ, মাদ্রীতনয় নকুল ও সহদেব পুষ্প ও ফল, আমি, বেদ ও ব্রাহ্মণ তাহার মূল। রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও তাহার পুত্ৰগণ মহারণ্যস্বরূপ, পাণ্ডবেরা সেই মহারণ্যে ব্যাঘ্র, অতএব সেই মহারণ্যের উচ্ছেদ ও ব্যাঘ্রসকলকে বিনষ্ট করিও না, আশ্রয়ীভূত বন উচ্ছিন্ন হইলে ব্যাঘ্র নিহত হয় এবং ব্যাঘ্র না থাকিলে বনও উচ্ছিন্ন হইয়া থাকে; অতএব ব্যাঘ্র বনরক্ষা ও বন ব্যাঘ্রকে রক্ষা করিবে [১] । ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ লতাতুল্য; পাণ্ডবগণ শালসদৃশ; সুতরাং
১। “দুৰ্য্যোধনো মনুমেয়ঃ” ইত্যাদি শ্লোকদ্বয়ে দুইটি বৃক্ষকে রূপক করিয়া সংক্ষেপে সারগর্ভ বাক্যে মহাভারতের তাৎপৰ্য্য সূত্রাকারে একবার আদিপর্ব্বে অনুক্ৰমণিকাধ্যায়ে প্রদর্শিত হইয়াছে।
এই রূপকদ্বয়ের প্রথমটির প্রতিপাদ্য দুৰ্য্যোধন। দুৰ্য্যোধন ক্রোধরূপ মহাবৃক্ষ, ক্ৰোধের নিত্য সহচরী দ্বেষ-ঈর্ষা-অসূয়াদি দ্বারা উহা নিত্য পুষ্ট; এই ক্ৰোধারূপ মহাতরুর সহিত মিলিত হইয়াছে স্কন্ধরূপে কৰ্ণ, শাখাররূপে শকুনি, পুষ্প ও ফলরূপে দুঃশাসন; উহার মূল অমনীষী অর্থাৎ মনঃসংযমে অসমর্থ-অস্থিরমতি ধৃতরাষ্ট্র। তিনি পুত্ৰবৎসল্যে ক্রমশঃ অবসর দিয়া ঐ দুৰ্য্যোধনরূপ মহাবৃক্ষের মূল দৃঢ় করিয়া দিয়াছেন। কেন না, জন্মকালীন দুর্লক্ষণাদি দেখিয়া বিদুর যে দুৰ্য্যোধনের বর্জ্জনের জন্য পরামর্শ দিয়াছিলেন, তাহা পালিত হইলে ভীমের প্রাণনাশার্থ বিষদান, জতুগৃহে পাণ্ডবদিগের দাহচেষ্টা, দ্যূতে জিতিয়া দ্ৰৌপদীর কেশাকর্ষণ প্রভৃতি কুকর্মেরও অনুষ্ঠান হইত না; দুৰ্য্যোধনরূপ বিষবৃক্ষের ছায়াস্থিত কুরুকুলও নির্মুল হইত না।
এই রূপকদ্বারা ইহাই প্ৰদৰ্শিত হইল যে-ক্ৰোধলোভাদি যাহার স্কন্ধ, হিংসা চৌৰ্য্যাদি যাহার শাখা, বন্ধ-বন্ধন জন্য নরকাদি যাহার ফল ও পুষ্প; পুরুষাৰ্থকামী পুরুষ এইরূপ দৃঢ় অজ্ঞানমূল দৈন্যতরু জ্ঞানদ্বারা ছেদন করবেন।
দ্বিতীয়টি—যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির ধর্ম্মময় মহাবৃক্ষ, এই পুণ্যতারু ধর্মের নিত্য পরিপোষক শম-দম-সত্য-অহিংসা-এই সকল সদগুণময়। তাঁহার একাত্মতুল্য অর্থাৎ শমদমাদি গুণবিশিষ্ট অর্জ্জুন স্কন্ধ, ভীমসেন শাখা, মাদ্রীনন্দন নকুলসহদেব যথাক্রমে পুষ্প, ফল; মূল শুদ্ধসত্ত্বময় পরমাত্মা কৃষ্ণ, বেদ, বেদবিদ ব্রাহ্মণগণ; কৃষ্ণ মূল রূপে সহায় থাকায় পাণ্ডবগণ কামকলুষিত হন নাই, বেদ তাঁহাদের মূল, এজন্য যজ্ঞযোগাদি ভুক্তি মুক্তিসাধক সাধনার সুযোগ তাঁহারা পাইয়াছিলেন, বেদেরও মূল ব্রাহ্মণ, সেই বেদবিদ ব্রাহ্মণগণ তাঁহাদের মূল রূপে প্রতিষ্ঠিত থাকায়—তাঁহাদের প্রবর্ত্তনায়–তাহাদের উপদেশপরম্পরায় বেদের প্রমাণ্যে তাঁহারা পরিনিষ্ঠিত হইয়াছিলেন-পরমাত্মার অনুগ্রহ লাভ করিয়াছিলেন। ভগবানের আরাধনায় অভিমুখ ব্যক্তিগণ এ হেন ধৰ্ম-বৃক্ষের কদাচ হিংসা করিবেন না।
পূর্ব্বাচাৰ্য্য ঋষিগণ এই ভারতীয় শ্লোকদ্বয়ের সমধিক সারবত্তা উপলব্ধি করিয়া শ্ৰাদ্ধ-মন্ত্রমধ্যে পুণ্যাখ্যানরূপে ইহার পাঠ প্রচলন করিয়া গিয়াছেন।
কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ হইয়া উঠিলে উদযোগপর্ব্বে পুনর্ব্বার তাঁহাদিগকে রূপক করিয়া শান্তিসংস্থাপনের সন্ধিপ্রস্তাবে বাসুদেব বলিতেছেন-দুৰ্য্যোধন মহারণ্য, পাণ্ডবগণ সেই বনের ভীষণ ব্যাঘ্র; যে বনে ভয়ঙ্কর ব্যাঘ্র বিচরণ করে, সেখানে কাঠুরিয়ারা কাঠ কাটিতে যায় না, অতএব বন নিরাপদ-বনের হিংসা হয় না; আবার বনহীন স্থানে ব্যাঘ্রের বিচরণ নিরাপদ নহে, শিকারিরা সহজে দেখিতে পায়-অনায়াসে তাহাকে বধ করে; অতএব রক্ষকরূপে বন-ব্যাঘ্র উভয়ই পরস্পর-সাপেক্ষ। সুতরাং বন-ব্যাঘ্রে উভয়ই রক্ষণীয়। সন্ধি ব্যতীত তাদৃশ উভয় রক্ষা হয় না।
এস্থলে যদি সন্ধি অগ্রাহ্য করিয়া উভয়পক্ষ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, তবে বনই বিনষ্ট হইবে, পরন্তু ব্যাঘ্র বাঁচিয়া যাইবে; কারণ বনের মূল ক্রোধাদি অধাৰ্মিক বস্তু; আর ব্যান্ত্রের মূল কৃষ্ণ, বেদ ও ব্রাহ্মণ।
মহাবৃক্ষের আশ্রয় না পাইলে লতাসকল কদাচ পরিবৰ্দ্ধিত হইতে পারে না। পাণ্ডবেরা তাহাদিগকে সেবা অথবা তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত আছেন; এক্ষণে নরাধিপ ধৃতরাষ্ট্রের যাহা কর্ত্তব্য, তাহার অনুষ্ঠান করুন। ধর্ম্মপরায়ণ পাণ্ডবেরা সমরকার্য্যে সুনিপুণ হইয়া অতি প্রশান্তভাবে রহিয়াছেন। হে সঞ্জয়! তুমি অবিকল এই সকল কথার উল্লেখ করিবে।”