১৩শ অধ্যায়
ভগবদগীতাপর্ব্বাধ্যায়-ভীষ্মের নিধনবার্ত্তা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! অতীত-ভবিষ্যৎ-বর্ত্তমানজ্ঞ, সকল বিষয়ের প্রত্যক্ষদর্শী সঞ্জয় রণক্ষেত্ৰ হইতে প্ৰত্যাগত ও চিন্তাপরায়ণ ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে সহসা সমুপস্থিত হইয়া দীনবচনে কহিলেন, “মহারাজ! আমি সঞ্জয়, আপনাকে নমস্কার করি। ভরতগণের পিতামহ শান্তনুনন্দন ভীষ্ম নিহত হইয়াছেন; * [* পৃথিবীবিবরণ বলিতে বলিতে যুদ্ধের পূর্ব্বঘটনা সম্বন্ধে কোন কথা না বলিয়া সঞ্জয় একবারে ভীষ্মের নিধনবার্ত্তা নিবেদন করিলেন। এ সম্বন্ধে প্রসঙ্গসঙ্গতি এই যে—ভীষ্মবধবার্ত্তায় বিস্মিত ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ বাসনায় গীতার প্রথমেই প্রশ্ন করিবেন— ‘ধর্ম্মক্ষেত্রে…কিমকুর্ব্বত সঞ্জয়” ইত্যাদি। সেইখানেই সঞ্জয় অর্জ্জুনের বিষাদান্তে শঙ্খশব্দে যুদ্ধ ঘোষণা হইতে সমস্ত বীরবধাদি বৃত্তান্ত বর্ণন করিবেন।] যিনি যোদ্ধাগণের অগ্রগণ্য ও ধনুৰ্দ্ধরগণের আশ্রয়, আজি সেই কুরুপিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করিয়াছেন; আপনার পুত্ৰ যাঁহার বীর্য্য আশ্রয় করিয়া দ্যূতক্রীড়া করিয়াছিলেন, সেই ভীষ্ম শিখণ্ডীর হস্তে নিহত ও সমরশায়ী হইয়াছেন; যিনি কাশীনগরীর মহাযুদ্ধে সমবেত সমস্ত পৃথিবীপালকে একরথে পরাজিত করিয়াছিলেন, পরশুরাম যাহাকে সমরে পরাজিত করিতে সমর্থ হয়েন নাই, আজি সেই ভীষ্ম শিখণ্ডীর হস্তে সংহারপ্রাপ্ত হইয়াছেন; যিনি শৌর্য্যে মহেন্দ্রের ন্যায়, স্থৈৰ্য্যে গিরীন্দ্রর [হিমালয়ের] ন্যায়, সহিষ্ণুতায় [সহ্যগুণে] পৃথিবীর ন্যায় ও গাভীৰ্য্যে সমুদ্রের ন্যায়, আজি সেই ভীষ্ম বাণদন্ত [যাহার দন্ত সুতীক্ষ বাণতুল্য], ধনুর্ব্বক্ক্ত্র [যাঁহার মুখের হাঁ ধনুকতুল্য প্রসারিত—ভয়াবহ], খড়্গজিহ্ [যাঁহার জিহ্বা তরবারীর মত লকলকে], দুরাসাদ [অন্যের অনাক্রমণীয়], নরসিংহ [পুরুষশ্রেষ্ঠ] পঞ্চালপুত্রের হস্তে নিপাতিত হইলেন। পাণ্ডবগণের মহাসৈন্য যাঁহাকে সমরোদ্যত নিরীক্ষণ করিয়া সিংহভীত গোসমূহের ন্যায় ভয়ে ও উদ্বেগে কম্পমান হইয়াছিল, আজি সেই বীরঘাতী মহাবীর ভীষ্ম দশরাত্র আপনার সেনাগণকে রক্ষা ও দুষ্কর কর্ম্মসমূহ সম্পাদন করিয়া আদিত্যের ন্যায় অস্তপ্রাপ্ত হইয়াছেন; যিনি ইন্দ্রের ন্যায় অক্ষুব্ধচিত্তে সহস্ৰ-সহস্র শরবর্ষণ করিয়া দশদিকে দশকোটি যোদ্ধাকে নিঃশেষিত করিয়াছেন, আজি সেই ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনের দুর্ম্মন্ত্রণায় [দুষ্ট পরামর্শে] অযোগ্য ব্যক্তির ন্যায় নিহত হইয়া বাতভগ্ন [বায়ুদ্বারা ভগ্ন] তরুর ন্যায় ধরাশায়ী হইয়াছেন।”