অষ্টম অধ্যায়
রুরু-চরিত
সূত কহিলেন, হে ব্রহ্মন্! ভৃগুনন্দন চ্যবন সুকন্যার গর্ভে পরমতেজস্বী প্রমতি নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। ঘৃতাচীর গর্ভে প্রমতির রুরু-নামক এক সন্তান হয়। রুরুর ঔরসে প্রমদ্বরার গর্ভে শুনক নামে তনয় জন্মে। সেই মহাতেজা রুরুর সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তর বর্ণনা করিতেছি, শ্রবণ করুন।
পূর্ব্বকালে সর্ব্বভূতহিতৈষী, সর্ব্ববিদ্যাবিশারদ, তপোনিরত স্থূলকেশ নামে এক মহর্ষি ছিলেন। ঐ সময়ে গন্ধর্ব্বরাজ বিশ্বাবসুর সংযোগে অপ্সরা মেনকা গর্ভবতী হইয়াছিল। অকরুণা মেনকা প্রসবকাল উপস্থিত দেখিয়া মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমে গমন এবং তথায় গর্ভবিমোচন করিয়া নদীতীরে পলায়ন করিল। সেই গর্ভে এক পরমা সুন্দরী কুমারী জন্মিয়াছিল। তপোধনাগ্রণী স্থূলকেশ কিয়ৎক্ষণ পরে আশ্রমে উপস্থিত হইয়া সেই সুরকন্যাতুল্য সদ্যঃপ্রসূত কন্যাকে অসহায়া নির্জ্জনে পতিতা দেখিয়া কারুণ্যরসে আর্দ্রচিত্ত হইলেন এবং তৎক্ষণাৎ তাহাকে গ্রহণ করিয়া ঔরসকন্যা-নির্ব্বিশেষে লালন পালন করিতে লাগিলেন। তিনি স্বয়ং তাহার জাতকর্ম্মাদি সমস্ত কর্ম্ম বিধিপূর্ব্বক নির্ব্বাহ করিলেন। কন্যা সেই আশ্রমে শশিকলার ন্যায় দিনে দিনে পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। মহর্ষি স্থূলকেশ সেই কন্যাকে কি রূপে, কি গুণে, কি শীলে সর্ব্বপ্রকারেই সমস্ত প্রমদাগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দেখিয়া তাহার নাম প্রমদ্বরা রাখিলেন।
একদা প্রমতিনন্দন রুরু স্থূলকেশের আশ্রমে সেই প্রমদ্বরাকে নিরীক্ষণ করিয়া অত্যন্ত কামাতুর হইলেন। পরে আপন বয়স্যগণ দ্বারা পিতার নিকট স্বীয় অভিলাষ জানাইলেন। প্রমতি তদনুসারে মহর্ষি স্থূলকেশের নিকট গিয়া আপন পুৎত্রের নিমিত্ত সেই কন্যা প্রার্থনা করিলেন। মহর্ষি স্থূলকেশ ফল্গুনী নক্ষত্রযুক্ত দিবসে বিবাহের দিন নির্দ্ধারিত করিয়া রুরুকে প্রমদ্বরা সম্প্রদান করিলেন।
একদা বরবর্ণিনী প্রমদ্বরা আপন সহচরীগণ সমভিব্যাহারে ক্রীড়াকৌতুক করিতে করিতে দৈবগত্যা প্রসুপ্ত ও কেলিভূমিতে পতিত এক কৃষ্ণসর্পকে পাদাহত করিল। সর্প ক্রুদ্ধ হইয়া বিষাক্ত দশন-পংক্তি দ্বারা তৎক্ষণাৎ তাহাকে দংশন করাতে সে বিবর্ণা, বিচেতনা ও ভ্রষ্টাভরণা হইয়া ছিন্নমূল কদলীর ন্যায় ভূতলে পড়িল। তদীয় সখীগণ তাহাকে মুক্তকেশা, ভ্রষ্টবেশা ও ভূপৃষ্ঠে পতিতা দেখিয়া বিষাদ-সাগরে নিমগ্ন হইয়া হাহাকার করিতে লাগিল। কিন্তু প্রমদ্বরা ভূজঙ্গবিষে অভিভূতা ও বিবর্ণা হইয়াও পুনর্ব্বার পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর রমণীয় হইয়া উঠিল। ফলতঃ তখন তাহাকে বোধ হইতে লাগিল, যেন অকাতরে নিদ্রা যাইতেছে।
তদীয় পিতা মহর্ষি স্থূলকেশ ও অন্যান্য মহর্ষিগণ প্রমদ্বরাকে বিগতাসু ও ভূতলে পতিত দেখিলেন। তদনন্তর স্বস্ত্যাত্রেয়, মহাজানু, কুশিক, শঙ্খমেখল, উদ্দালক, কঠ, শ্বেত, ভারদ্বাজ, কৌণকূৎস, আর্ষ্টিষেন, গৌতম, প্রমতি, রুরু ও অন্যান্য তপোবনবাসী তপোধনগণ কারুণ্য-রস-পরবশ হইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। পরে সেই পরমাসুন্দরী কন্যাকে আশীবিষ বিষার্দ্দিত মৃত ও ভূতলে পতিত দেখিয়া সকলেই রোদন করিতে লাগিলেন। রুরু প্রিয়তমাকে তদবস্থ দেখিয়া নিতান্ত উদ্ভ্রান্ত ও একান্ত কাতর হইয়া তথা হইতে বহির্গমন করিলেন।