১০ম অধ্যায়
যুধিষ্ঠির প্রতি ভীমের সখেদ কৰ্ম্মানুষ্ঠান উক্তি
ভীমসেন কহিলেন, “মহারাজ! আপনার অর্থবিষয়িণী বুদ্ধি তিরোহিত হওয়াতে এক্ষণে আপনি হতভাগ্য শ্রোত্রিয়ের ন্যায় কথা কহিতেছেন। যদি রাজধৰ্ম্মে দ্বেষ প্রকাশ করিয়া আলস্যে কালহরণ করিবেন, তবে কি নিমিত্ত ধৃতরাষ্ট্রপক্ষীয় বীরগণকে বিনাশ করিলেন? ক্ষাত্রধর্ম্মাবলম্বী ব্যক্তিরা মিত্রের প্রতিও ক্ষমা, অনুকম্পা, কারুণ্য বা অনৃশংসতা প্রকাশ করেন না। যাহা হউক, আমরা পূর্বে আপনার এরূপ বুদ্ধি জানিতে পারিলে কদাচ শস্ত্রগ্রহণ বা কোন ব্যক্তির প্রাণসংহার করিতাম না; যাবজ্জীবন ভিক্ষা করিয়া কালহরণ করিতাম। তাহা হইলে ভূপালগণ কদাচ এই দারুণ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতেন না। পণ্ডিতগণ স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় বস্তুকেই প্রাণধারণের উপায় বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। ক্ষাত্রধর্ম্মবিদ পণ্ডিতেরা কহেন যে, রাজ্যগ্রহণকালে যে ব্যক্তি শত্রুতাচরণ করিবে, তাঁহাদিগকে নিপাতিত করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য। আমরা তাঁহাদের নির্দেশানুসারে শত্রুগণকে সংহারপূর্ব্বক রাজ্য গ্রহণ করিয়াছি; এক্ষণে আপনি ধৰ্ম্মানুসারে রাজ্যভোগ করুন। জলাথী ব্যক্তির কূপ খননপূৰ্ব্বক জল প্রাপ্ত না হইয়া পঙ্কলিপ্তগাত্রে প্রতিনিবৃত্ত হওয়া, মধুলোলুপ ব্যক্তির মহাবৃক্ষে আরোহণ ও মধু আহরণপূৰ্ব্বক মধুপান না করিয়া প্রাণত্যাগ করা, ধনার্থী ব্যক্তির আশাবলে প্রভূত পথ অতিক্রমপূৰ্ব্বক নিরাশ হইয়া প্রতিনিবৃত্ত হওয়া, বীরপুরুষের সমুদয় শত্রু নিপাতিত করিয়া পরিশেষে আত্মহত্যা করা এবং ক্ষুধিত ব্যক্তির অন্ন লাভ ও কামুক পুরুষের কামিনী লাভ করিয়া ভোগ না করা যেরূপ শোচনীয়, আমাদের শত্রুবিনাশপূৰ্ব্বক রাজ্য পরিত্যাগ করাও তদ্রূপ সন্দেহ নাই। এক্ষণে আপনার বুদ্ধিভ্রংশ হইয়াছে। আমরা আপনাকে জ্যেষ্ঠ বলিয়া আপনার অনুগত থাকিয়া জনসমাজে নিন্দনীয় হইতেছি। আমরা বহুবলী ও কৃতবিদ্য হইয়াও অশক্তের ন্যায় ক্লীবের বাক্যের অধীন হইয়া রহিয়াছি; সুতরাং লোকে কেন আমাদিগকে গতিহীন ও অর্থভ্রষ্ট অবলোকন না করিবে। আপদগ্রস্ত, জরাগ্রস্ত অথবা শক্তহস্তে পরাজিত ব্যক্তিরই সমুদয় ঐশ্বৰ্য্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বৈরাগ্য অবলম্বন করা কর্ত্তব্য। সূক্ষ্মদর্শী বুদ্ধিমান লোকেরা এই নিমিত্তই বিষয় পরিত্যাগ ধৰ্ম্মবিরুদ্ধ ও অকৰ্ত্তব্য বলিয়া বোধ করেন। ক্ষত্রিয়গণ হিংসাৰ্থই জন্মগ্রহণ করেন। হিংসাই তাঁহাদের একমাত্র অবলম্বন, সুতরাং সেই সহজ হিংসাধৰ্ম্মের ও তাঁহার সৃষ্টিকর্তার নিন্দা করা ক্ষত্রিয়ের নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। বেদের তাৎপৰ্য্যগ্রহণে অসমর্থ নির্ধন ব্যক্তিগণই ক্ষত্রিয়ের সন্ন্যাসধৰ্ম্ম অবলম্বন করা অকৰ্ত্তব্য নহে বলিয়া স্থির করিয়া গিয়াছে। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সন্ন্যাসরূপ কপটধর্ম্ম আশ্রয় করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করা নিতান্ত কঠিন, উহাতে অচিরাৎ জীবননাশ হইবারই বিলক্ষণ সম্ভাবনা। যে ব্যক্তি পুত্র, পৌত্র, দেবতা, ঋষি, অতিথি ও গুরুজনের ভরণপোষণ করিতে অসমর্থ, সেই ব্যক্তিই একাকী অরণ্যমধ্যে সুখে কালহরণ করিতে পারে। অরণ্যচারী মৃগ, বরাহ ও পক্ষিগণের ন্যায় পুণ্যকৰ্ম্মানুষ্ঠানবিমুখ বনচারী মনুষ্যগণও স্বর্গলাভে অসমর্থ হয়। যদি ত্যাগশীল হইলেই সিদ্ধিলাভ করা যাইত, তাহা হইলে পর্ব্বত ও বৃক্ষগণেরও অনায়াসে সিদ্ধিলাভ হইত। লোকে আপনার ভাগ্যবলেই সিদ্ধ হয়, অন্যের ভাগ্যবলে কদাচ সিদ্ধিলাভে সমর্থ হয় না। অতএব কৰ্ম্মানুষ্ঠান করা সকলেরই কর্ত্তব্য, কৰ্ম্ম ব্যতীত সিদ্ধিলাভের উপায়ান্তর নাই। যদি কেবল আপনার ভরণপোষণ করিলেই সিদ্ধিলাভ করা যাইত, তাহা হইলে জলজন্তু ও স্থাবরগণেরও অনায়াসে সিদ্ধিলাভ হইত। জগতের যাবতীয় লোক স্ব স্ব কৰ্ম্মে ব্যাপৃত রহিয়াছে। অতএব কৰ্ম্মানুষ্ঠানই অবশ্য কর্ত্তব্য। কর্ম্মহীন ব্যক্তি কদাচ সিদ্ধিলাভ করিতে পারে না।”