১৪তম অধ্যায়
শচী নির্দ্দেশে ঋষিবাহিত মানে নহুষের গমনাকাঙক্ষা
“দেবরাজ ইন্দ্ৰ শচীমুখে এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে সত্যব্রতো! এক্ষণে বিক্রমপ্রকাশের অবসর নহে; রাজা নহুষ এক্ষণে আমা অপেক্ষা বলবান, ঋষিগণের হব্যাকব্যে [দেবতার উদ্দেশে দত্ত বস্তু হব, পিতৃগণের উদ্দেশে দত্ত দ্রব্য কাব্য] একান্ত পরিবর্দ্ধিত হইয়াছে। অতএব আমি এই বিষয়ে এক সৎপরামর্শ প্রদান করিতেছি, তুমি অতি গোপনে তাহার অনুষ্ঠান কর, কদাচ কাহার নিকট প্রকাশ করিও না। হে সুন্দরি! তুমি এক্ষণে নহুষসন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিবে, ‘হে মহারাজ! আপনি দিব্য ঋষিবাহ্য [ঋষিদ্বারা বাহিত] যানে আরোহণ করিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইবেন। তাহা হইলেই আমি প্রীতমনে আপনার বশীভূত হইব।’ ”
“অনন্তর ইন্দ্ৰাণী জীবিতনাথের [স্বামী] আদেশানুসারে নহুষসন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। রাজা নহুষ তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া সহাস্যমুখে স্বাগত প্রশ্নপূর্ব্বক কহিলেন, “অয়ি বরারোহে! বল, আমি তোমার কোন কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিব? আমি তোমার একান্ত ভক্ত ও নিতান্ত অনুরক্ত, এক্ষণে তুমি প্রীতমনে আমার অভিলাষ পূর্ণ কর, কদাচ লজ্জাপরবশ হইও না, আমাকে বিশ্বাস কর, আমি সত্য কহিতেছি, তুমি যাহা কহিবে, আমি তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদনা করিব।” ইন্দ্ৰাণী কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যে আমার সহিত সময়-নির্দ্দেশ [সময় নির্দ্দেশে অনুমোদন] করিয়াছিলেন, তাহা উপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে আমি আপনাকে পতিত্বে বরণ করিব, কিন্তু আমি আপনার নিকট একটি মনোগত কথা ব্যক্ত করিতেছি, আপনি যদি তাহা সম্পাদন করেন, তাহা হইলে আমি আপনার মনোরথ সফল করিব।
“ ‘দেবরাজ ইন্দ্রের হস্তী, অশ্ব, রথ প্রভৃতি নানাবিধ বাহন ছিল, কিন্তু আপনাকে এমন এক অপূর্ব্ব বাহন অবধারণ করিতে হইবে, যাহা ভগবান বিষ্ণু, রুদ্র, অসুর বা রাক্ষসগণ কেহই কখন অবলোকন করেন নাই; আপনি দর্শনমাত্র স্ববীর্য্যপ্ৰভাবে অন্যের তেজঃ অপহরণ করিতে পারেন; কেহই আপনার সমক্ষে অবস্থান করিতে সমর্থ হয় না; অসুর ও দেবগণের অনুকরণ করা আপনার নিতান্ত অকর্ত্তব্য ; অতএব মহাভাগ মহর্ষিগণ সমবেত হইয়া শিবিকাদ্বারা আপনাকে স্কন্ধে বহন করিলে আমার অভিলাষ পূর্ণ হইবে।”
“তখন দেবরাজ নহুষ সাতিশয় হৃষ্ট ও নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “হে দেবি! আমি তোমারই অধীন; তুমি যাহা কহিলে, ইহা অপূর্ব্ব বাহন, তাহাতে সন্দেহ নাই। মহর্ষিগণকে বাহন করা অল্পবলবীৰ্য্যশালী ব্যক্তির কাৰ্য্য নহে; অতএব এ বিষয়ে আমারও বিলক্ষণ অভিলাষ আছে। আমি তপঃপরায়ণ ও ত্রিকালজ্ঞ; সমুদয় জগৎ আমাতেই প্রতিষ্ঠিত আছে। আমি রোষাপরবশ হইলে এই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড বিনষ্ট করিতে পারি; দেব, দানব, গন্ধৰ্ব, কিন্নর, ঊরাগ ও রাক্ষস কেহই আমার সম্মুখীন হইতে সমর্থ হয় না। আমি যাহার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করি, তাহারই তেজঃ সংহার করিয়া থাকি, অতএব তুমি যাহা কহিলে, আমি অবিলম্বেই তাহা সংসাধন করিব; সপ্তর্ষি ও ব্রহ্মর্ষিগণ অবশ্যই আমাকে বহন করিবেন। হে দেবি! আজি তুমি আমার মাহাত্ম্য ও সমৃদ্ধি সন্দর্শন কর।”
ঋষিযানে কমমত্ত নহুষের শচীসমীপে যাত্ৰা
“এই বলিয়া বলমদমত্ত কামচারী দুরাত্মা নহুষ শচীকে বিদায় করিয়া নিয়মসম্পন্ন মহর্ষিগণকে বিমানে যোজন করিয়া আপনাকে বহন করাইতে লাগিলেন। ইত্যবসরে ইন্দ্রাণী বৃহস্পতিসন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিলেন, “ভগবান! দেবরাজ নহুষ যে সময় নিৰ্দ্ধারণ করিয়াছিল, তাহা আগতপ্ৰায় হইয়াছে, এক্ষণে আপনি অনতিবিলম্বে দেব পুরন্দরকে অনুসন্ধান করিয়া আমার প্রতি অনুকম্প প্রকাশ করুন।” তখন ভগবান বৃহস্পতি তৎক্ষণাৎ তাঁহার বাক্য স্বীকার করিয়া কহিলেন, “হে দেবি! দুরাত্মা নহুষ হইতে তোমার আর কোন আশঙ্কা নাই, যখন সেই অধাৰ্মিক ঋষিগণদ্বারা আপনাকে বহন করাইতেছে, তখন তাঁহার বিনাশকাল আসন্ন হইয়াছে, সন্দেহ নাই। আমি এক্ষণে তাহার বধসাধনের নিমিত্ত এক যজ্ঞানুষ্ঠান করিতেছি, তুমি ভীত হইও না; আমি দেবরাজ ইন্দ্ৰকে অবশ্যই প্রাপ্ত হইব, তোমার মঙ্গল হউক।”
“অনন্তর বৃহস্পতি ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্রের প্রাপ্তির নিমিত্ত প্রজ্বলিত হুতাশনে আহুতি প্ৰদান করিতে লাগিলেন। তিনি অগ্নিকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “হে অনল! তুমি এক্ষণে সুররাজ ইন্দ্রকে অনুসন্ধান কর।” তখন হুতাশন অপূর্ব্ব স্ত্রীবেশ ধারণ করিয়া তথায় অন্তৰ্হিত হইলেন, এবং নিমেষমাত্রে দিক, বিদিক, পর্ব্বত, কানন, পৃথিবী ও অন্তরীক্ষ অনুসন্ধানপূর্ব্বক পুনরায় বৃহস্পতিসন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে সুরাচাৰ্য্য! আমি দেবরাজকে কোন স্থানে অবলোকন করিলাম না; আমার সলিলপ্রবেশের ক্ষমতা নাই; এই নিমিত্ত কেবল তথায় তাহাকে অনুসন্ধান করিতে পারি নাই; এক্ষণে বলুন, আপনার আর কি অনুষ্ঠান করিতে হইবে?” তখন দেবগুরু কহিলেন, “হে অনল! তোমাকে অবশ্যই সলিলপ্রবেশ করিতে হইবে।” অগ্নি কহিলেন, “হে সুরাচাৰ্য্য! সলিল হইতে অনল, ব্ৰহ্ম হইতে ক্ষত্রিয় ও প্রস্তর হইতে লৌহ সমুদ্ভূত হইয়াছে, কিন্তু তাহাদের অপ্রতিহত তেজঃ স্ব স্ব উদ্ভবক্ষেত্রেই প্রশান্ত হইয়া থাকে। অতএব আমি কদাচ সলিলমধ্যে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইব না; তাহা হইলে অবশ্যই বিনষ্ট হইব। এক্ষণে আপনার মঙ্গল হউক, আমি আপনার শরণাপন্ন হইলাম।’ ”