৬ষ্ঠ অধ্যায়
কৃষ্ণকে স্বপক্ষে আনয়নের জন্য দুৰ্য্যোধন-অর্জ্জুনের তৎসমীপে গমন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডব প্রভৃতি মহীপালগণ হস্তিনানগরে দ্রুপদপুরোহিত প্ৰস্থাপিত করিয়া স্থানে স্থানে নরপতিগণের নিকট দূত প্রেরণা করিতে লাগিলেন; ধনঞ্জয় স্বয়ং কেবল দ্বারাবতীনগরে গমন করিলেন। এ দিকে বাসুদেব বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজগণ ও বলদেবের সহিত বিরাটনগর হইতে দ্বারাবতী প্রস্থান করিলে পর রাজা দুৰ্য্যোধনও গুপ্তচরদ্বারা পাণ্ডবগণের বিচেষ্টিতসকল অবগত হইয়া বায়ুবেগশালী তুরঙ্গ সমূহের সাহায্যে পরিমিতবলসমভিব্যাহারে দ্বারকানগরে গমন করিলেন। এইরূপে দুৰ্য্যোধন ও ধনঞ্জয় উভয় বীরই এক দিবসে আনর্ত্তদেশে উপস্থিত হইলেন। বাসুদেব তৎকালে শয়ান ও নিদ্রাভিভূত ছিলেন। প্রথমে রাজা দুৰ্য্যোধন তাহার শয়নগৃহে প্ৰবেশ করিয়া তাঁহার মস্তকসমাপন্যস্ত প্রশস্ত আসনে উপবেশন করিলেন; ইন্দ্ৰনন্দন পশ্চাৎ প্রবেশপূর্ব্বক বিনীত ও কৃতাঞ্জলি হইয়া যাদবপতির পদতলসমীপে সমাসীন হইলেন। অনন্তর বৃষ্ণিনন্দন জাগরিত হইয়া অগ্ৰে ধনঞ্জয়, পরে দুৰ্য্যোধনকে নয়নগোচর করিবামাত্র স্বাগত প্ৰশ্নসহকারে সৎকারপূর্ব্বক আগমনহেতু জিজ্ঞাসা করিলেন।
দুৰ্য্যোধন সহাস্যবদনে কহিলেন, “হে যাদব! এই উপস্থিত যুদ্ধে আপনাকে সাহায্যদান করিতে হইবে। যদিও আপনার সহিত আমাদিগের উভয়েরই সমান সম্বন্ধ ও তুল্য সৌহার্দ্য, তথাপি আমি অগ্ৰে আগমন করিয়াছি। সাধুগণ প্রথমাগত ব্যক্তিরাই পক্ষ অবলম্বন করিয়া থাকেন, আপনি সাধুগণের শ্রেষ্ঠ ও মাননীয়; অতএব অদ্য সেই সদাচার প্রতিপালন করুন।”
কৃষ্ণের পাণ্ডবপক্ষগ্রহণ—কুরুপক্ষে সৈন্যপ্রদান
কৃষ্ণ কহিলেন, “হে কুরুবীর! আপনি যে অগ্রে আগমন করিয়াছেন, এ বিষয়ে আমার কিছুমাত্ৰ সংশয় নাই, কিন্তু আমি কুন্তীকুমারকে অগ্রে নয়নগোচর করিয়াছি। এই নিমিত্ত আমি আপনাদের উভয়েরই সাহায্য করিব। কিন্তু ইহা প্ৰসিদ্ধ আছে, অগ্ৰে বালকেরই বরণ করিবে; অতএব অগ্ৰে কুন্তীকুমারের বরণ করাই উচিত।” এই বলিয়া ভগবান যদুনন্দন ধনঞ্জয়কে কহিলেন, “হে কৌন্তেয়! অগ্ৰে তোমারই বরণ গ্রহণ করিব। আমার সমযোদ্ধা নারায়ণ নামে বিখ্যাত এক অর্বুদ গোপী একপক্ষের সৈনিকপদ গ্ৰহণ করুক, আর অন্যপক্ষে আমি সমরপরাঙ্মুখ ও নিরস্ত্ৰ হইয়া অবস্থান করি, ইহার মধ্যে যে পক্ষ তোমার হৃদ্যতর [সমধিক অভিপ্রেত] হয়, তাহাই অবলম্বন কর।”
ধনঞ্জয় অরাতিমৰ্দন জনাৰ্দন সমরপরাঙ্মুখ হইবেন শ্রবণ করিয়াও তাহাকেই বরণ করিলেন। তখন রাজা দুৰ্য্যোধন এক অর্বুদ নারায়ণী সেনা প্রাপ্ত হইয়া কৃষ্ণকে সমরপরাঙ্মুখ বিবেচনা করিয়া প্রীতির পরাকাষ্ঠা প্ৰাপ্ত হইলেন।
অনন্তর তিনি ঐ সমস্ত নারায়ণী সেনা সংগ্রহপূর্ব্বক রৌহিণেয় [রোহিণীরপুত্ৰ—বলদেব]-সমীপে সমুপস্থিত হইয়া আপনার আগমনহেতু নিবেদন করিলে তিনি কহিলেন, “হে নররাজ! আমি বিরাটরাজভবনে বৈবাহিক সভায় তোমার নিমিত্ত হৃষীকেশকে নিগ্রহপূর্ব্বক পুনঃ পুনঃ কহিয়াছিলাম যে, আমাদিগের সহিত ধার্ত্তরাষ্ট্র ও পাণ্ডবগণের সম্বন্ধগত কিছুমাত্ৰ বৈলক্ষণ্য নাই; তথাপি হৃষীকেশ আমার ঐ সকল বাক্য গ্ৰহণ করিলেন না। কিন্তু হৃষীকেশ বিনা ক্ষণমাত্রও অবস্থান করিতে আমার সামর্থ্য নাই। আমি তাহার অনুরোধে এই স্থির করিয়াছি যে, কি পাণ্ডবের কি তোমার—কাহারও সাহায্য করিব না। অতএব প্রস্থান কর; তুমি সকল পার্থিবপূজিত ভারতবংশে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছ, অবশ্যই ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্ম অনুসারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবে।”
বলদেবের বাক্যাবসান হইলে দুর্য্যোধন তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন, এবং কৃষ্ণকে সমরপরাঙ্মুখ ও ন্যস্তশস্ত্র [অস্ত্রত্যাগী] মনে করিয়া যুদ্ধে অবশ্যই জয়লাভ হইবে বিবেচনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি কৃতবর্ম্মার সমীপে গমন করিলে সেই মহাত্মা তাঁহাকে অক্ষৌহিণী সেনা প্ৰদান করিলেন। এইরূপে রাজা দুর্য্যোধন ভীমবলবলসমূহপরিবৃত হইয়া সুহৃদগণের হর্ষোৎপাদনপূর্ব্বক প্রফুল্লচিত্তে প্ৰস্থান করিলেন।
অনন্তর বাসুদেব অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে পাৰ্থ! তুমি আমাকে সমরে পরাঙ্মুখ জানিয়াও কি নিমিত্ত বরণ করিলে?”
অর্জ্জুন কহিলেন, “ভগবন! আপনি সমস্ত ধার্ত্তরাষ্ট্রকে সংসার করিতে সমর্থ ও আপনার কীর্ত্তিও ত্ৰিলোকবিখ্যাত, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি একাকী তাহাদিগকে বিনাশ করিয়া অসীম যশোলাভ করিব, এই বাসনায় আপনাকে সমরপরাঙ্মুখ জানিয়াও বরণ করিয়াছি। আমার অভিলাষ এই যে, আপনি আমার সারথকাৰ্য্য স্বীকার করিয়া আমার এই চিরপ্ররূঢ় [চিরপোষিত—বহু আকাঙ্ক্ষিত] মনোরথ পূর্ণ করুন।”
বাসুদেব কহিলেন, “অর্জ্জুন! তুমি আমার সহিত যে স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাক, তাহা নিতান্ত উপযুক্ত। আমি তোমার সারথ্য গ্ৰহণ করিয়া কামনা পরিপূর্ণ করিব।” এই প্রকার কথোপকথনানন্তর অর্জ্জুন ও বাসুদেব ভুরি ভুরি দশার্হবীর [যাদববংশীয়] সমভিব্যাহারে যুধিষ্ঠির সমীপে উপনীত হইলেন।