১৮শ অধ্যায়
শাল্বকর্ত্তৃক আহত প্ৰদ্যুম্নসহ পলায়মান-সারথির প্রতি প্রদ্যুম্নের প্রবোধবাক্য
শ্ৰীকৃষ্ণ কহিলেন, “এইরূপে বীরবরাগ্রগণ্য প্ৰদ্যুম্ন শাল্ববাণে মূর্চ্ছিত হইলে বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ নিতান্ত ভগ্নোৎসাহ ও একান্ত ব্যথিত হইল। বৃষ্ণি ও অন্ধকপক্ষীয় সমুদয় সৈন্য হাহাকার করিতে লাগিল ও শত্রুপক্ষীয় সমস্ত লোক সাতিশয় প্রীতিলাভ করিল। প্ৰদ্যুম্নকে মোহিত দেখিয়া তাহার সারথি সুশিক্ষিত দারুকানন্দন সত্বর তাঁহাকে রথে আরোহণ করাইয়া রণভূমি হইতে নিঃসারিত করিল। সারথি রথ লইয়া রণস্থল হইতে অনতিদূরে গমন করিলে প্রদ্যুম্ন চেতনাপ্রাপ্ত হইয়া তাহাকে
কহিতে লাগিল, “হে সূতপুত্র! তুমি কি নিমিত্ত আমাকে লইয়া সমরভূমি হইতে প্রস্থান করিলে? এ কদাচ বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণের ধর্ম্ম নহে। তুমি রণস্থলে শাল্বকে দেখিয়া কি মুগ্ধ হইয়াছ? অথবা তুমুল সংগ্রামসন্দর্শনে বিষণ্ন হইয়া এরূপ অন্যায় আচরণ করিয়াছ? সত্য করিয়া বল।”
“তখন সারথি কহিল, “হে কেশবনন্দন! আমার মোহ বা ভয় কিছুই হয় নাই; কেবল পাপাত্মা শাল্ব সাতিশয় বলবান ও আপনিও শরাঘাতে মোহপ্রাপ্ত হইয়াছেন দেখিয়া আমি আপনাকে লইয়া শনৈঃ শনৈঃ পলায়ন করিতেছি। হে মহাত্মন! রখী মূর্চ্ছিত হইলে তাঁহাকে রক্ষা করা সারথির কর্ত্তব্য কর্ম্ম। হে আয়ুষ্মান! আমি আপনার যেরূপ রক্ষণীয়, আপনিও আমার তদ্রূপ, এই নিমিত্তই আমি আপনাকে লইয়া অপসৃত হইয়াছি। হে মহাবাহো! আপনি একাকী ও দানবেরা বহুসংখ্যক, এই বিষম সংখ্যা দেখিয়া আমি আপনাকে রথে লইয়া রণস্থল হইতে প্ৰস্থান করিয়াছি।”
“প্রদ্যুম্ন দারুকাত্মজের বাক্য-শ্রবণানন্তর তাহাকে পুনরায় রণস্থলে রথ লইয়া গমন করিতে আদেশ করিল এবং কহিল, “হে সূতনন্দন! তুমি আর কখন এমন কর্ম্ম করিও না; আমি জীবিত থাকিতে কদাচ রথ লইয়া পলায়নপরায়ণ হইও না। যে ব্যক্তি রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করে এবং যে ব্যক্তি নিপতিত, শরণাপন্ন, স্ত্রী, বৃদ্ধ, বালক ও রথশূন্য বা ভগ্নায়ুধ যোদ্ধাকে বিনষ্ট করে, সে দুরাত্মা কখনই বৃষ্ণিবংশসস্তুত নহে। হে দারুকতনয়! তুমি সূতকুলে সমুৎপন্ন ও সারথ্যকর্ম্মে সুশিক্ষিত; বিশেষতঃ বৃষ্ণিবংশীয়গণের যুদ্ধব্যবহার বিলক্ষণ জ্ঞাত আছ, অতএব আর কখন সমরস্থল হইতে রথীকে লইয়া এরূপে প্রতিনিবৃত্ত হইও না। দেখ, আমি রণ পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছি, শত্রু আমার পৃষ্ঠদেশে আঘাত করিতেছে, এই কথা শুনিয়া দূরাধর্ষ মাদাগ্রজ মাধব, কেশবাগ্রজ মহাবাহু বলদেব, শিনির নাপ্তা [পৌত্র-নাতি] মহাধনুৰ্দ্ধর নরসিংহ মহাবীর শাম্ব, চারুদেষ্ণ, গদ, সারণ ও মহাবাহু অক্রুর আমাকে কি বলিবেন? বৃষ্ণিবংশীয় বীরপুরুষগণের স্ত্রীগণ আমাকে মহাবলপরাক্রান্ত পুরুষাভিমানী মহাবীর বলিয়া জানেন; তাহারাই বা আমাকে কি বলিবেন? তাহারা কখনই আমাকে সাধুবাদ প্ৰদান করিবেন না; প্রত্যুত নিশ্চয়ই তাঁহারা কহিবেন, “ঐ প্রদ্যুম্ন ভীত হইয়া রণস্থল পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতেছে, ইহাকে ধিক!” হে সূততনয়! ধিগ্বাক্যে পরিহাস করা আমার বা মদ্বিধ ব্যক্তির পক্ষে মৃত্যু অপেক্ষাও গুরুতর; অতএব তুমি আর কখন রণস্থল পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিও না। বিশেষতঃ মধুসূদন আমার প্রতি সমস্ত ভার অর্পণ করিয়া ভরতকুলাগ্রগণ্য মহারাজ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে গমন করিয়াছেন; অতএব, রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করা আমার নিতান্ত অকর্ত্তব্য। মহাবীর হাদিকানন্দন কৃতবর্ম্মা শাম্বের সহিত সংগ্রাম করিবার নিমিত্ত গমন করিতেছিলেন; আমি তাঁহাকে “আপনি থাকুন, আমি গিয়া সত্বর পরাজয় করিতেছি,” বলিয়া নিবারণ করিলাম। তিনি তখন আমার বাক্যে নির্ভর করিয়া প্রতিনিবৃত্ত হইলেন; এখন আমি কি বলিয়া তাঁহার নিকট মুখ দেখাইব? শঙ্খচক্ৰগদাধারী দুৰ্দ্ধৰ্ষ কৃষ্ণ প্রত্যাগমন করিলে তাহাকে কি কহিব এবং সাত্যকি, বলদেব ও অন্যান্য বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় বীরপুরুষগণ সতত আমার বলবীৰ্য্যে স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাকেন, তাহাদিগকেই বা কি বলিব? হে সূতনন্দন! যদি অরিকর্ত্তৃক পৃষ্ঠদেশে আহত আমাকে তুমি রণস্থল হইতে অপসৃত করিয়া লইয়া যাও, তবে আমি নিশ্চয়ই প্রাণত্যাগ করিব। অতএব তুমি রথ লইয়া পুনরায় রণস্থলে গমন কর। নিতান্ত আপৎকালেও রণ হইতে এরূপ পলায়ন করা অকর্ত্তব্য। আমি রণ হইতে পলায়িত ও শক্ৰকর্ত্তৃক পৃষ্ঠদেশে অব্যাহত হইয়া জীবনরক্ষা করা লাভ জ্ঞান করি না। হে সূতপুত্র! তুমি কি কদাচ আমাকে ভীত হইয়া রণপরিত্যাগপূর্ব্বক কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন করিতে দেখিয়াছ? হে দারুকানন্দন! যখন আমি নিতান্ত যুদ্ধাভিলাষী হইয়াছি, তখন আমাকে লইয়া তোমার সংগ্রাম পরিত্যাগ করা নিতান্ত অকর্ত্তব্য, অতএব তুমি শীঘ্র রণস্থলে গমন কর।”