০১২. কুশদ্বীপাদি বহুবিধ দ্বীপ-বৰ্ণনা

১২শ অধ্যায়

কুশদ্বীপাদি বহুবিধ দ্বীপ-বৰ্ণনা

“হে মহারাজ! উত্তরদিকস্থ দ্বীপসমুদয়ের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। ঐসমুদয় দ্বীপে ঘৃতসমুদ্র, দধিসমুদ্র, সূরাসমূদ্র ও জলসমূদ্র সন্নিবেশিত আছে। উক্ত দ্বীপসকলের পরিমাণ উত্তরোত্তর দ্বিগুণ এবং উহারা সমুদ্রে পরিবেষ্টিত। মধ্যমদ্বীপে মনঃশিলাময় [মুনছাল] গৌরপর্ব্বত আছে; পশ্চিমদ্বিীপে নারায়ণের সখা কৃষ্ণপর্ব্বত; ভগবান কেশব স্বয়ং উহাতে দিব্যরত্নসমুদয় সংস্থাপন করেন। তিনি ঐ স্থানে প্রসন্ন হইয়া প্ৰজাগণের সুখসমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিয়াছেন। কুশদ্বীপের অধিবাসী জনগণ কুশস্তম্ভের [খোঁটার মত দণ্ডায়মান মিলিত কুশরাশির] ও শাল্মলীদ্বীপস্থ ব্যক্তিরা শান্মলীর [শিমুলবৃক্ষের] অর্চনা করিয়া থাকে। ক্ৰৌঞ্চদ্বীপের অধিবাসী চারিবর্ণ নিরন্তর রত্ননিকরপরিপূর্ণ মহাক্ৰৌঞ্চগিরির উপাসনা করিয়া থাকে।

“হে মহারাজ! কুশদ্বীপের প্রথম পর্ব্বত গোমন্ত, ঐ গিরি সর্ব্বধাতুতে রঞ্জিত ও বিদ্রুমে সমাকীর্ণ; ঐ পর্ব্বতে কমললোচন প্ৰভু নারায়ণ মুক্ত ব্যক্তিগণের সহিত সঙ্গত হইয়া সতত বাস করেন। দ্বীপের দ্বিতীয় পর্ব্বত হেমময় হেমগিরি; তৃতীয় দ্যুতিমান কুমুদপর্ব্বত; চতুর্থ পুষ্পবান; পঞ্চম কুশেশয়; ষষ্ঠ হরিপর্ব্বত। এই ছয়টি পর্ব্বতোত্তম কুশদ্বীপে অধিষ্ঠিত আছে, উহাদের পরস্পরের দূরত্ব উত্তরোত্তর দ্বিগুণ। কুশদ্বীপের প্রথম বর্ষের নাম ঔদ্ভিদ; দ্বিতীয় বর্ষ বেণুমণ্ডল; তৃতীয় সুরথাকার; চতুর্থ কম্বল; পঞ্চম ধূতিমৎ; ষষ্ঠ প্রভাকর; সপ্তম কাপিল। এই সাতটি বর্ষ প্রধান। এই সমুদয় বর্ষে দেব, গন্ধর্ব্ব ও মানবগণ সতত আনন্দিতচিত্তে বিহার করিয়া থাকেন। এইসকল স্থানের অধিবাসী অল্পায়ু হয় না; এইসকল স্থানে দাসু বা ম্লেচ্ছজাতির সম্পর্ক নাই; ঐ বর্ষসমূদয়ের মানবগণ গৌরবর্ণ ও সুকুমারকলেবর।

“হে কুরুরাজ! এক্ষণে অন্যান্য দ্বীপের বৃত্তান্ত আমার জ্ঞানানুসারে কীৰ্ত্তন করিতেছি, স্থিরচিত্তে শ্রবণ করুন। ক্ৰৌঞ্চদ্বীপে ক্ৰৌঞ্চনামে মহাপর্ব্বত আছে। ক্রৌঞ্চের পর বামন, তাহার পর অন্ধকারক, তৎপরে মৈনাক, তদনন্তর গোবিন্দ, গোবিন্দের পর নিবিড়পর্ব্বত বর্ত্তমান আছে। এইসমস্ত পর্ব্বতের পরস্পর দূরত্ব উত্তরোত্তর দ্বিগুণ। ঐসকল পর্ব্বতে যে যে দেশ আছে, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন;-ক্ৰৌঞ্চ পর্ব্বতে কুশলদেশ ও বামনপর্ব্বতে মনোনুগদেশ, তাহার পর উষ্ণদেশ, তাহার পর প্রাবরকদেশ, তাহার পর অন্ধকারকদেশ, তাহার পর মুনিদেশ, মুনিদেশের পর দুন্দুভিস্বনদেশ প্রতিষ্ঠিত আছে। দুন্দুভিস্বনদেশ 
সি
দ্ধ ও চারণগণে সমাকীর্ণ তত্ৰত্য সমুদয় অধিবাসিগণ প্রায় শুক্লবৰ্ণ। হে মহারাজ! যেসকল দেশের উল্লেখ করিলাম, তৎসমুদয় দেব ও গন্ধর্ব্বগণের নিবাসভূমি।

“পুষ্কর দ্বীপে প্রভূতমণিরত্নসম্পন্ন পুষ্করনামে এক পর্ব্বত আছে। ভগবান প্রজাপতি স্বয়ং তথায় বাস করেন; দেব ও মহর্ষিগণ স্তুতিবাক্যদ্বারা নিত্য তাঁহার উপাসনা করিয়া থাকেন। জম্বুদ্বীপে বিবিধ রত্নজাত সমুৎপন্ন হয়। হে ভূপাল! যে সকল দ্বীপের নাম কীৰ্ত্তন করিলাম, ঐসমুদয় দ্বীপস্থ প্ৰজাগণের ব্ৰহ্মচৰ্য্য, সত্য, ইন্দ্ৰিয়সংযম ও আরোগ্য প্রশংসনীয়; তাহাদের আয়ুপ্রমাণ উত্তরোত্তর দ্বিগুণ এবং কর্ম্মও এক প্রকার, কিছুমাত্র ভেদ নাই। এইসকল দ্বীপের মধ্যে এক জনপদ আছে। সর্ব্বলোকেশ্বর ভগবান প্রজাপতি স্বয়ং দণ্ডধারণ করিয়া উক্ত দ্বীপসমুদয় রক্ষা করিয়া তথায় অধিষ্ঠান করিতেছেন। তিনি মঙ্গলদায়ক রাজা, তিনি পিতা ও পিতামহ; তিনি কি জড়, কি পণ্ডিত, সমুদয় প্ৰজাগণকেই রক্ষা করিয়া থাকেন। সেই জনপদে প্ৰজাগণের সমীপে সুসিদ্ধ ভোজনদ্ৰব্যজাত স্বয়ং সমুপস্থিত হয়; তাহারা তাঁহাই ভক্ষণ করিয়া কালব্যাপন করে।

“শ্বেতদ্বীপের পর সমনামে চতুরস্র [চতুষ্কোণ] ত্ৰয়স্ত্রিংশৎ [তেত্রিশ] মণ্ডল [রাজ্য] দৃষ্ট হয়; ঐ স্থানে বামন, ঐরাবত, সুপ্রতীক প্রভৃতি লোকবিখ্যাত দিগ্‌গজগণ [দিকরক্ষক হস্তী] অবস্থিতি করে। দিগগজগণের পরিমাণ স্থির করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। হে মহারাজ! ঐ স্থানে দশদিক হইতে বায়ু বহিতে থাকে; দিগগজগণ প্রফুল্ল কমলসদৃশ স্বস্ব শুণ্ডদ্বারা সেই বায়ু গ্ৰহণ করিয়া অনবরত নিক্ষেপ করিতেছে। সেই দিগগজমুক্ত বায়ু এ স্থানে আগমন করিয়া প্ৰজাগণের প্রাণ রক্ষা করিতেছে।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি দ্বীপসমুদয়ের বিষয় বিস্তৃতরূপে কীৰ্ত্তন করিলে, এক্ষণে চন্দ্র, সূৰ্য্য ও রাহুর প্রমাণ কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! দ্বীপ-সমুদ্রের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়াছি; এক্ষণে রাহুর পরিমাণ শ্রবণ করুন। রাহুগ্রহ মণ্ডলাকার; তাহার ব্যাস [বৃত্তের একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পৰ্য্যন্ত মধ্যস্থলের ব্যবধান] দ্বাদশসহস্ৰ যোজন ও পরিধি [বৃত্তের বহির্ভাগের বেষ্টনীর পরিমাণ ষট্‌ত্রিংশৎ [ছত্রিশ] সহস্ৰ যোজন। অন্যান্য পুরাণবেত্তারা কহেন, রাহুর পরিমাণ ষটুসহস্ৰ যোজন। চন্দ্রের ব্যাস একাদশসহস্ৰ যোজন ও পরিধি ত্ৰিয়স্ত্রিশৎসহস্ৰ যোজন; মতান্তরে তাহার পরিমাণ একোনষষ্টি[উনষাট্‌]সহস্ৰ যোজন। সূৰ্য্যের ব্যাস দশসহস্র ও পরিধি ত্রিংশৎ [ত্রিশ] সহস্ৰ যোজন; মতান্তরে তাহার পরিমাণ অষ্টশত [আটশত] যোজন। শীঘ্রগামী ভগবান্‌ সূর্য্যের পরিমাণ এইরূপ স্থির হইয়াছে।

হে রাজন! রাহু যথাকলে চন্দ্র ও সূৰ্য্যকে আচ্ছাদিত করে; চন্দ্ৰ, সূৰ্য্য ও রাহুর এই বৃত্তান্ত সংক্ষেপে কীৰ্তন করিলাম। আপনি জ্ঞানচক্ষু; আমি আপনার আদেশানুসারে জগতের নির্ম্মাণপ্ৰভৃতি সমুদয় বৃত্তান্ত যথাযথ কীৰ্তন করিলাম। এক্ষণে আপনি স্বয়ং শান্তিপক্ষ আশ্রয় করিয়া স্বীয় পুত্ৰ দুৰ্য্যোধনকে আশ্বাস প্রদান করুন। যে ক্ষত্রিয় এই ভূমিপর্ব্ব শ্রবণ করে, তাহার শ্ৰীলাভ, অর্থসিদ্ধি এবং আয়ু, বল ও তেজের বৃদ্ধি হয়। যে মহীপাল পর্ব্বাহে [পূর্ণিমাদি পুণ্যদিনে] সংযত হইয়া ইহা শ্রবণ করেন, তাহার পিতা, পিতামহ প্রভৃতি উৰ্দ্ধতন পুরুষগণের প্রীতিলাভ হয়। আমরা ভারতবর্ষে বাস করিতেছি, পূর্ব্বতন ব্যক্তিগণ ইহাতে বাস করিয়া যে প্রকারে পুণ্যকর্ম্ম করিয়া গিয়াছেন, তৎসমুদয় আপনি শ্রুত হইয়াছেন।”

ভূমিপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত