০১২. অর্জ্জুনাভিগমনপর্ব্বাধ্যায়

১২শ অধ্যায়

অর্জ্জুনাভিগমনপর্ব্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ভোজ, অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়েরা দুঃখ-সন্তপ্ত পাণ্ডবগণ প্ৰব্ৰজ্যাশ্রম অবলম্বন করিয়াছেন শুনিয়া দর্শনার্থ মহাবনে যাত্ৰা করিলেন। পাঞ্চলের জ্ঞাতিবর্গ, চেদিদেশাধিপতি ধৃষ্টকেতু ও ত্ৰিলোকবিশ্রুত মহাবীৰ্য্য কৈকেয় ইঁহারা রোষকষায়িত হইয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকে নিন্দা করিতে করিতে পাণ্ডবসন্নিধানে গমন করিলেন ও ইতিকর্ত্তব্যতার আন্দোলন করিয়া অনতিকালমধ্যে তথায় উপস্থিত হইয়া কৃষ্ণকে পুরস্কৃত ও যুধিষ্ঠিরকে বেষ্টিত করিয়া উপবিষ্ট হইলেন। সকলে উপবেশন করিলে কৃষ্ণ কুরুশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করিয়া অতি দীনমনে কহিতে লাগিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! পৃথিবী অবশ্যই দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন, কৰ্ণ, শকুনি ও দুঃশাসন এই দুষ্টচতুষ্টয়ের শোণিত পান করিবে। আমরা ইহাদিগকে রণশায়ী করিয়া ইহাদিগের অনুগত লোক ও অন্যান্য নৃপতিবর্গকে পরাজয়পূর্ব্বক আপনাকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিব। মহারাজ! যে ব্যক্তি ঘৃণিতলোকের অনুগামী হয় সেও বধ্য, এই সনাতন ধর্ম্ম।”

অর্জ্জুনের কৃষ্ণস্তুতি

এই সমস্ত কথা কহিতে কহিতে কৃষ্ণের ক্রোধানল প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিল, তৎকালে বোধ হইল যেন তিনি লোকসকল দগ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছেন। ‘অৰ্জ্জুন সেই অমিততেজাঃ, প্রজাপতিপতি, ত্ৰিলোকনাথ কৃষ্ণকে রোষাবিষ্ট দেখিয়া তদীয় পূর্ব্বদেহের কর্ম্মসমুদয় কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন, “হে কৃষ্ণ! পূর্ব্বে তুমি যাত্রয়োয়ংগৃহ [যেখানে সন্ধ্যা, সেইখানে গৃহ-যাহার। নিৰ্দ্ধারিত গৃহ নাই, সন্ধ্যার সময় যেখানে উপস্থিত হয়, সেইখানেই থাকিয়া যায়] মুনি হইয়া দশ-সহস্ৰ বৎসর গন্ধমাদন পর্ব্বতে বিচরণ করিয়াছিলে। তুমি পুষ্করতীর্থে কেবল জল পান করিয়া একাদশসহস্ৰ বৎসর বাস করিয়াছিলে। তুমি অতি বিস্তীর্ণ বদরিকাশ্রমে ঊৰ্দ্ধবাহু হইয়া বায়ুভক্ষণপূর্ব্বক শত বৎসর একপদে দণ্ডায়মান ছিলে। তুমি সরস্বতীতীরে উত্তরীয়-বস্ত্ৰবিবর্জ্জিত, শীর্ণ ও শিরাব্যাপ্তশরীর হইয়া দ্বাদশবার্ষিক ঙজ্ঞকালে অবস্থান করিয়াছিলে। তুমি সাধুজনসেব্য প্রভাসিতীর্থে যজ্ঞারম্ভ করিয়া দেবপরিমিত [ব্ৰাহ্ম বৎসর—মানুষের একবৎসরে ব্ৰহ্মার একদিন। সুতরাং মানুষের তিনশত পঁয়ষট্টি বৎসরে ব্ৰহ্মার একবৎসর] দশসহস্ৰ বৎসর একপদে দণ্ডায়মান ছিলে। হে কৃষ্ণ! ব্যাস আমাকে কহিয়াছেন যে, লোকপ্ৰবৃত্তি উদ্দীপিত করাই তোমার একমাত্র উদ্দেশ্য। হে কেশব! তুমি ক্ষেত্ৰজ্ঞ, সর্ব্বভূতের আদি ও অন্ত; তুমি তপোনিধান ও নিত্যস্বরূপ। তুমি ভৌম নরককে উন্মলিত করিয়া মণিময়-কুণ্ডল আহরণপূর্ব্বক অতি পবিত্র প্রাথমিক অশ্ব সৃষ্টি করিয়াছ। হে নরোত্তম! তুমি এই সকল কর্ম্ম করিয়া দুৰ্দান্ত দৈত্যদানবদল সংহারপূর্ব্বক দেবরাজ ইন্দ্রকে সৰ্বেশ্বরত্ব প্ৰদান করিয়াছ; তুমি নরকলেবর পরিগ্রহ করিয়া মনুষ্যলোকে প্রাদুর্ভূত হইয়াছ। হে পুরুষোত্তম! তুমিই নারায়ণ, হরি, ব্ৰহ্মা, সোম, সূৰ্য্য, ধর্ম্ম, বিধাতা, যম, অনল, অনিল, বৈশ্রবণ, রুদ্র, কাল, আকাশ, পৃথিবী, দশদিক, অজ, চরাচরগুরু ও স্রষ্টা। তুমি পরমপবিত্র চৈত্ররথ-কাননে বহুবিধ উৎকৃষ্ট যজ্ঞ দ্বারা দেবতাদিগকে অৰ্চনা করিয়াছ। তুমি প্রতি যজ্ঞে যথাযোগ্য ভাগানুসারে শত-সহস্ৰ সুবৰ্ণ দান করিয়াছ। হে যাদবনন্দন! তুমি দেবমাতা অদিতির গর্ভে পুত্ররূপে উদ্ভূত হইয়া ইন্দ্ৰকনিষ্ঠ বিষ্ণু বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছ। তুমি অল্পবয়ষ্ক বালক হইয়া তিনপদে পৃথিবী, আকাশ ও সূৰ্য্যলােকে অধিষ্ঠানপূর্ব্বক স্বকীয় তেজদ্বারা দিবাকরকে প্রদীপ্ত করিয়াছ। তুমি সহস্ৰ সহস্রবার প্রাদুর্ভূত হইয়া অধর্ম্মপরায়ণ অসুরগণকে সংহার করিয়াছ। তুমি মৌরবপাশ [অন্ত্রতন্তুপাশ—নাড়ীনির্ম্মিত রজ্জু; নিসুন্দ-নিরকের ঐরােপ অস্ত্র ছিল] ছিন্ন করিয়া নিসুন্দ ও নরক-নামক অসুরদিগকে নিহত করিয়া প্ৰাগজ্যোতিষ দেশের গমনমাৰ্গ নিষ্কণ্টক করিয়াছ। তুমি জারূখী-দেশে আহ্বতি, ক্ৰাথ, সপক্ষ, শিশুপাল, জরাসন্ধ, শৈব্য ও শতধন্বাকে পরাজয় করিয়াছ। তুমি জলধারাবৎ গভীর-রবসম্পন্ন, সূৰ্য্যসঙ্কাশরথে আরোহণপূর্ব্বক রুক্সিরাজকে পরাজিত করিয়া তদীয় ভগিনী রুক্মিণীকে সহধর্ম্মিণী করিয়াছ। তুমি রোষাবিষ্ট হইয়া ইন্দ্ৰদ্যুম্ন, কসেরুমান্‌, যবন, সৌভাপতি শাল্ব ও সৌভনগর সংহার করিয়াছ। তুমি ইরাবতীতে কর্ত্তবীৰ্য্যসম বীৰ্য্যবান ভোজরাজ, গোপতি ও তালকেতুকে বিনাশ করিয়াছ। তুমি পবিত্ৰা ভগবতী। ঋষিকা ও দ্বারকা নগরীকে আত্মসাৎ করিয়া মহাসাগরের অন্তৰ্গত করিবে। হে মধুসূদন! তুমি নৃশংসাচার, কপটব্যবহার, ক্রোধ ও মাৎসৰ্য্যের বিষয়ীভূত নহ এবং মিথ্যা কথা কদাচ মুখে উচ্চারণ কর না। মহর্ষিগণ যজ্ঞায়তনস্থিত, প্রভাপুঞ্জোদ্ভাসিত তোমার সম্মুখীন হইয়া অভয়প্রার্থনা করিয়া থাকেন। হে ভূতভাবন! প্ৰলয়কাল উপস্থিত হইলে তুমি ভূতজাত সঙ্কুচিত করিয়া ব্ৰহ্মাণ্ডকে আত্মসাৎ করিয়াছিলে। সর্ব্বজগতের স্রষ্টা, চরাচরগুরু ব্ৰহ্মা যুগপ্রারম্ভে তোমার নাভিসরোরুহ হইতে সমুদ্ভূত হইয়াছেন। অতি দুর্দান্ত মধু ও কৈটভ নামক দানবদ্বয় ব্ৰহ্মাকে সংহার করিতে উদ্যত হইয়াছিল, তদর্শনে তুমি ক্ৰোধ জ্বলিত হইয়া ভগবান শূলপাণি ত্ৰিলোচনকে স্বীয় ললাটদেশ হইতে প্রাদুর্ভূত করিয়াছিলে। আমি নারদমুখে শুনিয়াছি, ব্ৰহ্মা ও শাম্ভূ এইরূপে তোমারই দেহ হইতে সম্ভূত হইয়া তোমারই আজ্ঞা পালন করিয়া থাকেন। হে নারায়ণ! তুমি পূর্ব্বে চৈত্ররথ-কাননে ভূরিদক্ষিণ মহাসত্র অনুষ্ঠান করিয়াছিলো। তুমি বাল্যকালে বলদেবের সহায়তা লাভ করিয়া যে-সমস্ত আলোকসামান্য ব্যাপার সম্পন্ন করিয়াছিলে, তাহা কোন কালেই হয় নাই ও হইবে, ইহাও সম্ভবপর নহে। তুমি বেদপারগ ব্ৰাহ্মণগণ সমভিব্যাহারে কৈলাসপর্ব্বতে অবস্থিতি করিয়াছিলো।”

অর্জ্জুন এইরূপে কৃষ্ণের স্তুতিবাদ করিয়া তূষ্ণীভূত হইয়া রহিলেন।

অনন্তর কৃষ্ণ অর্জ্জুনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে পাৰ্থ! তুমি আমার, আমি তোমার; আমার অধিকৃত সমস্ত দ্রব্যে তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। তোমাকে দ্বেষ করিলে আমাকেও দ্বেষ করা হয়। তুমি নর, আমি নারায়ণ; আমরা কালক্রমে নরনারায়ণরূপে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছি। আমাদের অন্তর অবগত হওয়া নিতান্ত দুরূহ। ফলতঃ তোমাতে ও আমাতে কিছুমাত্র বিভিন্নতা নাই।”

দ্ৰৌপদীর কৃষ্ণস্তব

নারায়ণের বাক্যাবসানে ধৃষ্টদ্যুন্ন প্রভৃতি ভ্রাতৃগণকর্ত্তৃক পরিবেষ্টিতা শরণার্থিনী দ্রৌপদী ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সেই বীরসমবায়ে ভ্রাতৃবর্গের সহিত সুখাসীন পুণ্ডরীকাক্ষকে কহিলেন, “হে মধুসূদন! অসিত ও দেবল তোমাকে প্রজাসৃষ্টি-বিষয়ে প্ৰজাপিত বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন। জমদগ্ন্য তোমাকে বিষ্ণু, যজ্ঞ, যাগকর্ত্তা ও যজনীয় কহিয়াছেন। মহর্ষিগণ তোমাকে ক্ষমা ও সত্যস্বরূপে উল্লেখ করিয়াছেন। কশ্যপ কহিয়াছেন, তুমি সত্য হইতে যজ্ঞরূপে অবতীর্ণ হইয়াছ। হে ভূতভাবন ভগবান! নারদ তোমাকে সাধ্যদেব ও প্রমথগণের ঈশ্বরের ঈশ্বর বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। যাদৃশ বালকেরা ক্রীড়নক [ক্রীড়াসামগ্ৰী—পুতুল প্রভৃতি] দ্বারা ক্রীড়া করে, হে পুরুষপ্রধান! তুমিও সেইরূপ ব্ৰহ্মা, শঙ্কর ও ইন্দ্ৰাদি দেববৃন্দকে লইয়া বারংবার ক্রীড়া করিয়া থাক। তুমি সনাতন পুরুষ; তোমার মস্তকদ্বারা সুরলোক ও পাদদ্বয়দ্বারা ভূলোক ব্যাপ্ত রহিয়াছে। এই পৃথিবীস্থ সমস্ত লোক তোমার জঠরদেশে অবস্থিতি করিতেছে। তুমিই তপঃক্লেশাভিতপ্ত ও আত্মদৰ্শন-পরিতৃপ্ত তাপসাগণের একমাত্র গতি। হে নরশ্রেষ্ঠ! তুমি সর্ব্বধর্ম্মোপপন্ন পুণ্যশালী সমরশূর রাজর্ষিদিগের অদ্বিতীয় আশ্রয়। তুমি প্ৰভু, বিভু ও ভূতাত্মা; তুমিই ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছ। লোকপাল, লোকসমুদয়, নক্ষত্ৰগণ, দশদিক, আকাশ, চন্দ্র ও সূৰ্য্য এই সমুদয় তোমাকেই অবলম্বন করিয়া রহিয়াছে। ভূতনিবহের মর্ত্ত্যতা ও নির্জ্জর [জরামরণরহিত—দেবতা]গণের অমরত্ব প্রভৃতি আলোকসামান্য কাৰ্য্য-সকল তোমাতেই প্রতিষ্ঠিত। হে মধুসূদন! তুমি কি দিব্য, কি মানুষ, সকল ভূতেরই ঈশ্বর; অতএব আমি এক্ষণে প্ৰণয়প্রযুক্ত তোমার সমক্ষে দুঃখ প্রকাশ করি।

কৃষ্ণসমীপে দ্ৰৌপদীর সখেদ উক্তি

“হে কৃষ্ণ! আমি পাণ্ডবদিগের সহধর্ম্মিণী, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী এবং তোমার প্রিয়সখী হইয়াও কি সভামধ্যে দুষ্ট দুঃশাসনকর্ত্তৃক আকৃষ্ট হইতে পারি? তৎকালে আমি স্ত্রীধর্ম্মসম্পন্না শোণিতোক্ষিতা ও একবস্ত্রা ছিলাম। পাপপরায়ণ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ রাজসভামধ্যে আমাকে কম্পমানা ও রাজস্বলা দেখিয়া উপহাস করিয়াছিল। হায়! কি দুর্ভাগ্য! পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও যাদবেরা জীবিত থাকিতেও ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা আমাকে দাসীভাবে উপভোগ করিতে অভিলাষী হইল। হে জনার্দ্দন! আমি ধর্ম্মতঃ ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূর হই, তথাচ তাহারা আমাকে বলপূর্ব্বক দাসী করিতে চাহিল। আমি মহাবল পাণ্ডুনন্দনদিগকে যথোচিত নিন্দা করি, কারণ, তাহারা স্বীয় যশস্বিনী সহধর্ম্মিণীকে দুঃসহ দুঃখভারাক্রান্ত দেখিয়াও অনায়াসে তূষ্ণীভূত হইয়া রহিলেন। হা! মহাবীর ভীমসেনের বাহুবলে ও অর্জ্জুনের গাণ্ডীবে ধিক! কারণ, তাহারা আমাকে তুচ্ছজনকর্ত্তৃক অপমানিত ও অভিভূত দেখিয়াও অক্লেশে উপেক্ষা করিলেন। এই সাধুজনাচরিত সনাতনধর্ম্ম পূর্ব্বাপর প্রচলিত হইয়া আসিতেছে যে, ভর্ত্তা ক্ষীণবল হইলেও ভাৰ্য্যাকে রক্ষা করিবে। ভাৰ্য্যা রক্ষিতা হইলে প্রজারক্ষা হয়, প্রজারক্ষা হইলে আত্মা রক্ষিত হইয়া থাকে। আত্মা ভার্য্যার উদরে জন্মপরিগ্রহ করে বলিয়া ভার্য্যা জায়া শব্দে অভিহিত হইয়া থাকে। কিন্তু ভাৰ্য্যাকর্ত্তৃক ভর্ত্তার রক্ষা কিরূপে সম্ভব হইতে পারে? হে মধুসূদন! পাণ্ডবেরা শরণাগত ব্যক্তিকে কদাচ পরিত্যাগ করেন না, কিন্তু আমি শরণাথিনী হইলেও ইঁহারা তৎকালে আমাকে আশ্রয় দেন নাই। যুধিষ্ঠির হইতে প্ৰতিবিন্ধ্য, বৃকোদর হইতে সুতসোম, অর্জ্জুন হইতে শ্রুতকীর্ত্তি, নকুল হইতে শতানীক ও কনিষ্ঠ সহদেব হইতে শ্রুতকর্ম্ম, এই পঞ্চপুত্ৰ পঞ্চপতির ঔরসে আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, ইঁহাদের রক্ষণাবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত আমাকে রক্ষা করা বিধেয়। হে কৃষ্ণ! প্ৰদ্যুম্নের ন্যায় আমার পুত্ৰগণও তোমার স্নেহভাজন। ইহারা ধনুর্ব্বেদবিশারদ ও সংগ্রামে শক্রগণের অজেয়, অতএব কি নিমিত্ত দুর্ব্বল দুরাত্মা ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের অত্যাচার সহ্য করিব? দুরাচার পামরেরা অধর্ম্মাচরণপূর্ব্বক সমস্ত রাজ্যপহরণ এবং পাণ্ডবদিগকে দাসস্থানে পরিগণিত করিয়াছে; আমি একবস্ত্রা ও রাজস্বলা ছিলাম, দূরাত্মা দুঃশাসন কেশাকর্ষণপূর্ব্বক আমাকেও সভামধ্যে আনিয়াছিল। হা! মহাবলপরাক্রান্ত আরাতিকুলকাল বৃকোদর ও অর্জ্জুন বর্ত্তমান থাকিতে ক্ষীণমতি হীনবল দুৰ্য্যোধন এখনও জীবিত রহিয়াছে! অতএব ভীমসেনের সেই অমিত বাহুবলে ও অর্জ্জুনের অসামান্য পুরুষকারে ধিক! পূর্ব্বে ঐ দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন অধ্যয়নে বর্ত্তমান, ধৃতব্ৰত অপোগণ্ড পাণ্ডবগণকে মাতৃসমভিব্যাহারে রাজ্য হইতে নিষ্কাশিত করিয়াছিল। ঐ পাপাত্মা, ভীমসেনের অন্নে বহুপরিমাণে যে নবীন তীক্ষ্ন কালকূট প্ৰদান করিয়াছিল, তাহা স্মরণ করিলেও শরীর কণ্টকিত হইয়া উঠে! কিন্তু ভীমসেনের আয়ুঃশেষ [আয়ুষ্কালের অবশেষ—জীবিতকালের অবশিষ্ট ভাগ] আছে বলিয়া তাহা অক্লেশে জীর্ণ হইয়া গিয়াছে। বৃকোদার সাতিশয় বিশ্বস্তচিত্তে গঙ্গাতটে নিদ্রিত হইয়াছিলেন, ইত্যবসরে দুৰ্য্যোধন আসিয়া ইহার করাচরণ বন্ধনপূর্ব্বক স্রোতে নিক্ষিপ্ত করিয়া প্রত্যাগমন করিল; পরে ভীম সংজ্ঞালাভ করিয়া বন্ধনচ্ছেদনপূর্ব্বক উত্থিত হইয়াছিলেন। একদা মহাবিষ কালভূজঙ্গদ্বারা প্রসুপ্ত ভীমের সর্ব্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করাইয়াছিল, কিন্তু তাহাতেও শত্ৰুনাশন বৃকোদরের মৃত্যু হয় নাই; পরে জাগরিত হইয়া, সৰ্পগণকে বিনষ্ট ও দুৰ্য্যোধনের দায়িত সারথিকে বাম-হস্তদ্বারা সংহার করিলেন। ঐ নরাধম দুৰ্য্যোধন বারণাবত-নগরে জতুগৃহে জননী-সমভিব্যাহারে সুখপ্রসুপ্ত পাণ্ডবদিগকে দগ্ধ করিবার অভিলাষে অগ্নিপ্রদানের উদ্‌যোগ করিয়াছিল। হে কৃষ্ণ! কোন ব্যক্তি এইরূপ কুৎসিত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে পারে? জতুগৃহের হুতাশন প্রজ্বলিত হইবার পূর্ব্বে অতিদীনা, উপায়বিহীনা, আর্য্যা কুন্তী সাতিশয় ভীতা হইয়া রোদন করিতে করিতে এইরূপ বিলাপ ও পরিতাপ করিয়াছিলেন, ‘হা হতোস্মি! হায় কি হইল! আদ্য এই প্ৰদীপ্ত হুতাশন হইতে কিরূপে পরিত্ৰাণ পাইব? আমি অনাথা ও আশরণা, বুঝি, আজি সন্তানগণের সহিত ভস্মসাৎ হইতে হইল!” তখন ভীম-পরাক্রম ভীম ভ্রাতৃগণ ও জননীকে প্ৰবোধবাক্যে সাস্তুনা করিয়া কহিলেন, “হে মাতঃ! আপনাদিগের কিছুমাত্র শঙ্কা নাই, আমি পক্ষিরাজ গরুড়ের ন্যায় উৎপতিত হইতেছি।” এই বলিয়া জননীকে বাম কক্ষে, মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে দক্ষিণ কক্ষে, নকুল ও সহদেবকে দুই স্কন্ধে এবং অর্জ্জুনকে পৃষ্ঠদেশে লইয়া সুড়ঙ্গপথে মহাবেগে বহির্গত হইয়াছিলেন। অনন্তর ইহারা সেই যামিনীযোগে জননীসমভিব্যাহারে নিকটবর্ত্তী হিড়িম্ববন-নামক মহারণ্যে প্রবেশ করিয়া পরিশ্রমসুলভ নিদ্রায় অভিভূত হইয়া ভূতলে শয়ন করিলেন। ইতিমধ্যে হিড়িম্বনামী এক রাক্ষসী তথায় আগমনপূর্ব্বক ইহাদিগকে মাতার সহিত ক্ষিতিতলে অধিশয়ান দেখিয়া মদনবাণে আহত ও নিতান্ত অধীর হইয়া উঠিল। সে ভীমসেনকে বরণ করিবার মানসে কোমল করপল্লবদ্বারা ইঁহার চরণদ্বয় উৎসঙ্গে লইয়া অতি প্ৰহোষ্টমনে সংবাহন করিতে লাগিল। সুপ্তোত্থিত ভীমসেন তাহাকে তদাবস্থ দেখিয়া “হে সুন্দরি! তুমি আমার নিকট কি অভিলাষ করিতেছ?” ইহা জিজ্ঞাসিলে সেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী কামরূপিণী রাক্ষসী কহিল, “হে মহাভাগ! আমার মহাবল পরাক্রান্ত ভ্ৰাতা হিড়িম্ব এখনই তোমাদিগকে বিনাশ করিতে আসিবেন; অতএব অবিলম্বে এস্থান হইতে প্রস্থান কর।” তখন ভীমসেন সাতিশয় গর্ব্বপূর্ব্বক রাক্ষসীকে কহিলেন, “হে সুন্দরি! আমি তন্নিমিত্ত উদ্বিগ্ন বা শঙ্কিত হইব না; তোমার ভ্রাতা আসিলে আমি অবশ্যই তাহাকে সংহার করিব।”

“তখন ভীমদৰ্শন রাক্ষসাধম হিড়িম্ব উভয়ের এইরূপ কথােপকথন শ্রবণ করিয়া মহানাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক তথায় আগমন করিল এবং নিজ ভগিনী হিড়িম্বাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, হিড়িম্বে! তুমি কাহার সহিত কথোপকথন করিতেছ, তাহাকে অবিলম্বে আমার নিকট আনয়ন কর, ভক্ষণ করিব।” দয়ার্দ্রহৃদয়া হিড়িম্বা অনুকম্পাপরবশ হইয়া তাহার কথায় কিছুই প্রত্যুত্তর প্রদান করিল না। তখন হিড়িম্ব নিশাচর ক্ৰোধাভরে ঘোরতর সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক মহাবেগে ভীমের অভিমুখে আগমন করিয়া, বলপূর্ব্বক তাহার করগ্রহণ ও অশনিসম সুদৃঢ় অপর করদ্বারা ইহাকে অতিশয় কঠিন আঘাত করিল। ভীমসেন প্রথমতঃ, রাক্ষস আসিয়া করগ্রহণ করিয়াছে, ইহা সহ্য করিতে না পারিয়া, রোষাভরে প্রদীপ্ত হইয়া উঠিলেন। যেমন বৃত্র ও বাসবের তুমুল যুদ্ধ হইয়াছিল, সেইরূপ ভীমও হিড়িম্বের সহিত তুমুল সংগ্রাম করিয়া পরিশেষে সেই বলশূন্য পুণ্যজনের [রাক্ষসের] প্ৰাণসংহার করিলেন।

অনন্তর ভীম ঘটোৎকচজননী হিড়িম্বাকে লইয়া মাতা, ভ্রাতৃগণ ও ব্রাহ্মণসমূহ-সমভিব্যাহারে একচক্ৰাভিমুখে যাত্ৰা করিলেন। তৎকালে হিতানুধ্যান্যপরায়ণ ভগবান বাদরায়ণি মন্ত্রি হইয়া ইহাদিগের সমভিব্যাহারী হইয়াছিলেন। অনন্তর ঐ নগরীতে হিড়িম্বতুল্য মহাবলপরাক্রান্ত ভীষণাকার বক-নামক এক রাক্ষস পাণ্ডবদিগের সম্মুখীন হইলে ভীমসেন তাহাকে তৎক্ষণাৎ বিনাশ করিয়া ভ্ৰাতৃবর্গের সহিত দ্রুপদপুরে প্রবেশ করিলেন। হে জনার্দ্দন! যেরূপে তুমি ভীষ্মকাত্মজা রুক্সিণীকে প্রাপ্ত হইয়াছিলে, সেইরূপ সব্যসাচী অর্জ্জুনও বারণাবতনগরে বাসপূর্ব্বক স্বয়ংবরসময়ে নিতান্ত দুষ্কর কর্ম্মসকল সম্পাদন ও অভ্যাগত ভূপালবর্গের সহিত ঘোরতর সংগ্ৰাম করিয়া আমাকে লাভ করিয়াছেন। হে মধুসূদন! আমি এইরূপ বহুতর ক্লেশপরম্পরাদ্বারা ক্লিশ্যমানা ও অতি দুঃখিত হইয়া কুন্তী দেবীকে পরিত্যাগপূর্ব্বক এক্ষণে পুরোহিত ধৌম্য মহাশয়ের সহিত কালাতিপাত করিতেছি। আমি হীনজনকর্ত্তৃক অবমানিত ও বহুবিধ দুঃখপ্রাপ্ত হইয়াছি, তথাচ সিংহবৎ বলবিক্রমশালী মহাবীর পাণ্ডবেরা আমাকে কি নিমিত্ত উপেক্ষা করিতেছেন, বলিতে পারি না। হে কৃষ্ণ! আমি এই সমস্ত দুঃসহ দুঃখ সহ্য করিয়া দুর্ব্বল পাপাত্মা ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের প্রতি অতি দীর্ঘকাল রোষাবিষ্ট হইয়াছি। দেখ, প্রখ্যাত মহাদ্‌বংশে আমার জন্ম। আমি দিব্য বিধানানুসারে পাণ্ডবদিগের সহধর্ম্মিণী ও মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধু হইয়াছি, তথাচ পঞ্চপাণ্ডবদিগের সমক্ষে দুষ্ট দুঃশাসন আমার কেশাকর্ষণ করিল।”

মৃদুমধুরভাষিণী দ্রৌপদী এইরূপ অনুতাপসূচক বাক্যপ্রয়োগ করিয়া কমলকোষতুল্য কোমল করতলদ্বারা মুখমণ্ডল আচ্ছাদনপূর্ব্বক রোদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার নয়নবিগলিত অজস্র অশ্রুবিন্দু দ্বারা সুজাত পীনস্তনযুগল অভিষিক্ত হইতে লাগিল। অনন্তর নয়নজল উন্মোচন করিয়া বারংবার দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক ক্ৰোধাভরে বাষ্পপূর্ণ-কণ্ঠে কহিতে লাগিলেন, “হে কৃপাময়! এক্ষণে বোধ হইতেছে, আমি পতিপুত্ৰ-বিহীনা; আমার বন্ধু নাই, ভ্রাতা নাই, পিতা নাই ও তুমিও আমার পক্ষে নাই। তোমরা সকলে তৎকালে আমাকে পরাভূত দেখিয়াও যে বিশোকের ন্যায় অনায়াসে উপেক্ষা করিয়াছিলে ও কর্ণ যে আমাকে দেখিয়া উপহাস করিয়াছিল, সেই সকল দুঃখ আমার হৃদয়মন্দিরে অদ্যাপি জাগরূক্‌ রহিয়াছে। হে কৃষ্ণ! তুমিই কেবল সম্বন্ধ, গৌরব, সখ্যভাব ও প্রভুত্ব এই কারণ-চতুষ্টয় দ্বারা প্রতিদিন আমাকে রক্ষা করিয়া আসিতেছ।”

দুঃখিতা দ্ৰৌপদীর প্রতি কৃষ্ণের সান্ত্বনা

তখন শ্ৰীকৃষ্ণ সেই বীরসমবায়মধ্যে কৃষ্ণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে ভাবিনি! তুমি যাহাদিগের উপর রোষপরবশ হইয়াছ, তাহাদিগের পত্নীগণ স্ব স্ব বল্লভদিগকে অর্জ্জুনশরসংবিদ্ধ, শোণিতপরিপ্লুত ও ধরাতলে পতিত দেখিয়া এইরূপ নিরন্তর নয়নজল বিসর্জ্জন করিবে। আমি ক্ষমতানুসারে পাণ্ডবদিগের উদ্দেশ্যসংসাধন করিতে কদাচ ত্রুটি করিব না; এক্ষণে আর শোক করা কোনক্রমেই বিধেয় নহে। আমি সত্য করিয়া কহিতেছি, তুমি রাজমহিষী হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে কৃষ্ণে! আকাশ পতিত, হিমাচল বিশীর্ণ, সমুদ্র শুষ্ক ও ভূমণ্ডল খণ্ড খণ্ড হইলেও আমার এই বাক্য কদাচ ব্যর্থ হইবে না।”

পাঞ্চালী কৃষ্ণের এইরূপ প্রত্যুত্তর কর্ণগোচর করিয়া সাচীকৃত [ভ্রূভঙ্গীকৃত] মুখে অর্জ্জুনের প্রতি কটাক্ষ-বিক্ষেপ করিলে, অর্জ্জুন তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “প্রিয়ে! এক্ষণে আর রোদন করিও না। কৃষ্ণ যাহা কহিলেন, ইহার কদাচ অন্যথা হইবে না।” অনন্তর ধৃষ্টদ্যুম্ন কহিলেন, “হে ভগিনি! আমি দ্রোণকে বিনাশ করিব; শিখন্তী ভীষ্মকে, ভীমসেন দুৰ্য্যোধনকে ও ধনঞ্জয় কৰ্ণকে সংহার করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের কথা দূরে থাকুক, আমরা রামকৃষ্ণকে অবলম্বন করিয়া রণস্থলে দণ্ডায়মান হইলে দেবরাজ ইন্দ্রেরও জয় করিবার সম্ভাবনা থাকে না।” ধৃষ্টদ্যুম্ন এই কথা কহিয়া প্রতিনিবৃত্ত হইলে অন্যান্য বীরগণ কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।