৬ষ্ঠ অধ্যায়
বিদুর-প্রত্যাখ্যানে ভীত ধৃতরাষ্ট্রের তদীয় অন্বেষণ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, ধীমান বিদুর পাণ্ডবগণের আশ্রমে গমন করিলে পর মহাপ্ৰজ্ঞ ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের সন্ধি-বিগ্রহবিষয়ক বিশেষ প্রভাব ও তন্নিবন্ধন পাণ্ডবগণের সাতিশয় বৃদ্ধিলাভের বিলক্ষণ সম্ভাবনা বুঝিতে পারিয়া মনে মনে সমধিক পরিতপ্ত হইতে লাগিলেন। তিনি সভাদ্ধারে আগমনপূর্ব্বক বিদুরবিরহে বিমোহিত ও ভূপতিগণ-সমক্ষে নিপতিত হইয়া বিচেতন হইলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে পুনরায় সংজ্ঞাপ্ৰাপ্ত হইয়া গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক সমীপস্থিত সঞ্জয়কে কহিলেন, “হে সঞ্জয়! পরমধার্ম্মিক বিদুর আমার ভ্রাতা ও প্ৰণয়পবিত্ৰ মিত্র; আদ্য তাহাকে স্মরণ করিয়া আমার হৃদয় যেন বিদীর্ণ হইতেছে; তুমি শীঘ্ৰ তাহাকে আনয়ন কর।” মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ইহা বলিয়া করুণস্বরে বিলাপ ও অনুতাপ করিয়া ভ্রাতৃবিরহে সাতিশয় কাতর হইয়া স্নেহবশতঃ পুনরায় সঞ্জয়কে কহিতে লাগিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি শীঘ্ৰ গিয়া জান যে, আমার সেই ভ্ৰাতা জীবিত আছেন কি না? আমি নিতান্ত পাপাত্মা, রোষাভরে সেই প্রিয়তম ভ্রাতাকে অপসারিত করিয়াছি। সেই অমিতবুদ্ধি পরমপ্রাজ্ঞ বিদুর কখন আমার নিকট অণুমাত্রও অপরাধ করেন নাই, আমি বিনাপরাধে তাহার অপমান করিয়াছি। হে সঞ্জয়! তুমি শীঘ্ৰ গিয়া তাঁহাকে আনয়ন কর, নচেৎ আমি প্ৰাণ পরিত্যাগ করিব।”
সঞ্জয়ের কাম্যাকবনে গমন-বিন্দুরসাক্ষাৎকার
সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের এইরূপ বচন শ্রবণ করিয়া ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া সত্বর পাণ্ডবগণাধিষ্ঠিত কাম্যাকবনে প্রস্থান করিলেন এবং গিয়া দেখিলেন, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির রৌরবচর্ম্ম পরিধানপূর্ব্বক মহাত্মা বিদুর, ভ্রাতৃচতুষ্টয় ও সহস্ৰ সহস্ৰ ব্ৰাহ্মণগণে পরিবৃত হইয়া দেবগণপরিবেষ্টিত পুরন্দরের ন্যায় উপবিষ্ট রহিয়াছেন। তখন তিনি সত্বর তাঁহাদের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া অগ্ৰে যুধিষ্ঠির, পরে ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেবকে বন্দনা করিয়া আসনে উপবিষ্ট হইলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাহাকে কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। পরে সঞ্জয় কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিয়া সম্বোধনপূর্ব্বক বিদুরকে আপনার আগমন-করণ কহিতে লাগিলেন, “হে ক্ষত্তঃ! অম্বিকানন্দন রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনাকে স্মরণ করিতেছেন, অতএব হে কুরুনন্দন! মহারাজের নিয়োগানুসারে নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণের নিকট বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক ত্বরায় তাহার সহিত সাক্ষাৎ কিরয়া তাঁহার জীবন রক্ষা কর।”
স্বজনবৎসল ধীমান বিদুর সঞ্জয়বাক্য শ্রবণানন্তর যুধিষ্ঠিরের অনুমতিগ্রহণ করিয়া পুনরায় হস্তিনানগরে উপস্থিত হইলেন। তখন প্রতাপশালী মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাকে দেখিয়া কহিলেন, “হে ভ্ৰাতঃ! আমার পরম ভাগ্য যে, তুমি আমাকে স্মরণ করিয়া পুনরায় আমার নিকট আসিয়াছ। আমি অদ্য তোমার নিমিত্ত দিবারাত্র জাগরিত থাকিয়া মনে মনে আপনার বিচিত্ৰ দেহ দেখিতেছি।” মহাতেজঃ অম্বিকানন্দন এই বলিয়া বিদুরকে ক্রোড়ে আনয়নপূর্ব্বক মস্তকাঘ্রাণ করিলেন এবং ‘হে ভ্ৰাতঃ! আমার অপরাধ ক্ষমা কর’ বলিয়া সাত্ত্বনা করিতে লাগিলেন। বিদুর কহিলেন, “হে রাজন! আমি ক্ষান্ত হইয়াছি, আপনি আমার পরম গুরু, আমি আপনার দর্শনাকাঙ্ক্ষী হইয়া ত্বরায় এখানে আসিয়াছি। হে ভরত-কুলতিলক! পাণ্ডবগণ ও আপনার পুত্ৰগণ উভয়েই আমার পক্ষে সমান, কিন্তু অদ্য পাণ্ডুপুত্রদিগকে দীন দেখিয়া আমার মন তাহাদিগের প্রতি সমধিক আকৃষ্ট হইয়াছে। অতএব তাহাদের প্রতি করুণা প্রকাশ করা পরম পবিত্র কর্ম্ম। দেখুন, ধর্ম্মপরায়ণ মানবেরা সততই দীনগণের প্রতি করুণা প্রকাশ করিয়া থাকেন, সন্দেহ নাই।” মহাত্মা বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্র পরস্পর এইরূপ কথোপকথন করিয়া সমুচ্ছলিত আনন্দসাগরে নিমগ্ন হইলেন।