২২তম অধ্যায়
কৃষ্ণকর্ত্তৃক শান্বসেনা নিধন
“হে ভরতশ্রেষ্ঠ! তদনন্তর আমি রুচির [প্রভাভাস্বর—সমুজ্জ্বল] কার্ম্মুক গ্রহণপূর্ব্বক সুরারি অসুরদিগের মস্তকচ্ছেদন করিয়া সৌভ হইতে পাতিত এবং শাল্বরাজের বিনাশার্থ আশীবিষাকার উৰ্দ্ধগামী সুতীক্ষ্ন শরসমূহ নিক্ষেপ করিলাম; কিন্তু মায়াবলে সৌভনগর যে কোথায় অন্তর্হিত হইল, কিছুই জানিতে না পারিয়া আমি বিস্ময়াবিষ্ট হইলাম। তৎপরে অতি ভীষণাকার দানবেরা আসিয়া আমার সমক্ষে চীৎকার করিতে লাগল। তাহাদিগের বিধার্থ সত্বর শব্দসাহ [শব্দ অনুসারে গতিশীল—যেদিকে শব্দ হয়। সেই দিকে ধাবনশীল] অস্ত্ৰযোজনা করিবামাত্র নিবৃত্ত ও শব্দকারী দানবেরাও নিহত হইল। সে শব্দ নিরস্ত হইলে অন্যত্র অপর শব্দ সমুদ্ভূত হইতে লাগিল। এইরূপে অম্বরতল, ভূমণ্ডল, তিৰ্য্যকপ্রদেশ ও দশদিক, সর্ব্বত্র দানবনাদে নিনাদিত হইল; আমিও শরাঘাতে দুবৃত্ত দানবদল নিহত করিলাম।
“অনন্তর পূর্ব্বাভিমুখে গমন করিয়া পুনরায় দৃষ্টিমোহয়িতা [দৃষ্টিবিভ্রমকারক] কামচারী সৌভনগর দর্শন করিলাম। তথায় সেই দারুণাকৃতি দানসকল শিলাবর্ষণদ্বারা আমাকে আচ্ছন্ন করিলে, আমি বাল্মীকের ন্যায় শিলাপরিবৃত হইয়া পর্ব্বততুল্য উপচীয়মান [বাল্মীকিস্তুপসদৃশ–উই-এর ঢিপির মত পুঞ্জীকৃত] হইলাম ও আমার অশ্ব, রথ, সারথি, সকলেই শিলাখণ্ডে আচ্ছাদিত হইল। আমাকে শিলাবগুণ্ঠিত দেখিয়া বৃষ্ণিপ্রবীর মদীয় সৈনিকেরা সহসা ভয় পাইয়া দিকে দিকে পলায়ন করিতে লাগিল। হে রাজন! আমি দৃষ্টির অগোচর হইবামাত্র ত্ৰিদশালয়, ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল হাহাকার শব্দে পরিপূর্ণ হইল। বান্ধবগণ আমার আদর্শজনিত শোকে বিষণ্ন হইয়া সাশ্রুমুখে মুক্তকণ্ঠে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। বিপক্ষের হর্ষসাগরে ও আত্মীয়গণ বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন। আমি পশ্চাৎ শ্রবণ করিলাম, শাল্বরাজ এইরূপে জয়লাভ করিয়াছিল।
“অনন্তর আমি ইন্দ্রদয়িত পাষাণবিদারক বজ্র উত্তোলনপূর্ব্বক শিলাসকল খণ্ড খণ্ড করিতে লাগিলাম, কিন্তু আমার ক্ষুদ্রপ্রাণ অশ্বসকল দুর্ভর ভূধরভারে নিতান্ত আর্ত্ত ও একান্ত কম্পিতকলেবর হইয়াছিল। যেমন মেঘাবরণ বিদারণপূর্ব্বক সমুদিত কমলিনীনায়ক নিরীক্ষণ করিয়া লোকের অন্তঃকরণ প্রীতিপ্ৰফুল্ল হয়, তদ্রূপ আমাকে পর্ব্বতনিমুক্ত দেখিয়া বান্ধবগণ হর্ষে পুলকিত হইলেন। সারথি পর্ব্বতনিপীড়িত অশ্বগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া তৎকালোচিত বাক্যে আমাকে কহিল, “হে বৃষ্ণিপ্রবীর! ঐ দেখ, সৌভাপতি শাল্ব স্বচ্ছন্দে অবস্থিতি করিতেছে, অতএব উপেক্ষার আর প্রয়োজন নাই; সরলভাব ও বন্ধুত্ব পরিত্যাগপূর্ব্বক প্ৰযত্নাতিশয়সহকারে শাল্বের প্রাণসংহার কর; উহাকে জীবিত রাখা কোনক্রমেই যুক্তিসিদ্ধ বোধ হইতেছে না! হে বীর! শত্রু সর্ব্বতোভাবে বাধার্হ, সে দুর্ব্বল হইলেও বলবানের অনুপেক্ষণীয়। যে ব্যক্তি ত্বদীয় পাদপীঠে নতশিরঃ হইয়া থাকিত, সেই এক্ষণে রণস্থলে উপস্থিত হইয়া তোমার সহিত যুদ্ধ করিতেছে, অতঃপর আর কালতিক্রম করা বিধেয় হয় না; তুমি শীঘ্র উহার বধসাধনে যত্নবান হও। হে বৃষ্ণিকুলশ্রেষ্ঠ! যে তোমার সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছে ও যৎকর্ত্তৃক দ্বারকা ছিন্নভিন্ন হইয়াছে, তাহাকে সখা বিবেচনা করিও না, সেই দুরাত্মা কখনই ঋজুতায় বশীভূত হইবে না।”
“হে কৌন্তেয়! আমি সারথির এবংবিধ বাক্যশ্রবণে সমুদয় উপদেশ যথার্থ বিবেচনা করিয়া সৌভনিপাতনে ও শাল্ববধে।কৃতনিশ্চয় হইয়া দারুককে কহিলাম, “সারথে! তুমি মুহূর্ত্তকাল অবস্থিতি কর, আমি সকল দানবই নিপাত করিতেছি।”
সৌভনগরী ধ্বংস—শাল্ববধ
“অনন্তর দানবান্তকারী, অপ্ৰতিহতগতি, দিব্য আগ্নেয়াস্ত্ৰ শরাসনে যোজনা করিলাম এবং যক্ষ, রাক্ষস, দানব ও বিপক্ষ রাজগণের ভস্মান্তকারী, অরাতিকুলবিমর্দ্দন, সাক্ষাৎ কৃতান্তস্বরূপ, ক্ষুরধার চক্রকে অনুমন্ত্রণপূর্ব্বক, ‘তুমি স্বীয় বীৰ্য্যপ্রভাবে সৌভনগর ও তত্রস্থ সমস্ত রিপুগণ নিহত কর’, এই কথা বলিয়া বাহুবলে সুদৰ্শনকে সৌভের প্রতি প্রেরণ করিলাম। সুদৰ্শন ব্যোমতলে উপনীত হইয়া যুগান্তকালোদিত দ্বিতীয় আদিত্যের ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিল। করপত্ৰ [করাত] যেমন বিশাল দারু বিদারণ করে, তদ্রূপ সুদৰ্শন সৌভনগরের মধ্যস্থল বিদীর্ণ করিয়া দ্বিখণ্ড করিল। ত্রিপুর যেমন মহাদেবের শরাঘাতে নিপতিত হইয়াছিল, সেইরূপ সুদৰ্শনদ্বারা দ্বিধাকৃত সৌভনগরও ভূতলে পতিত হইল। অনন্তর চক্ৰ আমার নিকট প্রত্যাগমন করিলে, আমি তাহাকে গ্ৰহণ করিয়া শাল্বদেশে নিক্ষেপ করিলাম। চক্ৰ শাল্বকে দ্বিধাকৃত ও সমরশায়ী করিয়া প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিল দেখিয়া ভগ্নীমনোরথ উৎকলিকাকুল দানবেরা মদীয় শরনিপীড়িত হইয়া হাহাকারপূর্ব্বক ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল। অনন্তর আমি সৌভসমীপে রথ সংস্থাপনপূর্ব্বক শঙ্খধ্বনি করিয়া বান্ধবগণের আনন্দবৰ্দ্ধন করিলাম। তত্ৰত্য স্ত্রীগণ মেরুশিখরাকার ভগ্ন অট্টালিকার গোপুরসকল দাহ্যমান হইতেছে নিরীক্ষণ করিয়া ভয়ে পলায়ন করিল। এইরূপে সৌভ নিপতিত ও শাল্ব নরাধিপ নিহত হইলে, আমি দ্বারকায় প্রত্যাগমনপূর্ব্বক সুহৃদ্বর্গের প্রীতিবৰ্দ্ধন করিলাম।
কৃষ্ণ প্রভৃতির স্বস্ব স্থানে প্ৰস্থান
“হে রাজন! এই সমস্ত কারণবশতঃ আমি বারণাবতে আগমন করিতে পারি নাই। যদি তৎকালে উপস্থিত থাকিতাম, তাহা হইলে দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন জীবিত থাকিত না, অথবা যুষ্মদশিববিধায়িনী [আপনাদের অকল্যাণকরী] দ্যূতক্ৰীড়া কদাচ ঘটিত না। এক্ষণে কি করিব, সেতু ভিন্ন হইলে জলবেগ নিবারণ করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে।”
শ্ৰীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলিয়া তাহাকে অভিবাদন ও অন্যান্য পাণ্ডবদিগকে যথাবিধি আমন্ত্রণপূর্ব্বক বিদায় হইলেন। ধর্ম্মরাজ ও ভীমসেন তাহার মস্তকাঘ্রাণ, অর্জ্জুন আলিঙ্গন, নকুল ও সহদেব অভিবাদন, ধৌম্য তাঁহার যথোচিত সম্মান এবং দ্ৰৌপদী প্রণয়সুশীতল অশ্রুবিমোচনদ্বারা কৃষ্ণের সৎকার করিলেন। পুরুষোত্তম মধুসূদন পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক এইরূপে পূজিত হইয়া যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক সুভদ্রা ও অভিমন্যুসমভিব্যাহারে সুগ্ৰীবসংযুক্ত মনোহর কাঞ্চনরথে আরোহণপূর্ব্বক দ্বারকায় যাত্ৰা করিলেন। কৃষ্ণ প্রস্থান করিলে ধৃষ্টদ্যুম্ন আত্মীয়স্বজন-সমভিব্যাহারে স্বপুরে ও চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু পাণ্ডবদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া স্বীয় ভগিনী নকুলভাৰ্য্যা করেণুমতীকে লইয়া রমণীয় শক্তিমতীনগরে প্রস্থান করিলেন। অনন্তর কেকয়েরা যুধিষ্ঠিরের অনুমতি গ্রহণপূর্ব্বক তাহাদিগকে সম্ভাষণ করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও জনপদবাসীদিগকে পুনঃ পুনঃ বিদায় করিলেও তাঁহারা কোনক্রমে পাণ্ডবসহবাস করিতে না পারিয়া একত্ৰ কাম্যকারণ্যে বাস করিতে লাগিলেন। মহানুভব যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণের সম্মান রক্ষা করিয়া ভৃত্যবর্গের প্রতি রথসজ্জা করিবার আদেশ দিলেন।