২৬তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের যযাতিকথিত ধৰ্ম্মসিদ্ধান্ত নির্ণয়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, তখন উদারবুদ্ধি ধৰ্ম্মরাজ বিনীতবাক্যে অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ধনঞ্জয়! তোমার মতে ধনই সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পদার্থ এবং নির্ধন ব্যক্তির স্বর্গ, সুখ ও অর্থলাভ হয় না। কিন্তু বস্তুতঃ ঐরূপ সিদ্ধান্ত ভ্রান্তিবিজম্ভিত [১] সন্দেহ নাই। অনেকানেক ব্যক্তি বেদাধ্যয়ন ও তপানুষ্ঠাননিরত হইয়া অক্ষয় লোক লাভ করিয়াছেন। যাঁহারা ঋষিদিগের ন্যায় স্বাধ্যায়সম্পন্ন, ব্রহ্মচারী ও সৰ্ব্বধৰ্ম্মজ্ঞ হয়েন, দেবগণ তাঁহাদিগকে ব্রাহ্মণ বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন। মহর্ষিগণের মধ্যে কেহ কেহ স্বাধ্যায়নিষ্ঠ, কেহ কেহ জ্ঞাননিষ্ঠ ও কেহ কেহ ধৰ্ম্মনিষ্ঠ হইয়া থাকেন। বৈখানস[২]দিগের মতে জ্ঞাননিষ্ঠ মহাত্মাদিগের বাক্যানুসারে রাজকাৰ্য্য পৰ্য্যালোচনা করা কর্ত্তব্য। অজ, প্রশ্নি, সিকত, অরুণ ও কেতুগণ স্বাধ্যায়প্রভাবে দেবলোকে গমন করিয়াছেন। লোকে দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন ও নিতান্ত দুষ্কর ইন্দ্রিয়নিগ্রহ প্রভৃতি বেদোক্ত কার্য্য-সমুদয়ের অনুষ্ঠান করিয়া দক্ষিণদিকস্থ পথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক স্বর্গে গমন করে। আমি পূৰ্ব্বে তোমাকে কহিয়াছি যে, কৰ্ম্মনিরত ব্যক্তিরাই দক্ষিণদিকস্থ পথ অবলম্বনপূর্ব্বক গমন করিয়া থাকে। উত্তরদিকে যে পথ আছে, যোগীরা সেই পথ দিয়া অক্ষয় লোকে গমন করেন। পুরাণবেত্তারা ঐ উভয় পথের মধ্যে উত্তরদিকের পথকেই সবিশেষ প্রশংসা করিয়া থাকেন।
“হে ধনঞ্জয়! সন্তোষপ্রভাবে স্বর্গে পরম সুখলাভ হয়। সন্তোষ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই। যাঁহারা ক্রোধ ও হর্ষ পরাজয় করিয়াছেন, তাঁহারাই প্রকৃত সন্তোষসুখ অনুভব করিতে পারেন। সন্তোষই উৎকৃষ্ট সিদ্ধি। এক্ষণে রাজা যযাতি যাহা কহিয়া গিয়াছেন, আমি তা উল্লেখ করিতেছি, শ্রবণ কর। উহা শ্রবণ করিলে লোকের কাম-সকল কূৰ্ম্মশুণ্ডের ন্যায় প্রতিসংহৃত [প্রতিনিবৃত্ত] হয়। ‘পুরুষ যখন স্বয়ং ভীত হয় না এবং কাহাকে বিভীষিকা প্রদর্শন করে না, যখন সে ইচ্ছা-দ্বেষশূন্য হয় এবং প্রাণীগণ মধ্যে কায়মনোবাক্যেও পাপস্বভাব প্রকাশ করে না, তখনই ব্ৰহ্ম লাভ করিয়া থাকে। যিনি অভিমান ও মোহকে বশীভূত করিয়াছেন। এবং যিনি পুত্র-কলত্রবিবর্জ্জিত ও আত্মজ্ঞানসম্পন্ন হইয়াছেন, সেই সাধু ব্যক্তিই মুক্তিলাভের উপযুক্ত পাত্র। হে অর্জ্জুন! এই সংসারে কেহ কেহ ধৰ্ম্ম, কেহ কেহ চরিত্র এবং কেহ কেহ বা ধনলাভের বাসনা করিয়া থাকে। অর্থভিক্ষা করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করা অপেক্ষা যজ্ঞানুষ্ঠান না করাই শ্রেয়ঃ। যাচ্ঞা করিলে মহাদোষে দূষিত হইতে হয়। যাহারা ধনার্থী, তাহারা কখনই অবশ্যপরিহার্য বস্তু পরিহার করিতে পারে না। আমরা ইহা সততই প্রত্যক্ষ করিতেছি এবং তোমারও উহা বিশেষরূপে পরীক্ষা করা কর্ত্তব্য। যাহাদিগের অর্থোপার্জ্জন-স্পৃহা বলবতী, সঙ্কৰ্ম্ম তাহাদের নিকট স্থানলাভে সমর্থ হয় না। অন্যের অনিষ্টাচরণ ব্যতিরেকে কিছুতেই অর্থাগম হইবার সম্ভাবনা নাই, আবার অর্থ হস্তগত হইলে মনোমধ্যে সততই ভয় উপস্থিত হয়। যাহারা অতি দুশ্চরিত্র এবং ভয় ও শোকবিবর্জ্জিত, তাহারা অল্পমাত্র অর্থলাভের অভিলাষে ব্রহ্মহত্যাকেও তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া থাকে। প্রভু ভৃত্যদিগকে অর্থ প্রদান না করিলে অতিশয় অশোভাগী হয়েন এবং অর্থ প্রদান করিলেও ব্যয়নিবন্ধন যৎপরোনাস্তি কাতর হইয়া থাকেন। বিশেষতঃ অর্থসম্পন্ন ব্যক্তিদিগকে সততই চোরভয়ে ভীত হইতে হয়। কিন্তু ভোগবিলাস-বিমুক্ত পরমসুখী নির্ধন ব্যক্তি কাহারও নিন্দাভাজন বা কাহারও ভয়ে ভীত হয় না। পাছে লোভবৃদ্ধি হয়, এই ভয়ে তিনি দৈবকাৰ্য্য অনুষ্ঠানার্থ যাহা কিছু অর্থসঞ্চয় করেন, তাহাতেও অতিশয় সঙ্কুচিত হইয়া থাকেন।
“হে অর্জ্জুন! পুরাবৃত্তবিৎ[প্রাচীন ইতিহাসে অভিজ্ঞ]পণ্ডিতেরা যজ্ঞসংস্কার উদ্দেশ্যে যাহা কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন, শ্রবণ কর। বিধাতা যজ্ঞানুষ্ঠানের নিমিত্তই ধন এবং ধনরক্ষক পুরুষের সৃষ্টি করিয়াছেন। অতএব ধন যাগযজ্ঞে ব্যয় করাই কৰ্ত্তব্য; উহার দ্বারা ভোগবিলাস চরিতার্থ করা উচিত নহে। বিধাতা যজ্ঞানুষ্ঠানের নিমিত্ত মনুষ্যদিগকে ধন দান করিয়াছেন, তজ্জন্য অনেকেই বিবেচনা করেন যে, ধন কাহারও অধিকৃত নহে। অতএব পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তিসহকারে ধন দান ও যজ্ঞানুষ্ঠান করা সকলেরই কর্ত্তব্য। সৎপুরুষেরা উপার্জিত অর্থ দান করিবারই উপদেশ দিয়াছেন, ভোগ বা অপব্যয় করিতে আদেশ করেন নাই। দানরূপ সুমহৎ কাৰ্য্য বিদ্যমান থাকিতে অর্থসঞ্চয় করা নিতান্ত অনুচিত। দানও পাত্র বিবেচনা করিয়া করা কর্ত্তব্য। যে নির্বোধেরা ধর্ম্মভ্রষ্ট ব্যক্তিদিগকে অর্থ দান করে, তাহাদিগকে দেহান্তে শত বৎসর পুরীষ ভক্ষণ করিতে হয়। অতএব পাত্ৰাপাত্রের পরিজ্ঞান নিবন্ধন দানধৰ্ম্মও নিতান্ত দুষ্কর। অযোগ্য পাত্রে দান করা আর যোগ্য পাত্রে দান না করা, এই দুইটি উপার্জ্জিত ধনব্যবহারের সম্যক ব্যতিক্রম সন্দেহ নাই।”