১৩শ অধ্যায়
সহদেবের সবিনয় মোগতত্ত্বের অবতারণা
নকুলের বাক্যাবসান হইলে সহদেব যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! ‘আমার পুত্র, আমার কলত্র, আমার ধন’ ইত্যাদি জ্ঞানকে মমকার কহে। মমকার দুই প্রকার— বাহ্য ও আন্তরিক। কেবল বাহ্য মমকার পরিত্যাগ করিলে কোনরূপেই সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা নাই; আন্তরিক মমকার পরিত্যাগ করিতে পারিলেও সিদ্ধিলাভ হয় কি না সন্দেহ। বাহ্য মমকারশূন্য আন্তরিক মমকারসম্পন্ন ব্যক্তির যে ধর্ম্ম ও সুখলাভ হয়, তাহা আমাদের বিপক্ষগণের হউক। আর আন্তরিক মমকারশূন্য ব্যক্তির যে ধৰ্ম্ম ও সুখলাভ হয়, আমাদের মিত্রগণ সেইরূপ ধৰ্ম্ম ও সুখলাভ করুন। মমকার মৃত্যুস্বরূপ ও নির্ম্মমতা শাশ্বত ব্রহ্মস্বরূপ। ব্রহ্ম ও মৃত্যু অলক্ষিতভাবে আত্মাকে আশ্রয় করিয়া জীবগণকে কার্য্যে প্রবর্ত্তিত করিতেছেন। হে মহারাজ! যদি আত্মা অবিনাশী হয়, তাহা হইলে অন্যের জীবন নষ্ট করিলে হিংসাধৰ্ম্মে লিপ্ত হইতে হয় না। আর যদি দেহের সহিত আত্মার এককালে উৎপত্তি ও এককালে ধ্বংস হয়, তাহা হইলে পরলোকোদ্দেশে যে ক্রিয়াকলাপের অনুষ্ঠান করা যায়, তৎসমুদয় বৃথা। অতএব আত্মা অবিনশ্বর কি বিনশ্বর, ইহা নির্ণয় না করিয়া পূর্ব্বন সাধুলোকেরা যে পথ অবলম্বন করিয়াছেন, বিজ্ঞ ব্যক্তির সেই পথ অবলম্বন করাই শ্রেয়স্কর।
“যে মহীপাল স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পৃথিবী অধিকার করিয়া উহা ভোগ না করেন, তাঁহার প্রাণধারণ করা বিড়ম্বনা মাত্র। বিশেষতঃ যে ব্যক্তি বনে বাস ও বনজাত দ্রব্য ভক্ষণ করিয়া বাহ্যপদার্থ রাজ্যাদির মমতা করে, তাহাকে করাল কৃতান্তের আস্যদেশে[যমের রূপ] বাস করিতে হয়। এক্ষণে আপনি প্রাণীগণের বাহ্য ও আন্তরিক ভাবসমুদয় পর্য্যবেক্ষণ করুন। যাঁহারা আত্মার সহিত সাক্ষাৎকার লাভ করিতে পারেন, তাঁহারাই সংসার হইতে বিমুক্ত হয়েন। আপনি আমার পিতা, ভ্রাতা, রক্ষিতা [রক্ষক] ও গুরু। অতএব আপনি আমার এই আর্ত্ত-প্রলাপ-শ্রবণে ক্রুদ্ধ না হইয়া ক্ষমা প্রদর্শন করুন। আমি যেসমস্ত কথার উল্লেখ করিলাম, ইহা সত্য হউক বা মিথ্যা হউক, আন্তরিক ভক্তিসহকারেই কহিয়াছি।”