২৬তম অধ্যায়
ভীম-দুর্য্যোধন যুদ্ধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে সঞ্জয়! এই রূপে সৈন্যগণ সমরক্ষেত্রে গমন পূর্ব্বক অংশ ক্রমে পরস্পরকে আক্রমণ করিলে পর পাণ্ডব পক্ষ ও অম্মৎপক্ষ বীরগণ কিরূপে যুদ্ধ করিয়াছিলেন? মহাবীর ধনঞ্জয় সংশপ্তকগণকে কি রূপে আক্রমণ করিলেন? সংশপ্তকেরাই বা তাহার সহিত কি রূপ সংগ্রাম করিল?
সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! সৈন্যগণ উক্ত প্রকারে সংগ্রামাসক্ত হইয়া অংশক্রমে পরস্পরকে আক্রমণ করিলে আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন স্বয়ং গজ সৈন্য লইয়া মহাবীর বৃকোদরের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। মাতঙ্গ যেমন মাতঙ্গকে আক্রমণ করে, বৃষ যেমন বৃষকে আক্রমণ করে, তদ্রূপ মহাবীর দুৰ্যোধন ভীমসেনকে আক্রমণ করিলে সংগ্ৰামনিপুণ অসাধারণ বাহু বীর্য্যশালী মহাবীর পবনতনয় ক্রোধভরে গজ সৈন্যের প্রতি ধাবমান হইয়া অচিরাৎ কুঞ্জরগণকে নিপাতিত করিতে লাগিলেন। পর্ব্বতাকার মাতঙ্গগণ ভীমসেনের নারাচ প্রহারে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া মদক্ষরণ করত ইতস্তত পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। প্রবল বায়ুবেগে জলধর পটল যেমন ছিন্ন ভিন্ন হইয়া যায়, তদ্রূপ গজানীক সকল ভীমসেনের ভীষণ প্রহারে শ্রেণীভঙ্গ করিয়া ইতস্তত ধাবমান হইল। সূৰ্য্য সমুদিত হইয়া যেমন ভূমণ্ডলে কিরণজাল বিকীর্ণ করেন, তদ্রূপ মহাবীর ভীমসেন করিকুলের উপর শরজাল নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। করিগণ ভীমসেনের শরাঘাতে ক্ষত বিক্ষত ও রুধিরাক্ত কলেবর হইয়া সূৰ্য্য কিরণ সংপৃক্ত নভোমণ্ডলস্থ ধারাধরপুঞ্জের ন্যায় শোভা ধারণ করিল।
মহারাজ দুৰ্য্যোধন এই রূপে ভীমসেনকে করিকুল সংহার করিতে দেখিয়া ক্রোধভরে তাঁহার উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর ক্রোধে লোহিত নেত্র হইয়া অচিরাৎ দুৰ্য্যোধনকে সংহার করিবার মানসে তাঁহার শরীরে নিশিত সায়ক সমুদায় বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবাহু দুর্য্যোধন ভীমশরে ক্ষত-বিক্ষতাঙ্গ হইয়া ক্রোধভরে তাঁহার উপর সূর্য্যকিরণ সদৃশ নারাচ নিক্ষেপ করিত লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন সত্বরে দুই ভল্ল দ্বারা দুৰ্য্যোধনের ধ্বজস্থিত মণিময় রত্নখচিত নাগ ও তাঁহার হস্তস্থিত কার্ম্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
ভীমহস্তে দুর্য্যোধনসাহায্যকারী অঙ্গনৃপতি বধ
ঐ সময় ম্লেচ্ছ অঙ্গাধিপতি দুৰ্য্যোধনকে ভীম কর্ত্তৃক নিতান্ত পীড়িত নিরীক্ষণ করিয়া গজারোহণ পূর্ব্বক তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাবীর ভীমসেন অঙ্গাধিপতির মাতঙ্গকে মেঘের ন্যায় গর্জ্জন করত আগমন করিতে দেখিয়া তাহার কুম্ভান্তরে নিশিত নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। ভীমনিক্ষিপ্ত ভীষণ নারাচ কুঞ্জরের কলেবর ভেদ করিয়া ভূতলে প্রবেশ করিল; হস্তীও বজ্রাহত পর্ব্বতের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইল। হস্তী নিপতিত হইবামাত্র অঙ্গরাজ ভূতলে পতিত হইতেছিলেন ইত্যবসরে লঘুহস্ত বৃকোদর ভল্ল দ্বারা তাঁহার মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর অঙ্গরাজ নিহত হইলে সৈন্যগণ চতুর্দ্দিকে প্রলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। অশ্ব, হস্তী ও রথী সকল সসম্ভ্রমে ইতস্তত ধাবমান হইয়া অসংখ্য পদাতির প্রাণ সংহার করিতে লাগিল।
ভীম-ভগদত্ত যুদ্ধ
এই রূপে সৈন্যগণ রণে ভগ্ন হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলে প্রাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত কুঞ্জর লইয়া ভীমের প্রতি ধাবমান হইলেন। ক্রোধে ব্যাবৃত্তলোচন সেই গজরাজ চরণদ্বয় উৎক্ষিপ্ত ও শুণ্ড সংহত করিয়া ভীমকে দগ্ধ করতই যেন তাঁহার সমীপে গমন পূর্ব্বক এক কালে রথ ও অশ্বগণকে চূর্ণ করিয়া ফেলিল। মহাবীর ভীমসেন অঞ্জলিকা বেধ বিদ্যা জানিতেন, এই নিমিত্ত পলায়ন না করিয়া পাদচারে ধাবমান হইয়া সেই কবিরাজের গাত্রে বিলীন হইলেন। এই রূপে ভীমসেন গজের গাত্রের অভ্যন্তরে থাকিয়া কর দ্বারা তাঁহাকে প্রহার করিতে লাগিলেন। নাগ ভীমসেনের ভীষণ আঘাতে কুলালচক্রের ন্যায় ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিল।
তখন অযুত নাগ তুল্য বলশালী মহাবীর বৃকোদর হস্তীর কলেবর হইতে বহির্গত হইয়া তাহার সম্মুখীন হইলেন। নাগ রাজ অবসর পাইয়া শুণ্ড দ্বারা ভীমের গ্রীবা আক্রমণ ও জানু দ্বারা তাঁহাকে নিপাতন পূর্ব্বক তাঁহার প্রাণ সংহার করিতে সমুদ্যত হইল। তখন মহাবীর বৃকোদর অবিলম্বে মোটনদ্বারা করিবরের কর বেষ্টন মোচন পূর্ব্বক পুনরায় তাহার গাত্রে প্রবেশ করিয়া স্বপক্ষ হস্তীর আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে পুনরায় তাহার গাত্র হইতে বহির্গত হইয়া মহাবেগে গমন করিলেন। এ দিকে সমুদায় সৈন্য গণ, হাধিক্! ভীমসেন কুঞ্জর কর্ত্তৃক হত হইলেন, বলিয়া ঘোতর চীৎকার করিতে লাগিল। পাণ্ডব সৈন্যগণ হস্তীর ভয়ে ভীতহইয়া বৃকোদরের সমীপে ধাবমান হইল।
যুধিষ্ঠির-ভগদত্ত যুদ্ধ
এদিকে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বৃকোদরকে নিহত জ্ঞান করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন সমভিব্যাহারে ভগদত্তের সমীপে সমাগত হইয়া অসংখ্য রথ দ্বারা তাঁহাকে পরিবেষ্টন পূর্ব্বক সহস্র সহস্র তীক্ষ্ণ শরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভগদত্ত অঙ্কুশ দ্বারা বিপক্ষ বিনিমুর্ক্ত শরনিকর নিরাকৃত করিয়া গজ দ্বারা পাণ্ডব ও পাঞ্চাল সৈন্যগণকে আক্রমণ করিলেন। আমরা বৃদ্ধ ভগদত্তকে রণস্থলে অসঙ্কুচিত চিত্তে কুঞ্জর চালন করিতে দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। তখন মহারাজ দশাণাধিপতি বক্রগামী মহাবেগশালী মদস্রাবী মাতঙ্গ লইয়া ভগদত্তের প্রতি ধাবমান হইলেন। পূর্ব্বে সবৃক্ষ পর্ব্বতদ্বয়ের যে রূপ সংগ্রাম হইত, এ ক্ষণে উক্ত বীরদ্বয়ের কুঞ্জর যুগল তদ্রূপ যুদ্ধ করিতে লাগিল। ভগদত্তের হস্তী মহাবেগে অপাবৃত্ত হইয়া দশার্ণাধিপতির হস্তীর পার্শ্বভেদ করিয়া তাঁহাকে নিহত করিল। তখন মহাবীর ভগদত্ত অবসর পাইয়া সূৰ্য্যরশ্মি সঙ্কাশ সাত তোমর নিক্ষেপ পূর্ব্বক স্বীয় শত্রু দশার্ণাধিপতিকে হস্তীর উপরেই সংহার করিলেন।
তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির অসংখ্য রথ সৈন্য দ্বারা ভগদত্তকে চতুর্দ্দিকে পরিবেষ্টন করিলেন। কুঞ্জরস্থিত মহাবীর ভগদত্ত রথিগণ কর্ত্তৃক চারিদিকে পরিবেষ্টিত হইয়া পর্ব্বতোপরি বনমধ্যস্থ প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। রথিগণ চতুর্দ্দিকে মণ্ডলাকারে অবস্থান করিয়া শরজাল নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলে মহাবীর ভগদত্ত গজ লইয়া অসঙ্কুচিত চিত্তে তাঁহাদের মধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন।
সাত্যকি ভগদত্ত যুদ্ধ – পাণ্ডব পলায়ন
অনন্তর সমরবিশারদ প্রাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত্ত সাত্যকির রথাভিমুখে সেই মহাগজ প্রেরণ করিলেন। করিবর সাত্যকির রথ গ্রহণ পূর্ব্বক বেগে নিক্ষেপ করিবামাত্র সাত্যকি লম্ফ প্রদান পূর্ব্বক রথ হইতে ভূতলে নিপতিত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিলেন। তাঁহার সারথিও বৃহৎকায় সিন্ধুদেশীয় অশ্বগণকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাঁহার অনুগামী হইল। ঐ অবসরে হস্তী রথমণ্ডল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া সমুদায় ভূপতিগণকে নিক্ষেপ করিতে লাগিল। ভূপতিগণ সেই আশুগামী নাগ কর্ত্তৃক বিভ্রাসিত হইয়া তাহাকে শত শত বলিয়া জ্ঞান করিতে লাগিলেন।
এই রূপে গজারোহী মহাবাহু ভগদত্ত পাণ্ডব ও পাঞ্চাল সৈন্যগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলে তাহারা রণে ভগ্ন হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল। পলায়ন কালে গজ ও তুরঙ্গমগণের ঘোরতর শব্দ হইতে আরম্ভ হইল। তখন মহাবীর বৃকোদর পুনরায় ভগদত্তাভিমুখে ধাবমান হইলে ভগদত্তের হস্তী শুণ্ড বিনির্ম্মুক্তবারি দ্বারা ভীমের বাহনগণকে বিত্রাসিত করিতে লাগিল। বাহনসকল মহাবীর ভীমকে লইয়া প্রস্থান করিল।
ভগদত্ত সাহায্যকারী রুচিপর্ব্বার প্রাণসংহার
তখন কৃতীর পুত্র রুচিপৰ্বা রথে আরোহণ করিয়া শর বর্ষণ করিতে করিতে সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় ভীমসেনের পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। পর্ব্বতপতি সুবর্চ্চা আনতপর্ব্ব শর দ্বারা তাঁহাকে যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। মহাবীর রুচিপৰ্বা রণে নিপতিত হইলে মহাবীর অভিমন্যু, দ্রৌপদীতনয়গণ, চেকিতান, ধৃষ্টকেতু ও যুযুৎসু হস্তীকে নিহত করিবার বাসনায় ভীষণ ধ্বনি করত বৃষ্টিধারার ন্যায় শরজাল নিক্ষেপ করিয়া তাঁহাকে ব্যথিত করিতে লাগিলেন। তখন সমর কুশল মহাবীর ভগবত্ত পার্ষ্ণি, অঙ্কুশ ও অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা হস্তীকে সঞ্চালিত করিলেন। করিবর প্রাগজ্যোতিষাধিপতি কর্ত্তৃক সঞ্চালিত হইয়া শুণ্ড প্রসারণ এবং কর্ণ ও নেত্র স্তব্ধ করিয়া সত্বরে গমন পূর্ব্বক যুযুৎসুর বাহনগণকে আক্রমণ ও সারথিকে সংহার করিল। মহাবীর যুযুৎসু সত্বরে রথ হইতে পলায়ন করিলেন। তখন পাণ্ডব পক্ষীয় যোদ্ধাগণ ভীষণ নিনাদ করিয়া শরনিকরদ্বারা সত্বরে নাগরাজকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় আপনার পুত্র সসম্ভ্রমে অভিমন্যুর রথাভিমুথে ধাবমান হইলেন।
হে মহারাজ! মহাবীর ভগদত্ত ঐ সময় কুঞ্জরপৃষ্ঠ হইতে অরাতিকুলের উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া প্রসৃতকর দিবাকরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন অভিমন্যু দ্বাদশ, যুযুৎসু দশ এবং দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র ও ধৃষ্টকেতু তিন তিন শরে ভগদত্তের হস্তীকে বিদ্ধ করিলেন। করিবর বীরগণ কর্ত্তৃক অতি প্রযত্ন সহকারে শরবিদ্ধ হইয়া সূর্য্যকিরণ সংপৃক্ত জলধরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। অনন্তর নিয়ন্তা কর্ত্তৃক সঞ্চালিত হইয়া স্বীয় সব্যাপদব্যস্থিত সৈন্যগণকে ইতস্তত নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিল। গোপাল বন মধ্যে দণ্ড দ্বারা যেমন পশুগণকে তাড়িত করে, তদ্রূপ মহাবীর ভগদত্ত পাণ্ডব সৈন্যগণকে বারংবার তাড়িত করিতে লাগিলেন। তখন পাণ্ডব সৈন্যগণ শ্যেন কর্ত্তৃক আক্রান্ত বায়সগণের ন্যায় চীৎকার করিয়া মহাবেগে ধাবমান হইল।
হে মহারাজ! ঐ সময় ভগদত্তের মহাগজ অঙ্কুশাহত। হইয়া সপক্ষ পর্ব্বতের ন্যায় মহাবেগে গমন করিতে লাগিল। বণিক্গণ আপনাদের উভয় পার্শ্বে সমুদ্র তরঙ্গ দেখিয়া যেরূপ ভীত হয়, অরাতিপক্ষীয় সৈন্যগণ সেই মহাগজ সন্দর্শনে তদ্রূপ বিভ্রাসিত হইয়া উঠিল। মহাভয়ে পলায়মান হস্তী, অশ্ব, রথ ও পার্থিবগণের চীৎকারে ভূমণ্ডল, আকাশমণ্ডল ও সমুদায় দিগ্মণ্ডল পরিপূর্ণ হইল। পূর্ব্বে দানবরাজ বিরোচন যেমন সুরক্ষিত দেবসেনামধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ মহাবীর ভগদত্ত সেই মহানাগ লইয়া শত্রু সৈন্যগণের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। পার্থিব ধূলিপটল বায়ুবেগে গগন মণ্ডলে সমুত্থিত হইয়া সৈন্যগণকে সমাচ্ছাদিত করিল। তত্রস্থ মনুষ্যগণ সেই এক গজকে চতুর্দ্দিকে ধাবমান অসংখ্য গজ বলিয়া বোধ করিতে লাগিল। ”