১৫তম অধ্যায়
বৃহস্পতিকৃত যজ্ঞে অগ্নি-ইন্দ্ৰ-সাক্ষাৎকার
“বৃহস্পতি কহিলেন, “হে অনল! তুমি সকল দেবতার মুখস্বরূপ তুমি হব্যবাহ [হাব্যবহনকারী-অগ্নিতে প্রদত্ত আহুতি হুতাশন বহন করিয়া লইয়া গিয়া দেবগণের মুখে পৌছাইয়া দেন]; তুমি সাক্ষীর ন্যায় সকল প্রাণীর অন্তরে গূঢ়রূপে বিচরণ কর। কবিগণ তোমাকেই একবিধ [বৈশ্বানর] ও ত্ৰিবিধ [গাৰ্হপত্য, দক্ষিণ, আহবনীয়] বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। হে হুতাশন! তোমা বিনা এই সমস্ত জগৎ ক্ষণমধ্যে বিনাশপ্ৰাপ্ত হয়; বিপ্ৰগণ তোমাকে নমস্কার করিয়া পুত্র-কলাত্ৰসমভিব্যাহারে স্বকর্মোপার্জিত শাশ্বত গতি লাভ করেন। তুমিই হব্যবাহ, তুমিই পরম হবিঃ, যজ্ঞিকেরা যজ্ঞদ্বারা তোমারই অর্চ্চনা করেন। হে হব্যবাহ! তুমি লোকত্ৰয় সৃষ্টি কর এবং কালক্রমে পুনরায় সমিদ্ধ হইয়া তাহাদিগকে দগ্ধ করিয়া থাক। হে পাবক! তুমিই নিখিল ভুবনের প্রসূতি এবং তোমাতেই সমুদয় জগৎ বিলীন হয়। মনীষিগণ তোমাকেই জলধর ও বিদ্যুৎ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। তোমা হইতে শিখাসকল বহির্গত হইয়া সমুদয় ভূতকে ধারণ করে। তোমাতেই সমুদয় জল ও সমুদয় জগৎ নিহিত হইয়া আছে। ত্ৰিলোকে কিছুই তোমার অবিদিত নাই। সকলেই স্বীয় জন্মক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইয়া থাকে; অতএব তুমি অবিশঙ্কিতচিত্তে সলিলমধ্যে প্রবেশ কর; আমি তোমাকে সনাতন ব্রাহ্মমন্ত্রে পুনরায় বৰ্দ্ধিত করিব।” কবিপ্রধান হব্যবাহ বৃহস্পতিকর্ত্তৃক এইরূপ সংস্তুত হইয়া প্রীতিপূর্ব্বক কহিলেন, ‘আমি সত্য কহিতেছি, পুরন্দরকে আপনার নয়নগোচর করিব।”
“অনন্তর যে স্থানে শতক্রতু প্রচ্ছন্ন হইয়া অবস্থান করিতেছেন, ভগবান হুতাশন সলিলে প্রবেশপূর্ব্বক ক্ৰমে ক্ৰমে সমুদ্র ও পল্বল [অল্পজলযুক্ত জলাশয়] সকল অতিক্রম করিয়া সেই সরোবরে আগমন করিলেন; তথায় তিনি কমলদল অন্বেষণ করিয়া মৃণালতন্তুর অভ্যন্তরবর্ত্তী দেবরাজকে অবলোকন করিবামাত্র অতিমাত্র বেগে প্রত্যাগত হইয়া বৃহস্পতিকে কহিলেন, “হে সুরাচাৰ্য্য! দেবরাজ অণুমাত্র কলেবর ধারণ করিয়া বিসতন্তুর অভ্যন্তরে বিলীন হইয়া আছেন।”
“তখন বৃহস্পতি দেব, ঋষি ও গন্ধর্ব্বগণসমভিব্যাহারে ইন্দ্ৰসমীপে আগমন করিয়া, তৎকৃত পুরাতন কর্ম্মসকল উল্লেখপূর্ব্বক তাঁহার স্তব করিতে লাগিলেন, “হে শত্ৰু! তুমি নিদারুণ নমুচি, মহাবল বল ও শম্বর দৈত্যকে নিহত করিয়াছ, এক্ষণে পরিবর্দ্ধিত হইয়া আরাতিগণকে বিনষ্ট কর। হে ইন্দ্ৰ! তুমি উত্থিত হইয়া অবলোকন কর, দেবতা ও ঋষিগণ তোমার নিকট সমাগত হইয়াছেন। তুমি দানবগণকে সংহার করিয়া সমস্ত লোক রক্ষা করিয়াছ। তুমি বিষ্ণুতেজঃপ্রজ্বলিত ফেন গ্রহণ করিয়া বৃত্ৰাসুরকে বধ করিয়াছ। তুমি সর্ব্বভূতের শরণ্য ও স্তবনীয়; তোমার সমান আর কেহই নাই; তুমি সকল প্রাণীকে ধারণ ও দেবগণকে মহিমান্বিত করিয়াছ; এক্ষণে বলবান হইয়া সকল লোক রক্ষা কর।”
বৃহস্পতিকৃত স্তবে ইন্দ্রের তেজোবৃদ্ধি
“দেবগুরু বৃহস্পতি এইপ্ৰকার স্তব করিলে পর ভগবান ইন্দ্র ক্ৰমে ক্রমে পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিলেন। পরিশেষে স্বীয় কলেবর গ্রহণপূর্ব্বক বলবান হইয়া কহিলেন, “হে সুরাচাৰ্য্য! আমি মহাসুর তুষ্টনন্দন ও লোকবিনাশী বৃত্ৰকে সংহার করিয়াছি, এক্ষণে আপনাদের আর কি কাৰ্য্য অবশিষ্ট আছে?”
“বৃহস্পতি কহিলেন, ‘দেবরাজ! নহুষনামা একজন মানবরাজ দেবর্ষিগণের তেজে দেবরাজ্য প্রাপ্ত হইয়া আমাদিগের অত্যন্ত বিঘ্ন করিতেছেন।”
“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “মহাশয়! রাজা নহুষ কীদৃশ তপস্যা ও পরাক্রম-প্রভাবে অসুলভ দেবরাজ্য প্রাপ্ত হইয়াছেন?”
“বৃহস্পতি কহিলেন, “হে মহেন্দ্র! তুমি ইন্দ্ৰত্ব পরিত্যাগ করিলে দেব, পিতৃগণ, ঋষি ও প্রধান প্রধান গন্ধর্ব্বগণ ভীত হইয়া নহুষসমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে নহুষ! আপনি আমাদিগের রাজা হইয়া সমুদয় ভুবন রক্ষা করুন।’ নহুষ কহিলেন, ‘আমি সামৰ্থ্যশূন্য হইয়াছি; তোমরা স্বস্ব তপস্যা ও তেজোদ্বারা আমার তেজস্বিতা সম্পাদন কর।” তখন তাঁহারা তাঁহাকে তেজস্বী করিলে সেই দুরাত্মা দেবরাজ্যে অধিরূঢ় হইয়া এক্ষণে মহর্ষিগণকে বাহন করিয়া লোকলোকান্তরে গমন করিতেছে। তুমি সেই তেজোহর দৃষ্টিবিষ নহুষকে কদাপি দৃষ্টিগোচর কর নাই। নিতান্ত কাতর দেবগণ গৃঢ়রূপে বিচরণ করিয়াও তাঁহাকে দর্শন করেন না।”
যজ্ঞ পুষ্ট লোকপালগণের নহুষনাশমন্ত্রণা
“বৃহস্পতি এইরূপ কহিতেছেন, এমন সময় কুবের, যম ও সোম প্রভৃতি লোকপালগণ তথায় আগমন করিয়া কহিলেন, “হে ইন্দ্ৰ! ভাগ্যক্রমে আপনি ত্বষ্টৃনন্দন [ত্রিশিরা] ও বৃত্ৰাসুরকে বিনাশ করিয়াছেন এবং আমরা ভাগ্যক্রমে আপনাকে অক্ষত ও কুশলী অবলোকন করিলাম।”
“মহেন্দ্ৰ প্রীতি প্ৰফুল্প হইয়া সমুচিতসম্ভাষণপূর্ব্বক কহিলেন, “হে লোকপালগণ! ভীষণস্বভাব নহুষের পরাজয়-বিষয়ে তোমাদিগকে সাহায্য করিতে হইবে।”
“তাঁহারা কহিলেন, “হে ইন্দ্র। দৃষ্টিবিষ [যাহার দৃষ্টিপাতে দৃষ্ট ব্যক্তির শক্তি তিরোহিত হয়] নহুষ অতি ভয়ঙ্কর; এই নিমিত্ত অত্যন্ত ভীত হইতেছি। যদি আপনি তাহাকে পরাজয় করেন, তাহা হইলেই আমরা যজ্ঞাংশ প্রাপ্ত হই।”
“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “সে যাহা হউক, আজি আমি বরুণ, যম, কুবের প্রভৃতি লোকপালগণকে স্ব স্ব পদে অভিষিক্ত করিলাম। সকলে একত্র মিলিত হইয়া দৃষ্টিবিধ নহুষকে পরাজয় করিব।”
“তখন অগ্নি ইন্দ্ৰকে কহিলেন, “হে ইন্দ্ৰ! আমাকে অংশ দান কর, আমিও তোমাদের সাহায্য করিব।”
“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে হুতাশন! তুমি মহাযজ্ঞে ঐন্দ্রাগ্ন্য [ইন্দ্রব্যবস্থাপিত অগ্নির যজ্ঞভাগ] নামে এক অংশ প্রাপ্ত হইবে।”
“অনন্তর বরদাতা মহেন্দ্ৰ কুবেরকে যক্ষগণের ও সমুদয় ধনের, যমকে পিতৃগণের এবং বরুণকে জলের আধিপত্য প্রদান করিয়া নহুষের বধোপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন।”