২৩তম অধ্যায়
অর্জ্জুনকৃত দুর্গাস্তব
সঞ্জয় কহিলেন, “রাজন। ভগবান বাসুদেব দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণকে সমরোদ্যত নিরীক্ষণ করিয়া অর্জ্জুনের হিতার্থ পুনরায় কহিলেন, “হে মহাবাহো! শক্রগণের পরাজয়ের নিমিত্ত পবিত্র ও সংগ্রামাভিমুখ হইয়া দুৰ্গার স্তব কর।”
“অর্জ্জুন ধীমান বাসুদেবের বাক্যানুসারে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে স্তোত্র আরম্ভ করিলেন।
“ ‘হে সিদ্ধসেনানি! আৰ্য্যে! মন্দরবাসিনি! কুমারি! কালি! কপাল! কপিলে! কৃষ্ণপিঙ্গলে! তোমাকে নমস্কার; হে ভদ্রকালি! তোমাকে নমস্কার; হে মহাকালি! তোমাকে নমস্কার; হে চণ্ডি! হে চণ্ডে! তোমাকে নমস্কার; হে তারিণি! বরবর্ণিনি! কাত্যায়নি! মহাভাগে! করালি! বিজয়ে! জয়ে! শিখিপুচ্ছধিবজধরে! নানাভরণভূষিতে! অট্টশূলপ্রহরণে! খড়গখেটকধারিণি! গোপেন্দ্রানুজে! জ্যেষ্ঠে! নন্দগোপকুলসম্ভবে! মহিষরুধিরপ্রিয়ে! কৌশিকি! পীতবাসিনি! অট্টহাসে! কোকমুখে! রণপ্ৰিয়ে! তোমাকে নমস্কার; হে উমে! শাকম্ভরি! শ্বেতে! কৃষ্ণে! কৈটভনাশিনি। হিরণ্যাক্ষি! বিরূপাক্ষি! ধূম্রাক্ষি! তোমাকে নমস্কার। তুমি বেদশ্রবণজনিত মহাপুণ্যস্বরূপ, ব্ৰহ্মণ্যস্বরূপ এবং হুতাশনস্বরূপ, তুমি জম্বুকটক [জম্বুদ্বীপের রাজধানী] ও চৈত্য [দেবালয়] সন্নিধানে নিরন্তর অবস্থান কর; তুমি সমুদয় বিদ্যার মধ্যে ব্রহ্মবিদ্যা ও দেহিগণের মহানিদ্রা। হে স্কন্দজননি। ভগবাতি! দুৰ্গে। কান্তারবাসিনি! তুমি স্বাহা, স্বধা, কলা, কাষ্ঠা, সরস্বতী, সাবিত্রী, বেদমাতা ও বেদান্ত। আমি বিশুদ্ধ অন্তরাত্মার সহিত তোমাকে স্তব করিতেছি; তোমার প্ৰসাদে রণক্ষেত্রে যেন জয়লাভ করিতে সমর্থ হই। তুমি ভক্তগণের রক্ষার নিমিত্ত দুৰ্গম পথে, ভয়ে, দুৰ্গম স্থানে ও পাতালে নিত্য বাস এবং দানবগণকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া থাক। তুমি জ্বম্ভণী, মোহিনী, মায়া, হ্রী, শ্ৰী, সন্ধ্যা, প্রভাবতী, সাবিত্রী, জননী, তুষ্টি, পুষ্টি, ধতিৃ, চন্দ্ৰসূৰ্য্যবিবৰ্দ্ধিনী, দীপ্তি ও সম্পন্নদিগের সম্পত্তি। সিদ্ধচারণগণ সমরভূমিতে তোমাকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন।”
দুৰ্গার বরদান
“মানববৎসলা [মানুষপ্রিয়া-মানবের প্রতি স্নেহযুক্তা] বরদা ভগবতী কৌন্তেয়ের ভক্তি দেখিয়া অন্তরীক্ষে আগমন ও বাসুদেবের সম্মুখে অবস্থান করিয়া কহিলেন, “হে বীর! তুমি অল্পকাল মধ্যেই অরাতিগণকে পরাজিত করিবে; তুমি নর; নারায়ণ তোমার সহায়; অন্য শত্রুর কথা কি, স্বয়ং বজ্রধর ইন্দ্ৰও তোমাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয়েন না।” ইহা কহিয়া দেবী তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হইলেন।
“পাণ্ডুনন্দন ধনঞ্জয় বরলাভপূর্ব্বক জয়লাভে কৃতনিশ্চয় হইয়া রথে আরোহণ করিলেন এবং বাসুদেবের শঙ্খধ্বনির সহিত নিজ শঙ্খ ধ্বনিত করিতে লাগিলেন।
“যে ব্যক্তি প্ৰাতঃকালে গাত্ৰোত্থান করিয়া এই স্তোত্র পাঠ করেন, যক্ষ, রক্ষ, পিশাচ, শত্ৰু, সর্পপ্রভৃতি এবং দংষ্ট্রী ও রাজকুল [রাজপুরুষগণ-সমরবিভাগীয় ফৌজদারগণ] হইতে তাঁহার ভয় থাকে না; তিনি বিবাদে ও সংগ্রামে জয়প্রাপ্ত, বন্ধন ও চৌর [চোর] হইতে বিমুক্ত, দুর্গ হইতে উত্তীর্ণ, লক্ষ্মীবান এবং আরোগ্য ও বলসম্পন্ন হইয়া শতবর্ষজীবিত থাকেন। আমি ধীমান ব্যাসের প্রসাদে ঐ সকল ঘটনা দর্শন করিয়াছি। আপনার কোপনস্বভাব দুরাত্মা পুত্ৰগণ কালপাশে অবগুন্ঠিত [আবত-বদ্ধ] হইয়া মোহবশতঃ মহর্ষি নর ও নারায়ণকে জানিতে পারেন নাই। ব্যাস, নারদ, কণ্ব, পরশুরাম ও মহর্ষি নর দুৰ্য্যোধনকে বারণ করিয়াছিলেন; তিনি তাঁহাদিগের সেই সময়োচিত বাক্য গ্ৰহণ করেন নাই। কিন্তু যেস্থানে ধর্ম্ম, সেই স্থানে দ্যুতি ও কান্তি; যেখানে হ্রী, সেই স্থানে শ্ৰী ও বুদ্ধি; যেস্থানে ধর্ম্ম, সেই স্থানেই কৃষ্ণ ও যেস্থানে কৃষ্ণ, সেই স্থানেই জয়।”