২৩তম অধ্যায়
অর্জ্জুনবাক্যে মহর্ষি ব্যাসের সমর্থন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! ধৰ্ম্মনন্দন যুধিষ্ঠির অর্জ্জুন কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কিছুই উত্তর প্রদান করিলেন না। তখন মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! অৰ্জ্জুন যাহা কহিলেন, সমুদয়ই যথার্থ; শাস্ত্রানুসারে গৃহস্থাশ্রমেই পরমধর্ম্মলাভ হয়। গৃহস্থধৰ্ম্ম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অরণ্যে বাস করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। দেবতা, পিতৃলোক ও অতিথি গৃহস্থকেই আশ্রয় করিয়া পরিতৃপ্ত হয়েন। ভৃত্যগণ ও পশু-পক্ষী প্রভৃতি প্রাণীসমুদয় গৃহস্থের নিকট প্রতিপালিত হয়; অতএব গৃহী সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও গার্হস্থ্যধৰ্ম্ম প্রতিপালন সর্বাপেক্ষা দুষ্কর। অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি কদাপি ধৰ্ম্মপ্রতিপালনে সমর্থ হয় না। এক্ষণে তুমি গার্হস্থ্যধৰ্ম্মানুষ্ঠানেই যত্ন কর। তোমার বেদজ্ঞান ও প্রভূত তপঃসাধন হইয়াছে, অতঃপর পৈতৃক রাজ্যভার বহন করাই তোমার কর্ত্তব্য। তপস্যা, যজ্ঞ, ক্ষমা, বিদ্যা, ভিক্ষা, ইন্দ্রিয়সংযম, ধ্যান, একান্ত শীলতা[সচ্চরিত্রতা], তুষ্টি ও জ্ঞান ব্রাহ্মণদিগের ধর্ম্ম। আর যজ্ঞানুষ্ঠান, বিদ্যোপার্জ্জন, পৌরুষপ্রকাশ, সম্পদে অসন্তোষ, দণ্ডধারণ, উগ্রতা, প্রজাপালন, বেদজ্ঞান, বিবিধ তপানুষ্ঠান, প্রভূত ধনোপার্জ্জন ও যোগ্যপাত্রে দান এই সমস্ত কাৰ্য্য ভূপালগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। এই সকল কর্ম্মপ্রভাবেই ক্ষত্রিয়েরা উভয় লোকে জয়লাভ করিয়া থাকেন। ঐ সমুদয়ের মধ্যে দণ্ড ধারণই সৰ্ব্বপ্রধান। সেই দণ্ড আপনার বলসাপেক্ষ; সুতরাং সেই বলই ক্ষত্রিয়ের মহদ্গুণ। বৃহস্পতি এই গাথা গান করিয়া গিয়াছেন যে, সর্প যেমন মূষিকদিগকে গ্রাস করে, তদ্রূপ পৃথিবী যুদ্ধনৈপুণ্যবিহীন রাজা ও অপ্রবাসী ব্রাহ্মণকে নষ্ট করিয়া থাকেন। হে মহারাজ! রাজর্ষি সুদ্যুম্ন দণ্ডধারণ করিয়া দক্ষ প্রজাপতির ন্যায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন।”
সুদ্যুন্ন-সিদ্ধিপ্রসঙ্গে মহর্ষি শঙ্খ-লিখিত-সংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন্! মহারাজ সুদ্যুম্ন কিরূপে সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করিবার নিমিত্ত নিতান্ত বাসনা হইয়াছে, আপনি ঐ বিষয় কীৰ্ত্তন করুন।”
বেদব্যাস কহিলেন, “মহারাজ! পুরাতন ইতিহাসে কীৰ্ত্তিত আছে যে, শংসিতব্রত [উগ্রতপস্বী] শঙ্খ ও লিখিতনামে দুই সহোদর বাহুদানদীর অনতিদূরে পৃথক পৃথক আশ্রম নির্ম্মাণ করিয়া বাস করিতেন। ঐ আশ্রমদ্বয় পুষ্পফলান্বিত পাদপসমূহে পরিশোভিত ছিল। একদা মহর্ষি লিখিত স্বীয় জ্যেষ্ঠভ্রাতা শঙ্খের আশ্রমে সমুপস্থিত হইলেন। তপোধন শঙ্খ ঐ সময় স্বীয় আবাস হইতে বহির্গত হইয়াছিলেন। লিখিত জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে আশ্রমে না দেখিয়া তত্ৰত্য বৃক্ষ হইতে সুপক্ক ফলসমুদয় আহরণপূৰ্ব্বক ভক্ষণ করিতে লাগিলেন। লিখিত বিশ্রদ্ধচিত্তে[বিশ্বস্ত-হৃদয়ে] ফল ভক্ষণ করিতেছিলেন, এমন সময়ে শঙ্খ স্বীয় আশ্রমে উপনীত হইলেন। তিনি লিখিতকে ফল ভক্ষণ করিতে দেখিয়া কহিলেন, “ভ্রাতঃ! তুমি এই সকল ফল কোথায় পাইলে?’ তখন লিখিত তাঁহার সমীপে আগমন ও তাঁহাকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক হাস্যমুখে কহিলেন, “মহাশয়! আমি আপনারই আশ্রম হইতে এই সমস্ত ফল গ্রহণ করিয়াছি। তখন শঙ্খ ক্রোধাবিষ্টচিত্তে কনিষ্ঠকে কহিলেন, “ভ্রাতঃ! তুমি আমার অজ্ঞাতসারে ফলগ্রহণ করিয়া চৌরের কৰ্ম্ম করিয়াছ। অতএব অচিরাৎ রাজার নিকট গমনপূৰ্ব্বক আত্মদোষ প্রকাশ করিয়া উপযুক্ত দণ্ড প্রার্থনা কর।’
“তখন ভগবান্ লিখিত জ্যেষ্ঠভ্রাতার আদেশানুসারে অবিলম্বে সুদ্যুম্নরাজার দ্বারদেশে সমুপস্থিত হইলেন। মহারাজ সুদ্যুম্ন দ্বারপালপ্রমুখাৎ ভগবান্ লিখিতের আগমনবার্তা শ্রবণ করিয়া অমাত্যগণসমভিব্যাহারে পদব্রজে তাঁহার নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন? আজ্ঞা করুন, আমাকে কি করিতে হইবে?’ তখন মহাত্মা লিখিত কহিলেন, ‘মহারাজ! আপনি আমার বাক্য রক্ষা করিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, অতএব আমি যাহা কহিব, কদাচ তাহার অন্যথা করিতে পারিবেন না। আমি জ্যেষ্ঠভ্রাতার অনুমতি না লইয়া তাঁহার আশ্রমের ফল ভক্ষণপূৰ্ব্বক চৌরের কাৰ্য্য করিয়াছি, আপনি অচিরাৎ আমায় শাসন করুন।’ তখন সুদ্যুম্ন কহিলেন, ‘ভগবন্! রাজা অপরাধীর প্রতি দণ্ডবিধানের ন্যায় তাহার দোষ মার্জ্জনাও করিতে পারেন। আপনি ব্রতপরায়ণ ও পবিত্র কৰ্ম্মশালী, অতএব আমি আপনার দোষ মার্জ্জনা করিলাম। এক্ষণে আপনি দণ্ডবিধান ভিন্ন আর কি প্রার্থনা করেন?’
“হে মহারাজ! মহাত্মা সুদ্যুম্ন এই কথা কহিলে দ্বিজবর লিখিত কোনরূপ অন্য কিছুই প্রার্থনা করিলেন না; প্রত্যুত বারংবার ভূপতিকে দণ্ডবিধানার্থ অনুরোধ করিতে লাগিলেন। তখন মহারাজ সুদ্যুম্ন সেই মহাত্মার করদ্বয় ছেদন করিয়া তাঁহাকে সমুচিত দণ্ড প্রদান করিলেন। মহানুভব লিখিত এইরূপে দণ্ডিত হইয়া জ্যেষ্ঠভ্রাতা শঙ্খের নিকট আগমনপুৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ভগবন্! ভূপতি আমার প্রতি এই দণ্ডবিধান করিয়াছেন; এক্ষণে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’ তখন.শঙ্খ কহিলেন, ‘ভ্রাতঃ! আমি তোমার প্রতি কুপিত হই নাই। তোমাকে ধৰ্ম্ম অতিক্রম করিতে দেখিয়া তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করাইলাম। এক্ষণে তুমি অবিলম্বে বাহুদানদীতে গমন করিয়া বিধিপূৰ্ব্বক দেবতা, ঋষি ও পিতৃগণের তর্পণ কর, আর কদাপি অধর্ম্মে প্রবৃত্ত হইও না।’ ভগবান্ লিখিত শঙ্খের বাক্য শ্রবণ করিয়া তৎক্ষণাৎ সেই পবিত্ৰনদীতে অবগাহনপূৰ্ব্বক তৰ্পণ করিবার উপক্রম করিলেন। তিনি তৰ্পণ করিতে উদ্যত হইলেই তাহার বাহুদ্বয় পুনরায় প্রাদুর্ভূত হইল। মহাত্মা লিখিত তদ্দর্শনে বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে স্বীয় করদ্বয় প্রদর্শন করাইলেন। তখন শঙ্খ কহিলেন, ‘ভ্রাতঃ! এ বিষয়ে অন্য কোন আশঙ্কা করিও না, আমার তপঃপ্রভাবেই এইরূপ হইয়াছে।’ মহাত্মা লিখিত ভ্রাতার বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘মহাশয়! যদি আপনার ঈদৃশ তপঃপ্রভাব, তবে কেন আমাকে রাজসন্নিধানে প্রেরণ না করিয়া পবিত্র করিলেন না?’ তখন শঙ্খ কহিলেন, ‘ভ্রাতঃ! তোমার দণ্ডবিধানে ত’ আমার অধিকার নাই। এই নিমিত্তই তোমাকে রাজসন্নিধানে প্রেরণ করিয়াছিলাম। এক্ষণে তোমার দণ্ডনিবন্ধন সেই দণ্ডধর ভূপতি ও তুমি-তোমরা উভয়েই পিতৃলোকের সহিত পবিত্রতা লাভ করিয়াছ।’ ”
বেদব্যাস কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! মহারাজ সুদ্যুম্ন এইরূপে মহাত্মা লিখিতের দণ্ডবিধান করিয়া দক্ষ প্রজাপতির ন্যায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন। অতএব প্রজাপালন ও দণ্ডবিধানই ক্ষত্রিয়ের প্রধান ধৰ্ম্ম। মুণ্ডব্রত [সন্ন্যাসীর ধৰ্ম্ম] অবলম্বন ক্ষত্রিয়ের কর্ত্তব্য নহে। এক্ষণে তুমি শোকপরিত্যাগপূৰ্ব্বক অর্জ্জুনের হিতকর বাক্য শ্রবণ কর।”