২৭তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের ভীম্মাদি-নিমিত্ত শোকসমুচ্ছ্বাস
ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির মহর্ষি বেদব্যাসকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে মহাত্মন! এক্ষণে বালক অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন, মহারাজ দ্রুপদ, বিরাট, ধৰ্ম্মজ্ঞ বসুসেন, রাজা ধৃষ্টকেতু ও অন্যান্য নানাদেশীয় ভূপালগণ সংগ্রামে কলেবর পরিত্যাগ করাতে আমি শোকে অধীর হইয়াছি। হায়! আমা হইতেই আমাদের কুলক্ষয় হইল। আমি নিতান্ত রাজ্যকামুক নরাধম। পূৰ্ব্বে যিনি আমাকে ক্রোড়ে করিয়া লালনপালন করিয়াছিলেন, আমি রাজ্যলোভে সেই পিতামহকে সমরে নিপাতিত করিয়াছি। সংগ্রামসময়ে শিখণ্ডীর সমীপস্থিত জীর্ণ সিংহসদৃশ পিতামহকে অর্জ্জুনের শরজালপ্রভাবে বজ্রাহত অচলের ন্যায় কম্পিত ও বিঘূর্ণিত হইতে দেখিয়া আমার হৃদয় নিতান্ত ব্যথিত হইয়াছিল। তৎকালে আমি সেই মহাত্মাকে নিতান্ত অবসন্ন, রথোপরি বিঘূর্ণমান ও প্রাঙ্খুখে রথ হইতে নিপতিত দেখিয়া নিশ্চয়ই মহাপাপে লিপ্ত হইয়াছি। যিনি শর, শরাসন গ্রহণপূৰ্ব্বক কুরুক্ষেত্রে পরশুরামের সহিত বহুদিন যুদ্ধ করিয়াছিলেন, যিনি বারাণসীতে কন্যালাভার্থ একাকী রথারোহণে একত্র সমবেত অসংখ্য পার্থিবকে আহ্বান করিয়াছিলেন, যাঁহার শস্ত্রপাতে সমরদুর্দ্ধর্ষ মহারাজ উগ্ৰায়ুধ দগ্ধ হইয়াছিলেন, আমি সেই মহাত্মা পিতামহকে নিপাতিত করিলাম; ঐ মহাত্মা সংগ্রামকালে শিখণ্ডীর প্রতি শর নিক্ষেপ করেন নাই, অর্জ্জুন সেই অবসরে তাঁহাকে নিপাতিত করিয়াছে। পিতামহকে শোণিতাক্তকলেবরে ভূতলে নিপতিত হইতে দেখিয়া তখন আমার মন যে কিরূপ ব্যথিত হইয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। আমার মত পাপাত্মা নরাধম আর কেহই নাই। আমরা যাঁহার যত্নে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছি, যিনি আমাদিগকে সতত রক্ষণাবেক্ষণ করিয়াছেন, আমি অল্পকালস্থায়ী সামান্য রাজ্যলাভপ্রত্যাশায় মোহবশতঃ সেই পরমগুরু পিতামহকে নিপাতিত করিলাম।
“হায়! আমি সৰ্ব্বপার্থিবপুজিত[সমস্ত ক্ষত্রিয়-রাজগণের পূজ্য] মহাত্মা দ্রোণাচাৰ্য্যকে মিথ্যাবাক্যে বঞ্চনা করিয়াছি, ঐ মহাত্মা সত্যবৃত্তান্ত অবগত হইবার নিমিত্ত আমার নিকট আগমনপূৰ্ব্বক ‘হে ধৰ্ম্মরাজ! আমার পুত্র জীবিত আছে কি না, যথার্থ করিয়া বল’, এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে, আমি রাজ্যলোভবশতঃ তাঁহার নিকটে স্পষ্টাভিধানে [স্পষ্টবাক্যে] ‘অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছে’ বলিয়া অস্পষ্টাভিধানে গজ শব্দ উচ্চারণ করিয়াছিলাম। এক্ষণে সেই বৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া আমার শরীর দগ্ধ হইতেছে। না জানি, গুরুতর পাপ নিবন্ধন আমাকে পরিশেষে কোন্ লোকে গমন করিতে হইবে।
“হায়! আমি যখন সমরে অপরাঙ্মুখ জ্যেষ্ঠভ্রাতা কর্ণকে নিপাতিত করিয়াছি, তখন আমার তুল্য পাপাত্মা আর কেহই নাই। আমি পর্ব্বত-সমুৎপন্ন সিংহশাবকসদৃশ বালক অভিমন্যুকে দ্রোণরক্ষিত ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করিতে অনুমতি করিয়া অবধি ব্রহ্মহত্যাকারী নরাধমের ন্যায় বাসুদেব ও অর্জ্জুনকে স্থিরচিত্তে অবলোকন করিতে অসমর্থ হইয়াছি; পঞ্চপুত্রবিহীন দ্রৌপদীকে পঞ্চপৰ্ব্বশূন্য পৃথিবীর ন্যায় অবলোকন করিয়া আমার হৃদয় শোকানলে দগ্ধ হইতেছে। এক্ষণে এই ক্ষত্রিয়কুলক্ষয় প্রভৃতি অনর্থ-সমুদয় আমা হইতে হইয়াছে। অতএব আমি এই স্থানেই প্রায়োপবেশনে কলেবর শোষণ করিয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিব। তাহা হইলে আমাকে আর কোন জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে না। এক্ষণে আমি বিনীতভাবে তোমাদিগকে কহিতেছি যে, তোমরা আমাকে কলেবর পরিত্যাগ করিতে অনুমতি প্রদানপূর্ব্বক যথাস্থানে প্রস্থান কর।”
বেদব্যাসের যুধিষ্ঠির সান্ত্বনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! তখন তপোধনাগ্রগণ্য বেদব্যাস ধৰ্ম্মরাজকে বন্ধুবিয়োগশোকে নিতান্ত কাতর দেখিয়া সান্ত্বনাবাক্যে কহিলেন, “মহারাজ! শোকে নিতান্ত অভিভূত হওয়া তোমার কর্ত্তব্য নহে। আমি পুনরায় তোমাকে উপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। বুদ্বুদ[বিম্ব-জলের বোটকা]-সকল যে প্রকার সলিলে উৎপন্ন ও বিলীন হয়, তদ্রূপ জীবমাত্রেই ইহলোকে উৎপন্ন ও বিনষ্ট হইয়া থাকে। সকল পদার্থেরই পরিণামে ধ্বংস আছে। ক্ষয় স্তূপের অন্তঃ, পতন উন্নতির অন্তঃ, বিয়োগ সংযোগের অন্তঃ ও মরণ জীবনের অন্তঃ। সুখলাভার্থ কালক্ষেপ করিলে পরিণামে দুঃখভোগ করিতে হয়, আর কষ্ট সহকারে কার্য্যনিপুণতা প্রকাশ করিলে পরিণামে সুখভোগ করিতে পারা যায়। নিপুণ ব্যক্তিই অণিমাদি ঐশ্বৰ্য্য[অণিমা (সূক্ষ্ম), লঘিমা (হালকা), ব্যাপ্তি (সাফল্য), কাম্য (ইচ্ছামাত্রে সম্পন্ন করার শক্তি), মহিমা (মহত্ত্ব), ঈশিত্ব (প্রভুত্ব), বশিত্ব (বশ করিবার শক্তি), কামাবসায়িত (বাসনা সমাপ্তি শক্তি)।], শ্ৰী, লজ্জা, ধৈৰ্য্য ও কীৰ্ত্তি লাভ করিতে পারেন। অলস ব্যক্তি কখনই ঐ সকল লাভে সমর্থ হয় না। লোকে বন্ধুবান্ধব ও ধন দ্বারা সুখী, শত্রু দ্বারা দুঃখী ও প্রজ্ঞাপ্রভাবে ধনবান হইতে পারে না। যাহা হউক, এক্ষণে বিধাতা কৰ্ম্মানুষ্ঠানের নিমিত্তই তোমার সৃষ্টি করিয়াছেন, অতএব কৰ্ম্ম অবলম্বন করাই। তোমার কর্ত্তব্য। কৰ্ম্মত্যাগে তোমার অধিকার নাই।”