চতুর্ব্বিংশ অধ্যায়
সূর্য্যের সরর্বসংহারক মূর্ত্তিধারণ
গরুড় দেবতা ও ঋষিদিগের এইরূপ স্তুতিবাদ শ্রবণ করিয়া এবং আপনার অতি প্রকাণ্ড কলেবর অবলোকন করিয়া স্বীয় তেজঃপুঞ্জের প্রতিসংহার করিলেন এবং কহিলেন, “আমি আত্মতেজের সঙ্কোচ করিতেছি, আর কাহাকেও ভীত হইতে হইবে না।” এই বলিয়া বিহঙ্গরাজ গরুড় অরুণকে আত্মপৃষ্ঠে আরোহণ করাইয়া পিতৃগৃহ হইতে সমুদ্রের অপরপারবর্ত্তিনী স্বীয় জননীর সন্নিধানে গমন করিলেন। ঐ সময় সূর্য্যদেব দেবতাদিগের প্রতি কূপিত হইয়া প্রখর করজাল বিস্তারপূর্ব্বক ত্রিলোকী দগ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছেন দেখিয়া খগরাজ স্বীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা অরুণকে পূর্ব্বদিকে স্থাপন করিলেন।
রুরু কহিলেন, “সূর্য্য কি নিমিত্তে ত্রিলোক দগ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন এবং দেবতারাই বা তাঁহার কি অপকার করিয়াছিলেন যে, তিনি তাঁহাদিগের প্রতি এইরূপ কুপিত হইলেন?” প্রমতি কহিলেন, “যৎকালে চন্দ্র ও সূর্য্য রাহুকে প্রচ্ছন্নভাবে অমৃত পান করিতে দেখিয়া দেবতাদিগের নিকট প্রকাশ করিয়া দেন, তদবধি তাঁহাদিগের সহিত রাহুর বৈরানুবন্ধ হওয়াতে ঐ ক্রুরগ্রহ রাহু মধ্যে মধ্যে সূর্য্যদেবকে গ্রাস করিত। পরে ভগবান্ সূর্য্য এই অভিপ্রায়ে রোষাবিষ্ট হইলেন যে, আমি দেবতাদিগেরই হিতানুষ্ঠানের নিমিত্ত রাহুর কোপে পড়িলাম এবং তজ্জন্য কেবল আমিই একাকী বহু অনর্থকর পাপের ফলভাগী হইলাম, বিপৎকালে কাহাকেও সাহায্য করিতে দেখি না। রাহু যখন আমাকে গ্রাস করে, দেবতারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াও তাহা অনায়াসে সহ্য করিয়া থাকে; অতএব আমি অদ্য সমস্ত লোক বিনাশ করিব, সন্দেহ নাই। দিবাকর এইরূপ অভিসন্ধি করিয়া অস্তাচল চূড়াবলম্বী হইলেন এবং বিশ্বসংসার সংহার করিবার মানসে স্বকীয় তেজোরাশি পরিবর্দ্ধিত করিতে লাগিলেন। তদনন্তর মহর্ষিগণ দেবতাদিগের নিকট গমন করিয়া কহিলেন, “অদ্য নিশীথসময়ে সর্ব্বলোকভয়াবহ মহাদাহ আরম্ভ হইবে।”
তখন দেবগণ মহর্ষিদিগের সমভিব্যাহারে সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার নিকট উপনীত হইয়া বিনীতবচনে নিবেদন করিলেন, “ভগবান্! কোথা হইতে ভয়ঙ্কর মহাদাহ উপস্থিত হইল? সূর্য্য লক্ষিত হইতেছে না, অথচ সর্ব্বলোকক্ষয় উপস্থিত। না জানি, সূর্য উদিত হইলে কি দুর্দ্দশা ঘটিবে।” পিতামহ কহিলেন, “দিবাকর সর্ব্বসংহারে উদ্যত হইয়াছেন। তিনি উদিত হইয়া ক্ষণকালমধ্যেই আমাদিগের সমক্ষে সমস্ত লোক ভস্মসাৎ করিবেন; কিন্তু ইতিপূর্ব্বেই আমি ইহার প্রতি বিধান করিয়া রাখিয়াছি। মহাত্মা কশ্যপের অরুণ নামে এক মহাবীর্য্যসম্পন্ন পুৎত্র জন্মিয়াছে। সে সূর্য্যের সম্মুখে থাকিয়া তাঁহার সারথ্য-কার্য্য করিবে এবং তদীয় তেজঃ প্রতিসংহার করিবে; তাহা হইলেই দেবগণ, ঋষিগণ ও সমস্ত লোকের মঙ্গললাভের সম্ভাবনা।” প্রমতি কহিলেন, “তদনন্তর অরুণ পিতামহের আদেশানুসারে সূর্য্য উদিত হইলেই তাঁহাকে আবরণ করিয়া তদীয় সম্মুখে উপবিষ্ট রহিলেন। সূর্য্যদেব যে কারণে কোপাক্রান্ত হইয়াছিলেন এবং অরুণ যে নিমিত্ত তাঁহার সারথ্য-স্বীকার করেন, তাহা আদ্যোপান্ত সমুদয় কীর্ত্তন করিলাম। এক্ষণে পূর্ব্বোল্লিখিত প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর।”