সমন্তপঞ্চকোপাখ্যান
ঋষিগণ কহিলেন, “হে সূতনন্দন! আমরা ভারতের অনুক্রমণিকা শুনিলাম, এক্ষণে সমন্তপঞ্চক নামক যে তীর্থের উল্লেখ করিয়াছ, তাহার যাহা কিছু বর্ণনীয় আছে সমুদয় শ্রবণ করাইয়া আমাদিগকে চরিতার্থ কর।” ঋষিদিগের এইরূপ প্রার্থনাবাক্যে সন্তুষ্ট হইয়া অতি শিষ্টপ্রকৃতি সৌতি কহিতে লাগিলেন, হে ব্রাহ্মণগণ! আমি আপনাদিগের সম্মুখে সমন্তপঞ্চক তীর্থের বৃত্তান্ত ও অন্যান্য কথা প্রসঙ্গক্রমে সমুদয় কীর্ত্তন করিতেছি, অবধান করুন।
অদ্বিতীয় বীর পরশুরাম ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের সন্ধিতে পিতৃবধ-বার্ত্তা শ্রবণ করিয়া ক্রোধপরায়ণ হইয়া এই পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষৎত্রিয়া করেন। তিনি স্ববিক্রম-প্রভাবে নিঃশেষে ক্ষৎত্রিয়কুল উৎসন্ন করিয়া সেই সমস্তপঞ্চকে শোণিতময় পঞ্চহ্রদ প্রস্তুত করেন। শুনিয়াছি, তিনি রোষপরবশ হইয়া সেই হ্রদের রুধির দ্বারা পিতৃলোকের তর্পণ করিয়াছিলেন। অনন্তর ঋচীক প্রভৃতি পিতৃগণ তথায় আগমন করিয়া পরশুরামকে কহিলেন, “হে মহাভাগ রাম! তোমার এরূপ অবিচলিত পিতৃভক্তি ও অসাধারণ বিক্রম দর্শনে আমরা অত্যন্ত প্রীত হইয়াছি, এক্ষণে তুমি আপনার অভিলষিত বর প্রার্থনা কর।” রাম কহিলেন, “হে পিতৃগণ! যদি প্রসন্ন হইয়া ইচ্ছানুরূপ বর প্রদানে অনুগ্রহ করেন, তাহা হইলে ক্রোধে অধীর হইয়া ক্ষৎত্রিয়বংশ ধ্বংস করিয়া যে পাপরাশি সঞ্চয় করিয়াছি, সেই সকল পাপ হইতে যাহাতে মুক্ত হই এবং এই শোণিতময় পঞ্চহ্রদ অদ্যাবধি পৃথিবীতে তীর্থস্থান বলিয়া যাহাতে প্রখ্যাত হয়, এরূপ বর প্রদান করুন।”পিতৃগণ ‘তথাস্তু’ বলিয়া পরশুরামের অভিমত বর প্রদানপূর্ব্বক সেইরূপ অধ্যাবসায় হইতে তাঁহাকে ক্ষান্ত হইতে আদেশ করিলেন। তিনিও তদবধি ক্ষৎত্রিয়দিগের উপর আর কোনরূপ অত্যাচার করিলেন না।
সেই শোণিতময় পঞ্চহ্রদের সন্নিধানে যে সকল প্রদেশ আছে, তাহাকেই পরম পবিত্র সমন্তপঞ্চক তীর্থ বলিয়া নির্দ্দেশ করা হয়। কারণ, পণ্ডিতেরা কহেন, যে দেশ যে কোন বিশেষ চিহ্নে চিহ্নিত, তাহা তন্নামেই প্রখ্যাত হইয়া থাকে। ঐ সমন্তপঞ্চক তীর্থে কলি ও দ্বাপরের অন্তরে কুরু ও পাণ্ডবসৈন্যের ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল। অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা যুদ্ধার্থে ভূদোষবর্জ্জিত সেই পুণ্যক্ষেত্রে সমবেত ও নিহত হয়। হে ব্রাহ্মণগণ! ইহাই তাহার যথার্থ ব্যুৎপত্তিলভ্য অর্থ। সেই তীর্থ অতি পবিত্র ও রমণীয়। হে ধর্ম্মপরায়ণ মহর্ষিগণ! ত্রিলোকে ঐ দেশ যেরূপ বিখ্যাত, তাহা আপনাদের সমক্ষে কহিলাম।
অক্ষৌহিণী-পরিমাণ
ঋষিগণ কহিলেন, “হে সুতনন্দন! তুমি যে অক্ষৌহিণী শব্দের উল্লেখ করিলে, আমরা তাহার অর্থ শুনিতে ইচ্ছা করি। কারণ, তুমি সকলই জান, অতত্রব কত নর, কত হস্তী, কত অশ্ব ও কত রথে এক অক্ষৌহিণী হয়, তাহা সপ্রমাণ করিয়া বল।” সৌতি কহিলেন,– এক রথ, এক হস্তী, পঞ্চ পদাতি ও তিন অশ্ব, ইহাতে একটি পত্তি হয়। তিন পত্তিতে এক সেনামুখ, তিন সেনামুখে এক গুল্ম, তিন গুল্মে এক গণ, তিন গণে এক বাহিনী, তিন বাহিনীতে এক পৃতনা, তিন পৃতনায় এক চমু, তিন চমূতে এক অনীকিনী, দশ অনীকিনীতে এক অক্ষৌহিণী হয়। এক অক্ষৌহিণীতে একবিংশতি সহস্র অষ্টশত ও সপ্ততি-সংখ্যক রথ ও তৎসংখ্যক গজ, একলক্ষ নয় সহস্র তিন শত পঞ্চাশ জন পদাতি এবং পঞ্চষষ্টি সহস্র ছয় শত দশ অশ্ব থাকে। আমি যে অক্ষৌহিণী শব্দের উল্লেখ করিলাম, সংখ্যাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা তাহার এইরূপ নিরূপণ করিয়াছেন [এক অক্ষৌহিণীমাণ– ১ লক্ষ ৯ হাজার ৫০ পদাতি, ৬৫ হাজার ৬ শত ১০ অশ্ব, ২১ হাজার ৮ শত ৭০ হস্তী, ২১ হাজার ৮ শত ৭০ রথ। মোট সৈন্যসংখ্যা ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৭ শত]। সমন্তপঞ্চক তীর্থে কুরু ও পাণ্ডবদিগের এইরূপ অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা একত্র সমাগত হইয়াছিল। সেই সেনা কৌরবদিগকে উপলক্ষ্য করিয়া কালের অদ্ভুত ও অচিন্তনীয় শক্তিসহকারে তথায় মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়। তন্মধ্যে পরমাস্ত্রবেত্তা ভীষ্ম দশ দিবস যুদ্ধ করেন, দ্রোণ পাঁচ দিন কৌরবসেনা রক্ষা করিয়াছিলেন। পরবলপীড়ক কর্ণ দুই দিবস ও শল্য অর্দ্ধদিবস মাত্র যুদ্ধ করেন। তৎপরে ভীমসেন ও দুর্য্যোধনের গদাযুদ্ধ আরম্ভ হয়, তাহাও দিবসার্দ্ধ মাত্র। অনন্তর দিবসের অবসানে ও নিশার আগমন হইলে অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্য সকলে একমত অবলম্বন করিয়া অসঙ্কুচিতচিত্তে সুখপ্রসুপ্ত যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণকে সংহার করিলেন।
পর্ব্বসংগ্রহ
হে শৌনক! আপনার যজ্ঞে যে ভারতাখ্য ইতিহাস কহিব, বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন জনমেজয়ের সর্পসত্রকালে তাহা কীর্ত্তন করিয়াছিলেন। এই গ্রন্থের আরম্ভে পৌষ্য, পোলোম ও আস্তীকপর্ব্বে মহানুভব ভূপালদিগের বিচিত্র চরিত্র সম্যক্রূপে বর্ণিত আছে। ইহা বহুবিধ উপাখ্যান ও অনেকানেক লৌকিক আচার-ব্যবহারে পরিপূর্ণ। যাদৃশ মোক্ষার্থীরা একমাত্র পারত্রিক শুভসঙ্কল্পে বৈরাগ্য অবলম্বন করেন, তাদৃশ বিজ্ঞেরা মঙ্গললাভ প্রত্যাশায় এই পবিত্র ইতিহাসের আশ্রয় লইয়া থাকেন। যেমন সমস্ত জ্ঞাতব্য বস্তুমধ্যে আত্মা ও সকল প্রিয়বস্তুমধ্যে প্রাণ শ্রেষ্ঠ পদার্থ, সেইরূপ এই গ্রন্থ সর্ব্বশাস্ত্র অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। যেমন অন্নপান ব্যতীত জীবনধারণের আর উপায় নাই, সেইরূপ এই ইতিহাস যে সকল সুললিত কথা প্রতিপন্ন করিতেছে, তদ্ব্যতিরিক্ত ভূমণ্ডলে আর কথা নাই। যেমন সৎকুলোদ্ভব প্রভুকে প্রভুপরায়ণ ভৃত্যগণ অভ্যুদয়বাসনায় উপাসনা করে, সেইরূপ বুধগণ বিবিধ জ্ঞানলাভের অভিলাষে এই ভারতসংহিতার সেবা করিয়া থাকেন। যেমন স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ কি লৌকিক, কি বৈদিক সকল বাক্যকেই অধিকার করিয়া আছে, সেইরূপ এই অদ্ভুত ইতিহাসে বহুবিষয়ে শুভকরী বুদ্ধিবৃত্তি সমর্পিত হইয়াছে।
হে ঋষিগণ! এক্ষণে বেদপ্রতিপাদ্য, সনাতন ধর্ম্মে অলঙ্কৃত, অনুভূতপূর্ব্ব বিষয়ের মীমাংসাসহকৃত, সুচারুরূপে বিরচিত ভারতের পর্ব্বসংগ্রহ বলিতেছি, আপনারা অবধান করুন। প্রথম অনুক্রমণিকা-পর্ব্ব, দ্বিতীয় সংগ্রহ-পর্ব্ব, পরে পোষ্য ও পৌলোম পর্ব্ব, আস্তীক ও বংশাবতরণ-পর্ব্ব, তৎপরে পরমাশ্চর্য্য সম্ভবপর্ব্ব, তাহা শ্রবণ করিলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তৎপরে জতুগৃহ-দাহ, তৎপরে হিড়িম্ববধ, তৎপরে বকবধ, তৎপরে চৈত্ররথ-পর্ব্ব, তৎপরে দেবী পাঞ্চালীর স্বয়ংবর-বৃত্তান্ত, তৎপরে বিবাহ, তৎপরে বিদুরাগমন ও রাজ্যলাভ-পর্ব্ব, তৎপরে অর্জ্জুনের অরণ্যবাস, তৎপরে সুভদ্রাহরণ, তৎপরে যৌতুকাহরণপর্ব্ব, তৎপরে খাণ্ডবদাহ ও ময়দানবদর্শন, তৎপরে সভাপর্ব্ব, তৎপরে মন্ত্রপর্ব্ব, তৎপরে জরাসন্ধবধ, তৎপরে দিগ্বিজয়-পর্ব্ব, দিগ্বিজয়ের পর যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় মহাযজ্ঞ, তৎপরে অর্ঘ্যাভিহরণ, তৎপরে শিশুপালবধ, তৎপরে দ্যূত ও অনুদ্যূত-পর্ব্ব, তৎপরে অরণ্য, তৎপরে কির্ম্মীর-বধ, তৎপরে অর্জ্জুনের অভিগমন ও তৎপরে মহাদেব ও অর্জ্জুনের যুদ্ধ, ইহাকে কিরাতপর্ব্ব বলিয়া নির্দ্দেশ করা হয়। তৎপরে ইন্দ্রলোকাভিগমন, তৎপরে নলোপাখ্যান, ইহা শ্রবণ করিলে অশ্রুপাত হয়। তৎপরে যুধিষ্ঠিরের তীর্থযাত্রা-পর্ব্ব, তৎপরে যক্ষযুদ্ধ, তৎপরে নিবাতকবচযুদ্ধ-পর্ব্ব, তৎপরে অজগর-পর্ব্ব, তৎপরে মার্কণ্ডেয়-সমস্যা, তৎপরে দ্রৌপদী ও সত্যভামা-সংবাদ, তৎপরে ঘোষযাত্রা, তৎপরে মৃগস্বপ্নোদ্ভব-পর্ব্ব, তৎপরে ব্রীহিদ্রৌণিক-উপাখ্যান-পর্ব্ব, তৎপরে ঐন্দ্রদ্যুম্ন, তৎপরে দ্রৌপদীহরণ, তৎপরে জয়দ্রথ-বিমোক্ষণ, তৎপরে রামচন্দ্রোপখ্যান, তৎপরে পতিব্রতা সাবিত্রীর অদ্ভুত মহাত্ম্যবর্ণন, তৎপরে কুণ্ডলা-হরণ, তৎপরে আরণেয়, তৎপরে বিরাট-পর্ব্ব, তৎপরে পাণ্ডবদিগের প্রবেশ ও সময় প্রতিপালন, তৎপরে কীচকবধ, তৎপরে গোগ্রহণ, তৎপরে অভিমন্যুর সহিত উত্তরার বিবাহ, তৎপরে উদ্যোগ, তৎপরে সঞ্জয়াগমন-পর্ব্ব, অনন্তর ধৃতরাষ্ট্রের চিন্তামূলক প্রজাগর-পর্ব্ব, পরে সনৎসুজাত-পর্ব্ব, তৎপরে যানসন্ধি-পর্ব্ব, তৎপরে কৃষ্ণের গমন, তৎপরে মাতলীয় উপাখ্যান ও গালবচরিত, তৎপরে সাবিত্রীর উপাখ্যান, বামদেবোপাখ্যান, বৈণ্যোপাখ্যান ও জামদগ্ন্যোপাখ্যান, তৎপরে ষোড়শরাজিক-পর্ব্ব, তৎপরে কৃষ্ণের সভাপ্রবেশ, তৎপরে বিদুলাপুল্র-শাসন, তৎপরে সৈন্যোদ্যোগ ও শ্বেতোপাখ্যান-পর্ব্ব, তৎপরে মন্ত্রনিশ্চয় করিয়া কার্য্যচিন্তন, তৎপরে সেনাপতি-নিয়োগোপাখ্যান, তৎপরে শ্বেত ও বাসুদেব-সংবাদ, তৎপরে মহাত্মা কর্ণের বিবাদ, তৎপরে কুরুপাণ্ডব-সেনানির্যাণ, তৎপরে রথী ও অতিরথ-সংখ্যা-পর্ব্ব, অনন্তর অমর্ষবিবর্দ্ধন উলূকদূতের আগমন, তৎপরে অম্বোপাখ্যান, তৎপরে অদ্ভুত ভীষ্মভিষেক-পর্ব্ব, তৎপরে জম্বুদ্বীপনির্ম্মাণ-পর্ব্ব, তৎপরে ভূমিপর্ব্ব, তৎপরে দ্বীপবিস্তার-কথন-পর্ব্ব, তৎপরে ভগবদ্গীতা-পর্ব্ব, অনন্তর ভীষ্মবধ, তৎপরে দ্রোণাভিষেক, তৎপরে সংসপ্তক-সৈন্যবধ, তৎপরে অভিমন্যুবধ-পর্ব্ব, তৎপরে প্রতিজ্ঞা, তৎপরে জয়দ্রথবধ-পর্ব্ব, তৎপরে ঘটোৎকচবধ, তৎপরে পরমাশ্চর্য্য দ্রোণবধ-পর্ব্ব, তৎপরে নারায়ণাস্ত্রপ্রয়োগ-পর্ব্ব।
অনন্তর কর্ণপর্ব্ব, তৎপরে শল্যপর্ব্ব, তৎপরে হ্রদপ্রবেশ ও গদাযুদ্ধ-পর্ব্ব, অনন্তর সারস্বত ও তীর্থবংশানুকীর্ত্তন-পর্ব্ব, তদনন্তর অতি বীভৎস সৌপ্তিক-পর্ব্ব, অনন্তর দারুণ ঐষীক-পর্ব্ব, তৎপরে জলপ্রদানিক-পর্ব্ব, তৎপরে স্ত্রীবিলাপ-পর্ব্ব, তৎপরে ঔর্দ্ধ্বদেহিক পর্ব্ব, তৎপরে ব্রাহ্মণরূপী চার্বাক রাক্ষসের বধপর্ব্ব, তৎপরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অভিষেক-পর্ব্ব, তৎপরে গৃহপ্রবিভাগ-পর্ব্ব, অনন্তর শান্তিপর্ব্ব, এই পর্ব্বে রাজধর্ম্ম, আপদ্ধর্ম্ম ও মোক্ষধর্ম্ম কথিত আছে। তৎপরে শুকপ্রশ্নাভিগমন, তৎপরে ব্র্হ্মপ্রশ্নানুশাসন, তৎপরে দুর্ব্বাসার প্রাদুর্ভাব ও মায়াসংবাদ-পর্ব্ব, অনন্তর অনুশাসন-পর্ব্ব, অনন্তর ভীষ্মের স্বর্গারোহণপর্ব্ব, তৎপরে সর্বপাপপ্রণাশক আশ্বমেধিক-পর্ব্ব, তৎপরে অধ্যাত্মবিদ্যাবিষয়ক অনুগীতা-পর্ব্ব, তৎপরে আশ্রমবাসিক-পর্ব্ব, তৎপর পুৎত্রদর্শন-পর্ব্ব, তৎপরে নারদাগমন-পর্ব্ব, তৎপরে অতি ভীষণ মৌষল-পর্ব্ব, তৎপরে মহাপ্রস্থানিক-পর্ব্ব, তৎপরে স্বর্গারোহণিক-পর্ব্ব, অনন্তর খিলনামক হরিবংশ-পর্ব্ব; এই পর্ব্বে বিষ্ণু-পর্ব্ব, শিশুচর্য্যা, কংসবধ ও অতি অদ্ভুত ভবিষ্য-পর্ব্ব কথিত আছে। এই শত-পর্ব্ব মহাত্মা ব্যাসদেব কহিয়াছিলেন এবং নৈমিষারণ্যে যথাক্রমে লোমহর্ষণপুৎত্র সৌতি অষ্টাদশপর্ব্ব কীর্ত্তন করেন। সঙ্ক্ষেপে এই মহাভারতের পর্ব্বসংগ্রহ কহিলাম।
আদিপর্ব্ব–শ্লোকসংখ্যা
পৌষ্য, পৌলোম, আস্তীক, আদিবংশাবতরণ, সম্ভব, জতুগৃহ, হিড়িম্ব ও বকবধ, চৈত্ররথ, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর, বৈবাহিক, বিদুরাগমন, রাজ্যলাভ, অর্জ্জুনের বনবাস, সুভদ্রাহরণ, যৌতুকানয়ন, খাণ্ডবদাহ, ময়দানবদর্শন এই সকল আদিপর্ব্বের অন্তর্গত। পৌষ্য-পর্ব্বে উতঙ্কের মাহাত্ম্য ও পৌলোমপর্ব্বে ভৃগুবংশবিস্তার কথিত আছে। আস্তীকপর্ব্বে সর্পকুল ও গরুড়ের সম্ভব, ক্ষীরসমুদ্রমন্থন, উচ্চৈঃশ্রবার জন্ম, রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞানুষ্ঠান ও মহাত্মা ভরতবংশীয়দিগের চরিত্র কীর্ত্তিত আছে। সম্ভবপর্ব্বে অনেকানেক ভূপতিদিগের উৎপত্তি, অনেকানেক বীরপুরুষ ও মহর্ষি দ্বৈপায়নের জন্মবৃত্তান্ত এবং দেবতাদিগের অংশাবতরণ বর্ণিত আছে। দৈত্য, দানব, যক্ষ, সর্প, গন্ধর্ব্ব, পক্ষী ও অন্যান্য প্রাণীদিগের সমুদ্ভব; যাঁহার নামের অনুরূপে লোকে ভারতকুল বলিয়া প্রখ্যাত হইয়াছে, মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে দুষ্মন্তের ঔরসে শকুন্তলার গর্ভে সেই ভরতের জন্মলাভ। শান্তনুর আবাসে গঙ্গার গর্ভে বসুদিগের পুনর্জ্জন্ম ও তাঁহাদিগের স্বর্গে আরোহণ এবং তেজোংশের সম্পাত, ভীষ্মের সম্ভব এবং তাঁহার রাজ্যপরিত্যাগ ও ব্রহ্মচর্য্যব্রতধারণ, প্রতিজ্ঞাপালন এবং ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদের রক্ষা, চিত্রাঙ্গদের মৃত্যু হইলে কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্য্যের রক্ষাবিধান ও তাঁহার রাজ্যাধিকার, অণীমাণ্ডব্যের অভিশাপে ধর্ম্মের নরলোকের অংশে সম্ভব ও বরদানপ্রভাবে কৃষ্ণদ্বৈপায়নের ঔরসে উৎপত্তি, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও পাণ্ডবদিগের সম্ভব, বারণাবতপ্রস্থানে দুর্য্যোধনের মন্ত্রণা, পাণ্ডবদিগের প্রতি ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের কূটপ্রেরণ, ধীমান্ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের হিতসাধন করিবার নিমিত্ত পথিমধ্যে তাঁহাকে ম্লেচ্ছ ভাষায় বিদুরের অশেষ উপদেশ, বিদুরের পরামর্শক্রমে অতি গোপনে সুরঙ্গনির্ম্মাণ, রাত্রিকালে পঞ্চপুৎত্রের সহিত নিদ্রিতা নিষাদীকে জতুগৃহে পুরোচন নামক ম্লেচ্ছের সহিত দাহ, নিবিড় অরণ্যে পাণ্ডবদিগের হিড়িম্বদর্শন, মহাবল ভীমসেন হইতে হিড়িম্বের বধসাধন ও ঘটোৎকচের উৎপত্তি, মহাপ্রভাব মহর্ষি ব্যাসদেবের সন্দর্শন ও তাঁহার অনুমতিক্রমে একচক্রা নগরীতে এক ব্রাহ্মণের আবাসে ছদ্মবেশে বাস, বকবধে পুরবাসীদিগের বিস্ময়, দ্রৌপদী ও ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্ম, ব্রাহ্মণ-সন্নিধানে দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণপূর্ব্বক স্বয়ংবর-সভাদিদৃক্ষা [দর্শনেচ্ছা]- ক্রান্তচিত্ত হইয়া ব্যাসের আদেশে ও রমণীরত্নলাভের অভিলাষে পাঞ্চালদেশে পঞ্চপাণ্ডবদিগের গমন, গঙ্গাতীরে গন্ধর্ব্বরাজ অঙ্গারপর্ণকে পরাজয় করিয়া অর্জ্জুনের তাঁহার সহিত পরমসখ্যভাব-সংস্থাপন ও তৎসমীপে তপতী, বশিষ্ঠ ও ঔর্ব্বের রমণীয় উপাখ্যান শ্রবণ ও ভ্রাতৃগণের সহিত অর্জ্জুনের পাঞ্চালদেশে গমন, তথায় সমাগত অসংখ্য ভূপাল সমক্ষে লক্ষ্যভেদপূর্ব্বক ধনঞ্জয়ের দ্রৌপদী লাভ, ভীম ও অর্জ্জুন কর্ত্তৃক যুদ্ধে ক্রুদ্ধ রাজগণের সহিত শল্য ও কর্ণের পরাজয়, মহামতি অতি-শিষ্টপ্রকৃতি কৃষ্ণ ও বলরামের ভীমার্জ্জুনের সেইরূপ অপ্রমেয় ও অমানুষ-সাহস সন্দর্শনে পাণ্ডব বোধে তাঁহাদিগের সহিত সমাগত হইবার বাসনায় পরশুরামের গৃহপ্রবেশ, পঞ্চভ্রাতার এক ভার্য্যা হইবে বলিয়া দ্রুপদের বিমর্ষ, এইস্থলে পরমাশ্চর্য্য পঞ্চেন্দ্রের উপাখ্যানের উল্লেখ, পাঞ্চালীর দৈববিহিত অমানুষ বিবাহ, পাণ্ডবদিগের প্রতি ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক বিদুরপ্রেরণ, বিদুরের গমন ও কৃষ্ণের সন্দর্শন, পাণ্ডবদিগের খাণ্ডবপ্রস্থে বাস ও রাজ্যার্দ্ধের অধিকার, নারদের আদেশে পঞ্চপাণ্ডবের দ্রৌপদীবিষয়ক নিয়মসংস্থাপন, সুন্দোপসুন্দের ইতিহাস, অনন্তর দ্রৌপদীর সহিত একান্তে উপবিষ্ট যুধিষ্ঠিরের সন্নিকৃষ্ট হইয়া অর্জ্জুনের অস্ত্রগ্রহণ ও ব্রাহ্মণের গোধন আহরণপূর্ব্বক প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন জন্য অরণ্যবাস এবং তৎকালে উলুপীনাম্নী নাগকন্যার সহিত পথিমধ্যে অর্জ্জুনের সমাগম, পুণ্যতীর্থে গমন ও বভ্রুবাহনের জন্ম এবং তথায় তপস্বী ব্রাহ্মণের অভিসম্পাতে গ্রাহ [কুম্ভীর] যোনিপ্রাপ্ত পঞ্চ অপ্সরার শাপমোচন, প্রভাস-তীর্থে কৃষ্ণের সহিত অর্জ্জুনের সাক্ষাৎকারলাভ, কৃষ্ণের অভিমতে দ্বারকায় অর্জ্জুনের সুভদ্রাপ্রাপ্তি, যৌতুক-প্রদানের নিমিত্ত খাণ্ডবপ্রস্থে কৃষ্ণ প্রস্থিত হইলে পর সুভদ্রার গর্ভে অভিমন্যুর জন্ম, দ্রৌপদী-পুৎত্রের উৎপত্তি-কীর্ত্তন, যমুনায় জলবিহারার্থে গমন করিলে কৃষ্ণার্জ্জুনের চক্র ও ধনুলাভ, খাণ্ডবদাহ, প্রদীপ্ত অনলমধ্য হইতে ময়দানব ও ভুজঙ্গের পরিত্রাণ, মন্দপালনামা মহর্ষির ঔরসে শাঙ্গীর গর্ভে সুতোৎপত্তি, আদিপর্ব্বে এই সকল বর্ণিত আছে। বেদব্যাস এই পর্ব্বে দুই শত সপ্তবিংশতিসংখ্যক অধ্যায় কহিয়াছেন, তাহাতে অষ্ট সহস্র অষ্ট শত ও চতুরশীতি শ্লোক রচনা করেন।
সভাপর্ব্ব– শ্লোকসংখ্যা
অনন্তর বহুবৃত্তান্তযুক্ত দ্বিতীয় সভাপর্ব্ব আরম্ভ হইতেছে। পাণ্ডবদিগের সভা-নির্ম্মাণ, কিঙ্কর-দর্শন, দেবর্ষি নারদ কর্ত্তৃক ইন্দ্র প্রভৃতি লোকপালগণের সভাবর্ণন, রাজসূয়-মহাযজ্ঞের আরম্ভ, জরাসন্ধ-বধ, গিরিব্রজে নিরুদ্ধ রাজগণের কৃষ্ণ কর্ত্তৃক বিমোচন, পাণ্ডবদিগের দিগ্বিজয়, ভূপালদিগের রাজসূয়যজ্ঞে আগমন যজ্ঞে অর্ঘ্যদানপ্রসঙ্গে শিশুপালের সহিত বিবাদ ও তাহার বধ, পাণ্ডবদিগের রাজসূয়যজ্ঞে তাদৃশ সমৃদ্ধি সন্দর্শন করিয়া দুর্য্যোধনের বিষাদ ও ঈর্ষা, ভীমকর্ত্তৃক সভামধ্যে দুর্য্যোধনের প্রতি উপহাস ও তাহার ক্রোধ, তন্নিবন্ধন দ্যুতক্রীড়া, ধূর্ত্ত শকুনি-কর্ত্তৃক দ্যূতক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরের পরাজয়, দ্যূতার্ণবমগ্না দুঃখিতা দ্রৌপদীর ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক উদ্ধার, দ্রৌপদীকে বিপদ্ হইতে উত্তীর্ণা দেখিয়া দুর্য্যোধনের পুনর্ব্বার পাণ্ডবদিগের সহিত দ্যূতারম্ভ, দ্যূতে পরাজয় করিয়া তৎকর্ত্তৃক পাণ্ডবদিগের বনপ্রেরণ, মহর্ষি বেদব্যাস সভাপর্ব্বে এই সকল বর্ণন করিয়াছেন। এই পর্ব্বে অষ্টসপ্ততি অধ্যায় এবং দ্বিসহস্র পঞ্চশত একাদশ শ্লোক আছে।
বনপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অনন্তর অরণ্য নামক তৃতীয় পর্ব্ব। মহাত্মা পাণ্ডবগণ বনপ্রস্থান করিলে পৌরজন কর্ত্তৃক ধীমান্ যুধিষ্ঠিরের অনুগমন, ওষধি ও ব্রাহ্মণগণের ভরণপোষণের নিমিত্ত ধৌম্য মুনির উপদেশ-ক্রমে যুধিষ্ঠিরের সূর্য্যারাধনা, সূর্য্যের অনুগ্রহে অন্নলাভ, ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক হিতবাদী বিদুরের পরিত্যাগ, বিদুরের পাণ্ডবসমীপে গমন ও ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে পুনর্ব্বার তাঁহার নিকটে আগমন, কর্ণের উত্তেজনায় বনবাসী পাণ্ডবদিগকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত দুর্ম্মতি দুর্য্যোধনের মন্ত্রণা, তাহার দুষ্ট অভিসন্ধি জানিতে পারিয়া ব্যাসের আগমন, ব্যাস কর্ত্তৃক দুর্য্যোধনের বনগমন-প্রতিষেধ, সুরভির উপাখ্যান, মৈত্রেয়ের আগমন, ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি মৈত্রেয়ের উপদেশ, মৈত্রেয় কর্ত্তৃক রাজা দুর্য্যোধনের প্রতি শাপপ্রদান, ভীম কর্ত্তৃক যুদ্ধে কির্ম্মীর রাক্ষস-বধ, শকুনি ছল প্রকাশ করিয়া দ্যূতে পাণ্ডবদিগকে পরাজয় করিয়াছে শুনিয়া পাঞ্চাল ও বৃষ্ণিবংশীয়দিগের আগমন, কৃষ্ণ অতিশয় রোষাবেশ প্রকাশ করিলে অর্জ্জুনের সান্ত্বনাবাক্য, কৃষ্ণের নিকট দ্রৌপদীর বিলাপ, দুঃখার্ত্তা দ্রৌপদীকে বাসুদেবের আশ্বাসদান, সৌভপতি শাল্বের বধ, সপুৎত্রা সুভদ্রাকে কৃষ্ণ কর্ত্তৃক দ্বারকায় আনয়ন, ধৃষ্টদ্যুম্নকর্ত্তৃক দ্রৌপদীর সন্তানগণকে পাঞ্চালনগর-প্রাপণ, রমণীয় দ্বৈতবনে পাণ্ডবদিগের প্রবেশ, দ্রৌপদী ও ভীমসেনের সহিত দ্বৈতবনে যুধিষ্ঠিরের কথোপকথন, পাণ্ডবদিগের সমীপে ব্যাসের আগমন, যুধিষ্ঠিরের ব্যাসদেব হইতে প্রতিস্মৃতিনামক বিদ্যালাভ, ব্যাস প্রতিগত হইলে পাণ্ডবদিগের কাম্যকবনে গমন, অমিততেজা অর্জ্জুনের অস্ত্রলাভপ্রত্যাশায় প্রবাসে গমন ও কিরাতরূপী দেবদেব মহাদেবের সহিত যুদ্ধ, ইন্দ্রাদি লোকপালের দর্শন ও অস্ত্রলাভ, অস্ত্রশিক্ষার্থে অর্জ্জুনের ইন্দ্রলোকে গমন, পাণ্ডববৃত্তান্ত শ্রবণে ধৃতরাষ্ট্রের বলবতী চিন্তা, মহানুভব মহর্ষি বৃহদশ্বের সন্দর্শন, দুঃখার্ত্ত যুধিষ্ঠিরের বিলাপ, ধর্ম্মসঙ্গত ও করুণরসাশ্রিত নলোপাখ্যান, যুধিষ্ঠিরের বৃহদশ্ব হইতে অক্ষহৃদয় নামক বিদ্যালাভ, পাণ্ডবদিগের নিকট স্বর্গ হইতে লোমশ ঋষির আগমন, লোমশ কর্ত্তৃক বনবাসগত মহাত্মা পাণ্ডবদিগের নিকট স্বর্গবাসী অর্জ্জুনের বৃত্তান্ত-কথন, অর্জ্জুনের অনুসন্ধানার্থ পাণ্ডবদিগের তীর্থাভিগমন, তীর্থের ফলপ্রাপ্তি ও পাবনত্ব-কীর্ত্তন, দেবর্ষি নারদের পুলস্ত্যতীর্থযাত্রা, পাণ্ডবদিগের তীর্থযাত্রা, গয়াসুরের যজ্ঞবর্ণন, অগস্ত্যের উপাখ্যান ও বাতাপি ভক্ষণ, অপত্যোৎপাদনের নিমিত্ত মহর্ষির লোপামুদ্রা-পরিগ্রহ, কৌমার ব্রহ্মচারী ঋষ্যশৃঙ্গের চরিত কীর্ত্তন, প্রভূত-পরাক্রম পরশুরামের চরিত্রবর্ণন, কার্ত্তবীর্য্য ও হৈহয়দিগের বধ, প্রভাসতীর্থে পাণ্ডবদিগের সহিত বৃষ্ণিবংশীয়দিগের সমাগম, সুকন্যার উপাখ্যান, শর্য্যাতি রাজার যজ্ঞে চ্যবনমুনি কর্ত্তৃক অশ্বিনীকুমারের সোমপান, অশ্বিনীকুমার কর্ত্তৃক চ্যবনের যৌবন-প্রতিপাদন, মান্ধাতার উপাখ্যান, জন্তু-নামক রাজপুৎত্রের উপাখ্যান, শত পুৎত্রের অভিলাষে সোমক রাজার জন্তু-নামক পুৎত্রের শিরশ্ছোদন, যজ্ঞানুষ্ঠান ও অভীষ্ট-ফললাভ, শ্যেনকপোতীয় উপাখ্যান, শিবি রাজার প্রতি ইন্দ্র ও অগ্নির ধর্ম্ম-জিজ্ঞাসা, অষ্টাবক্রোপাখ্যান, জনক-যজ্ঞে মহর্ষি অষ্টাবক্রের সহিত বরুণাত্মজ নৈয়ায়িক বন্দীর বিবাদ, মহাত্মা অষ্টাবক্র কর্ত্তৃক বিবাদে বন্দীর পরাজয় ও সাগরের অভ্যন্তরগত পিতার উদ্ধার, মহাত্মা যবক্রীত ও রৈভ্যের উপাখ্যান, গন্ধমাদনযাত্রা ও নারায়ণাশ্রমে বাস, পুষ্পানয়নার্থ দ্রৌপদী কর্ত্তৃক ভীমসেনের নিয়োগ, পথিমধ্যে গমন করিতে করিতে ভীমসেনের সহিত কদলীবনে হনূমানের সন্দর্শন, কুসুমাবচয়ন করিবার নিমিত্ত সরোবরে অবগাহন, তথায় অতি ভীষণ রাক্ষসগণ ও মণিমান্ প্রভৃতি মহাবীর্য্য যক্ষদিগের সহিত যুদ্ধ, জটাসুর-নামক রাক্ষস-বধ, তথায় রাজর্ষি বৃষপর্ব্বার আগমন, আর্ষ্টিষেণের আশ্রমে পাণ্ডবদিগের গমন ও অবস্থান, দ্রৌপদী কর্ত্তৃক ভীমসেনের উৎসাহদান, ভীমের কৈলাস-পর্ব্বতে আরোহণ ও মণিমান্ প্রমুখ যক্ষদিগের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ, পাণ্ডবদিগের সহিত বৈশ্রবণের সমাগম, দিব্যাস্ত্র প্রাপ্ত হইয়া ভ্রাতৃগণের সহিত অর্জ্জুনের সমাগম, হিরণ্যপুরবাসী নিবাতকবচগণ ও পুলোমপুৎত্র কালকেয়দিগের সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধবর্ণন, তৎকর্ত্তৃক কালকেয়দিগের রাজার প্রাণসংহার, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সন্নিধানে অর্জ্জুনের অস্ত্র-সন্দর্শনের উদ্যম, দেবর্ষি নারদের তদ্বিষয়ে প্রতিষেধ, গন্ধমাদন হইতে পাণ্ডবদিগের অবরোহণ, গহনবনে ভুজগেন্দ্র কর্ত্তৃক মহাবল ভীম-গ্রহণ, প্রশ্নোত্তর প্রদানপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের ভীমমোক্ষণ, মহাত্মা পাণ্ডবদিগের কাম্যকবনে পুনরাগমন, তথায় পাণ্ডবদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবার প্রত্যাশায় পুনর্ব্বার বাসুদেবের আগমন, মার্কণ্ডেয়সমস্যা, পৃথু রাজার উপাখ্যান, সরস্বতী ও মহর্ষি তার্ক্ষ্যের সংবাদ, মৎস্যোপাখ্যান, ইন্দ্রদ্যুম্নোপাখ্যান, ধুন্ধুমারোপাখ্যান, পতিব্রতোপাখ্যান, অঙ্গিরা ঋষির উপাখ্যান, দ্রৌপদী ও সত্যভামাসংবাদ, পাণ্ডবদিগের দ্বৈতবনে পুনরাগমন, ঘোষযাত্রা, গন্ধর্ব্ব কর্ত্তৃক দুর্য্যোধন বন্ধন ও অর্জ্জুন কর্ত্তৃক বিমোচন, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মৃগস্বপ্ন-সন্দর্শন, রমণীয় কাম্যকবনে পুনর্গমন, অতি বিস্তীর্ণ ব্রীহিদ্রৌণি কোপাখ্যান, মহর্ষি দুর্ব্বাসার উপাখ্যান, আশ্রমের অভ্যন্তর হইতে জয়দ্রথ কর্ত্তৃক দ্রৌপদী-হরণ, মহাবল ভীমের বায়ুবেগে গমন ও জয়দ্রথের পঞ্চশিখীকরণ, বহুবিস্তার রামায়ণ উপাখ্যান, রামচন্দ্র কর্ত্তৃক রাবণের বধ, সাবিত্রীর উপাখ্যান, কুণ্ডলদ্বয় দান দ্বারা ইন্দ্রের হস্ত হইতে কর্ণের অব্যাহতি, পরিতুষ্ট ইন্দ্র কর্ত্তৃক একপুরুষঘাতিনী শক্তিপ্রদান, আরণেয়-উপাখ্যান ও ধর্ম্মের সপুৎত্রানুশাসন, বরলাভ করিয়া পাণ্ডবদিগের পশ্চিমদিকে গমন, তৃতীয় আরণ্যক-পর্ব্বে এই সকল কীর্ত্তিত আছে। ইহাতে দুই শত একোনসপ্ততি অধ্যায় ও একাদশ সহস্র ছয় শত ও চতুঃষষ্টি শ্লোক আছে।
বিরাটপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অতঃপর বহু বিস্তৃত বিরাটপর্ব্ব শুনুন। পাণ্ডবগণ বিরাটনগরে প্রবেশ করিয়া শ্মশানে অতি প্রকাণ্ড শমীবৃক্ষ নিরীক্ষণপূর্ব্বক তাঁহাদের সমুদয় অস্ত্র তাহাতে সংস্থাপন করিলেন ও অতি প্রচ্ছন্নভাবে নগরে প্রবেশ করিয়া বিরাট-রাজপ্রাসাদে বাস করিতে লাগিলেন। দুরাত্মা কীচক কামোন্মত্ত হইয়া দ্রৌপদীর নিমিত্ত আপনার অভিমত অভিলাষ প্রকাশ করিলে ভীমসেন তাহার প্রাণসংহার করেন। রাজা দুর্য্যোধন পাণ্ডবদিগের অন্বেষণার্থ চতুর্দ্দিকে অতি সুচতুর চরসমূহ প্রেরণ করিলেন, কিন্তু তাহারা মহাত্মা পাণ্ডবদিগের অনুসন্ধান করিতে পারিল না। প্রথমতঃ ত্রিগর্ত্তেরা বিরাট-রাজার গোপন অপহরণ করে, তদুপলক্ষ্যে তাহাদিগের সহিত বিরাটের যুদ্ধ হয়। শত্রুপক্ষ বিরাট রাজাকে পরাজিত ও বন্ধন করিয়া লইয়া যাইতেছিল। ইত্যবসরে ভীমসেন স্ববিক্রমপ্রভাবে তাঁহাকে মুক্ত করেন, পাণ্ডবেরা বিরাটের অপহৃত গোধন প্রত্যাহরণ করেন। অনন্তর কৌরবগণ তাঁহার গোধন হরণ করিলে অর্জ্জুন বাহুবলে নিখিল কৌরবগণকে যুদ্ধে পরাভূত করিয়া বিরাটের গোধন উদ্ধার করেন। বিরাট সুভদ্রাগর্ভসম্ভূত অভিমন্যুকে উদ্দেশ করিয়া দুহিতা উত্তরাকে সম্প্রদান করিলে অর্জ্জুন তাঁহাকে প্রতিগ্রহ করেন। বেদবেত্তা মহর্ষি বেদব্যাস বিরাট-নামক চতুর্থ পর্ব্বে এই সকল কীর্ত্তন করিয়াছেন এবং ইহাতে সপ্তষষ্টি অধ্যায়, দুই সহস্র ও পঞ্চাশৎ শ্লোক আছে।
উদ্যোগপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
তৎপরে উদ্যোগ-নামক পর্ব্ব শ্রবণ করুন। পাণ্ডবেরা জিগীষা-পরবশ হইয়া উপপ্লব্য-নামক স্থানে অবস্থান করিলে দুর্য্যোধন ও অর্জ্জুন কৃষ্ণের সন্নিকটে উপস্থিত হইলেন। “তুমি এই যুদ্ধে আমাদিগের সাহায্য কর”, তৎসন্নিধানে উভয়ে এইরূপ প্রার্থনা করিলে মহামতি কৃষ্ণ কহিলেন, “আমি এক পক্ষে এক অক্ষৌহিণী সেনা প্রদান করিব ও অন্য পক্ষে আমি একাকী থাকিব; কিন্তু কোনরূপে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব না ও অকপটে তাহাদিগের মন্ত্রী হইব। এক্ষণে তোমরা অন্যতরের কে কি ইচ্ছা কর, বল।” অনভিজ্ঞ দুর্য্যোধন সৈন্য প্রার্থনা করিলেন ও অর্জ্জুন তাঁহাকে মন্ত্রিত্ব স্বীকার করিতে অনুরোধ করিলেন। পাণ্ডবদিগের সহায়তা করিবার নিমিত্ত সমাগত মদ্ররাজকে পথিমধ্যে দুর্য্যোধন বহুবিধ উপহার প্রদান করিয়া ‘তুমি আমার সাহায্য কর’, এইরূপ প্রার্থনা করিলেন। শল্য তাহাতে সম্মত হইয়া পাণ্ডবদিগের নিকট গমন করিলেন। তথায় যুধিষ্ঠিরের নিকট দেবরাজ ইন্দ্রের বৃত্রাসুরবিজয় বৃত্তান্ত বর্ণন করেন। পাণ্ডবেরা কৌরবসমীপে পুরোহিত প্রেরণ করিলেন। প্রবল-প্রতাপ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পুরোহিতের কথা শ্রবণ করিয়া শান্তি-স্থাপন প্রত্যাশায় সঞ্জয়কে দূতস্বরূপে পাণ্ডবদিগের নিকট পাঠাইলেন। কৃষ্ণ ও পাণ্ডবদিগের বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অতিবলবতী চিন্তায় ধৃতরাষ্ট্রের নিদ্রাচ্ছেদ হইল। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বিবিধ হিতবাক্য শ্রবণ করান। মহর্ষি সনৎসুজাত রাজাকে শোকসন্তপ্ত দেখিয়া অতি উৎকৃষ্ট বেদশাস্ত্র শুনাইলেন। প্রভাত-সময়ে সভামণ্ডপে উপস্থিত হইয়া সঞ্জয় বাসুদেব ও অর্জ্জুনের অভিন্নত্ব কীর্ত্তন করেন। মহামতি কৃষ্ণ কৃপাপরায়ণ হইয়া সন্ধি বাসনায় হস্তিনাপুরে গমন করিয়াছিলেন। কিন্তু রাজা দুর্য্যোধন, উভয়পক্ষের হিতাকাঙ্ক্ষী তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করিলেন। অনন্তর দম্ভোদ্ভবের উপাখ্যান, মহাত্মা মাতলির বরান্বেষণ, মহর্ষি গালবের চরিত, বিদুলার স্বপুৎত্রানুশাসন বর্ণিত আছে। কৃষ্ণ কর্ণ ও দুর্য্যোধনের নিতান্ত মন্দ অভিসন্ধি জানিতে পারিয়া সমস্ত রাজাদিগকে স্বীয় যোগেশ্বরত্ব দর্শন করাইলেন। কর্ণকে রথে আরোহণ করাইয়া তাঁহার সহিত কৃষ্ণ পরামর্শ করিয়াছিলেন, কিন্তু কর্ণ অহঙ্কার-পরতন্ত্র হইয়া তাঁহার মন্ত্রণা গ্রহণ করিল না। তিনি হস্তিনাপুর হইতে উপপ্লব্যে আগমন করিয়া পাণ্ডবদিগের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত-বর্ণন করিলেন। তাঁহারা কৃষ্ণের কথা শুনিয়া হিতাহিত বিবেচনাপূর্ব্বক যুদ্ধ-সজ্জা করিতে লাগিলেন। অনন্তর হস্তিনাপুর হইতে সংগ্রামবাসনায় হস্তী, অশ্ব, রথ, পদাতি এই সমুদয় ক্রমশঃ নির্গত হইতে লাগিল। রাজা দুর্য্যোধন যুদ্ধের পূর্ব্বদিবস পাণ্ডবদিগের নিকট উলূক-নামক দূত প্রেরণ করেন। রথী ও অতিরথ-সংখ্যা, অন্বোপাখ্যান, বহুবৃত্তান্ত-সংযুক্ত সন্ধিবিগ্রহ বিশিষ্ট উদ্যোগপর্ব্বে এই সকল কথিত হইল। ইহাতে শত ও ষড়শীতি অধ্যায় আছে। মহর্ষি এই পর্ব্বে ষট্সহস্র ষট্শত ও অষ্টনবতি শ্লোক রচনা করিয়াছেন।
ভীষ্মপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অতঃপর পরমাশ্চর্য্য ভীষ্মপর্ব্ব। ইহাতে সঞ্জয় জম্বুদ্বীপ নির্ম্মাণ বর্ণনা করেন। যুধিষ্ঠিরের সেনাগণ অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়। দশ দিবস অতি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হইয়াছিল। মহামতি বাসুদেব মুক্তিপ্রতিপাদক বহুবিধ যুক্তি প্রদর্শন করিয়া, অর্জ্জুনের মোহজনিত বিষাদ নিরাকরণ করেন। যুধিষ্ঠিরের হিতাভিলাষী মনস্বী কৃষ্ণ সত্বর রথ হইতে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক প্রতোদ [কশা বা চাবুক] হস্তে লইয়া নিঃশঙ্কচিত্তে ভীষ্মকে সংহার করিতে ধাবমান হইয়াছিলেন এবং সকল ধনুর্দ্ধারিশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুনকে বাক্যরূপ অসি দ্বারা আঘাত করেন। অর্জ্জুন শিখণ্ডীকে সম্মুখে রাখিয়া শাণিত শরে ভীষ্মকে রথ হইতে ভূতলে পতিত করিয়াছিলেন। ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ান হইলেন। অতি বিস্তৃত ভারতের ষষ্ঠ পর্ব্ব সমাখ্যাত হইল। ইহাতে শত ও সপ্তদশ অধ্যায় নির্দ্দিষ্ট আছে। বেদবেত্তা ব্যাসদেব ভীষ্মপর্ব্বে পঞ্চ সহস্র, অষ্টশত ও চতুরশীতি শ্লোক রচনা করিয়াছেন।
দ্রোণপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অনন্তর বাহুবৃত্তান্তানুগত অতি বিচিত্র দ্রোণপর্ব্ব আরম্ভ হইতেছে। প্রবল-প্রতাপ দ্রোণাচার্য্য সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হইয়া দুর্য্যোধনের প্রীতিবর্দ্ধনের নিমিত্ত “ধীমান্ যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধে বন্দী করিব,” এইরূপ অঙ্গীকার করিয়াছিলেন। সংসপ্তকগণ অর্জ্জুনকে সমরাঙ্গন হইতে অর্পসৃত করিয়াছিলেন। শত্রুতুল্য পরাক্রমশালী মহারাজ ভগদত্ত সুপ্রতীক নামক হস্তীর সহিত অর্জ্জুন কর্তৃক নিহত হন। জয়দ্রথ প্রভৃতি সপ্তরথী অপ্রাপ্তযৌবন একাকী বালক অভিমন্যুর প্রাণদণ্ড করিয়াছিলেন। অর্জ্জুন অভিমন্যু-বধে ক্রোধে অধীর হইয়া সপ্ত অক্ষৌহিণী সৈন্যের সহিত জয়দ্রথকে বিনষ্ট করিলেন। মহাবাহু ভীম ও মহারথ সাত্যকি রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমে অর্জ্জুনের অন্বেষণের নিমিত্ত অতি দুর্দ্ধর্ষ কৌরব-সেনামধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। হতাবশিষ্ট সংসপ্তকগণ যুদ্ধে নিঃশেষ হয়। অলম্বুষ, শ্রুতায়ুঃ,মহাবীর জরাসন্ধ, সৌমদত্তি, বিরাট, মহারথ দ্রপদ ও ঘটোৎকচাদি অন্যান্য বীরগণের নিধনের বিষয় দ্রোণপর্ব্বে কথিত আছে। সমরে দ্রোণাচার্য্য হত হইলে, অশ্বত্থামা ক্রোধান্ধ হইয়া যে ভীষণ নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করিয়াছিলেন, তাহাও এই পর্ব্বে বর্ণিত আছে। এই পর্ব্বে অত্যুৎকৃষ্ট রুদ্রমাহাত্ম্য, বেদব্যাসের আগমন এবং কৃষ্ণার্জ্জুনের মাহাত্ম্য অভিহিত হইয়াছে। এই মহাভারতের সপ্তম পর্ব্বের বিষয় কথিত হইল। এই দ্রোণপর্ব্বে যে যে বীরপুরুষদিগের কথা নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, তাঁহারা প্রায় সকলই নিধন-প্রাপ্ত হয়েন। তত্ত্বদর্শী মহামুনি পরাশরাত্মজ এই পর্ব্বে এক শত সপ্ততি অধ্যায় ও অষ্ট সহস্র নব শত নব শ্লোকের সংখ্যা করিয়াছেন।
কর্ণপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অতঃপর কর্ণপর্ব্বের কথা লিখিত হইতেছে। এই পর্ব্বে ধীমান্ শল্যের সারথ্যকার্য্যে নিয়োগ, ত্রিপুরনিপাতনবৃত্তান্ত, গমনকালে কর্ণ ও শল্যের পরস্পর বিবাদ, কর্ণতিরস্কারার্থ শল্য কর্ত্তৃক হংসকাকীয়োপাখ্যান-কথন, মহাপ্রভাব দ্রোণাত্মজ কর্ত্তৃক পাণ্ড্যের নিধন, দণ্ডসেন ও দণ্ডের বধ, সর্ব্বধনুর্দ্ধরগণসমক্ষে কর্ণের সহিত দ্বৈরথযুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের প্রাণসংশয়, যুধিষ্ঠির ও অর্জ্জুনের পরস্পর ক্রোধ, কৃষ্ণ কর্ত্তৃক অনুনয়বাক্য দ্বারা অর্জ্জুনের ক্রোধশান্তিকরণ, ভীমসেন কর্ত্তৃক যুদ্ধে দুঃশাসনের বক্ষঃস্থল-বিদারণপূর্ব্বক রক্তপান এবং অর্জ্জুনের সহিত দ্বৈরথ-যুদ্ধে কর্ণের নিপাত; এই সমস্ত বর্ণিত আছে। ভারতের অষ্টম পর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। এই কর্ণপর্ব্বে একোনসপ্ততি অধ্যায় ও চারি সহস্র নয় শত চতুঃষষ্টি শ্লোক কীর্ত্তিত আছে।
শল্যপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অতঃপর বিচিত্র শল্যপর্ব্বের বিষয় কথিত হইতেছে। কুরুসৈন্য বীরশূন্য হইলে, মদ্রাধিরাজ শল্য সৈনাপত্যকার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। শল্যপর্ব্বে যাবতীয় রথযুদ্ধ ও প্রধান প্রধান কৌরবদিগের বধ বর্ণিত আছে। এই পর্ব্বে মহাত্মা যুধিষ্ঠির কর্ত্তৃক শল্যের বধ ও সহদেব কর্ত্তৃক শকুনির বিনাশ কথিত আছে। দুর্য্যোধন অল্পমাত্রাবিশিষ্ট সৈন্য দেখিয়া দ্বৈপায়নহ্রদে প্রবেশপূর্ব্বক জলস্তম্ভ [নিশ্চল জলমধ্যে লুক্কায়িত ব্যক্তির বাহির হইতে অনুসন্ধান না পাইবার কৌশল] করিয়া তথায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। ব্যাধেরা হ্রদমধ্যে দুর্য্যোধনের আত্মগোপন-বৃত্তান্ত ভীমকে বলিয়া দিল। মহামানী দুর্য্যোধন ধীমান্ যুধিষ্ঠিরের তিরস্কারবাক্য সহ্য করিতে না পারিয়া হ্রদ হইতে উত্থিত হইলেন ও ভীমের সহিত গদাযুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। সংগ্রামসময়ে বলরাম আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এই পর্ব্বে সরস্বতী ও অন্যান্য তীর্থ-সমুদয়ের পবিত্রতা কীর্ত্তন ও তুমুল গদাযুদ্ধবর্ণন আছে। যুদ্ধে বৃকোদর ভয়ানক গদাঘাতে দুর্য্যোধনের ঊরুদ্বয় ভগ্ন করিলেন। ভারতের নবম পর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। এই পর্ব্বে নানাবৃত্তান্তযুক্ত একোনষষ্টি অধ্যায় কথিত আছে। এক্ষণে শ্লোকসংখ্যা কথিত হইতেছে। কুরুবংশযশঃকীর্ত্তক মহামুনি বেদব্যাস এই পর্ব্বে তিন সহস্র দুই শত বিংশতি শ্লোকের সংখ্যা করিয়া গিয়াছেন।
সৌপ্তিকপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অনন্তর দারুণ সৌপ্তিকপর্ব্বের কথা লিখিত হইতেছে। পাণ্ডবেরা সংগ্রামক্ষেত্র হইতে শিবিরে গমন করিলে, সায়ংকালে কৃতবর্ম্মা, কৃপাচার্য্য ও অশ্বত্থামা রুধিরাক্তকলেবর ভগ্নোরুযুগল অভিমানী রাজা দুর্য্যোধনের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মহারাজ রণক্ষেত্রে পতিত আছেন। মহাক্রোধ দ্রোণাত্মজ প্রতিজ্ঞা করিলেন, “ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাঞ্চালদিগকে ও অমাত্যসহিত পাণ্ডবগণকে বিনষ্ট না করিয়া বর্ম্মত্যাগ করিব না।” রাজাকে এইরূপ কহিয়া তিন জনেই সেস্থান হইতে অপক্রান্ত হইয়া প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের তলে উপবিষ্ট হইলেন। ঐস্থানে অশ্বত্থামা রাত্রিকালে পেচককে বহুসংখ্যক কাক নষ্ট করিতে দেখিয়া পিতৃনিধন-বৃত্তান্ত স্মরণপূর্ব্বক ক্রোধান্ধ হইয়া নিদ্রাতুর পাঞ্চালদিগের বধে সপ্রতিজ্ঞ হইলেন। এইরূপ স্থির করিয়া শিবিরদ্বারে গমনপূর্ব্বক দেখিলেন যে, একটা বিকটমূর্ত্তি ভয়ঙ্কর রাক্ষস আকাশ পর্য্যন্ত ব্যাপিয়া রহিয়াছে। অশ্বত্থামা অস্ত্র ত্যাগ করিতে লাগিলেন, কিন্তু রাক্ষসের কিছুতেই কিছু হইল না। তখন তিনি দেবাদিদেব মহাদেবকে প্রসন্ন করিয়া, কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্যের সহায়তায়, সুষুপ্ত ধৃষ্টদ্যুম্ল প্রভৃতি পাঞ্চালগণকে ও সপরিবার দ্রৌপদীর পুৎত্রগণকে বিনাশ করিলেন। কেবল কৃঞ্চবলে যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতা ও ধনুর্দ্ধর সাত্যকি রক্ষা পাইলেন, আর সকলেই বিনষ্ট হইল। ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি যুধিষ্ঠিরাদিকে সমাচার দিল যে “অশ্বত্থামা প্রসুপ্ত পাঞ্চালদিগকে বধ করিয়াছে।” দ্রৌপদী পুৎত্র, পিতা, ও ভ্রাতাগণের নিধনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া নিতান্ত অধীরার ন্যায় অনশন সঙ্কল্প করিয়া স্বামিগণের নিকট উপবিষ্টা হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীম দ্রৌপদীর মনস্তুষ্টি-করণার্থ ক্রোধান্বিত হইয়া গদা গ্রহণপুরঃসর অশ্বত্থামার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। অশ্বত্থামা ভীমভয়াক্রান্ত হইয়া সক্রোধে “অদ্য আমি মেদিনী পাণ্ডববিহীনা করিব” এই বলিয়া অস্ত্র ত্যাগ করিলেন। কৃষ্ণ “এমন করিও না” এই বলিয়া অশ্বত্থামাকে নিবারণ করিলেন। অর্জ্জুন পাপাত্মা অশ্বত্থামাকে অনিষ্টাচরণে অভিনিবিষ্ট দেখিয়া স্বকীয় অস্ত্র দ্বারা অশ্বত্থামার অস্ত্রচ্ছেদন করিলেন এবং অশ্বত্থামা ও ব্যাসাদি পরস্পরের প্রতি শাপ প্রদান করিলেন। পাণ্ডবগণ মহারথ দ্রোণাত্মজের নিকট হইতে মণি গ্রহণ করিয়া সানন্দে দ্রৌপদীকে প্রদান করিলেন। ভারতের দশম সৌপ্তিকপর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। ব্রহ্মবাদী মহাত্মা উত্তমতেজা বেদব্যাস এই পর্ব্বে অষ্টাদশ অধ্যায় ও অষ্ট শত সপ্ততি শ্লোকের সংখ্যা করিয়াছেন। ঐষীকপর্ব্ব এই পর্ব্বের অন্তর্গত।
স্ত্রীপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
এক্ষণে করুণরসোদ্ধেধক স্ত্রীপর্ব্বের বিষয় কথিত হইতেছে। এই পর্ব্বে পুৎত্রশোকার্ত্ত প্রজ্ঞাচক্ষু রাজা ধৃতরাষ্ট্র ভীমসেনকে সংহার করিতে সঙ্কল্প করিয়া লৌহময়ী ভীমপ্রতিমূর্ত্তি ভগ্ন করেন। বিদুর মোক্ষোপদেশক হেতুবাদ দ্বারা পুৎত্রশোকাভিসন্তপ্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সাংসারিকমোহনিবারণ ও তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করেন। শোকার্ত্ত ধৃতরাষ্ট্র অন্তঃপুরমহিলাগণের সহিত রণস্থলদর্শনার্থ গমন করেন। অতঃপর বীরবনিতাগণের করুণস্বরে রোদন এবং গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের ক্রোধ ও মোহ। তৎপর ক্ষৎত্রিয়পত্নীগণ সমরে অপরাঙ্মুখ নিহত পিতা, ভ্রাতা ও পুৎত্রগণকে দেখিলেন। কৃষ্ণ পুৎত্র-পৌৎত্রশোকাকুলা গান্ধারীর ক্রোধোপশমন করেন। সর্ব্ব-ধর্ম্মজ্ঞশ্রেষ্ঠ, মহাপ্রাজ্ঞ, রাজা যুধিষ্ঠির শাস্ত্রানুসারে নৃপতিগণের শরীর দাহ করাইলেন। ভূপতিগণের উদকক্রিয়া [তর্পণাদি] আরব্ধ হইলে কুন্তী কর্ণকে আপনার গূঢ়োৎপন্ন পুৎত্র বলিয়া স্বীকার ও প্রকাশ করেন। মহর্ষি বেদব্যাস এই একাদশ পর্ব্ব রচনা করিয়াছেন। এই পর্ব্ব শ্রবণ কিংবা পাঠ করিলে সহৃদয় জনের হৃদয় শোকাকুল ও নয়ন অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হয়। এই পর্ব্বে বেদব্যাস সপ্তবিংশতি অধ্যায় ও সপ্তশত পঞ্চসপ্ততি শ্লোকের সংখ্যা করিয়া গিয়াছেন।
শান্তিপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অতঃপর ধীশক্তিবর্দ্ধক শান্তিপর্ব্বে কথা লিখিত হইতেছে। এই পর্ব্বে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির পিতৃগণ, ভ্রাতৃগণ, পুৎত্র, সন্বন্ধী ও মাতুলগণকে বধ করাইয়া সাতিশয়, নির্ব্বণ্ণ হইলেন। শরশয্যাশায়ী ভীষ্মদেব রাজা যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম্মোপদেশ প্রদান করেন। ঐ সমস্ত ধর্ম্মের যথার্থ-জ্ঞান দ্বারা লোকে সর্ব্বজ্ঞতা লাভ করে। ইহাতে বিচিত্র মোক্ষধর্ম্মের কথাও সবিস্তারে কথিত আছে। মহাভারতের দ্বাদশ পর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। হে তপোধনগণ! এই শান্তিপর্ব্বে মহামুনি বেদব্যাস ত্রিশত ঊনচত্বারিংশৎ অধ্যায় ও চতুর্দ্দশ সহস্র সপ্ত শত সপ্ত শ্লোক রচনা করিয়াছেন।
অনুশাসনপর্ব্ব –শ্লোকসংখ্যা
ইহার পর অত্যুৎকৃষ্ট অনুশাসনপর্ব্ব। এই পর্ব্বে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভাগীরথীপুৎত্র ভীষ্মদেবের নিকট ধর্ম্মনিশ্চয় শ্রবণ করিয়া বিগতশোক ও স্থিরচিত্ত হইলেন। এই পর্ব্বে ধর্ম্মার্থ-সম্বন্ধ ব্যবহার সমুদয়-কথন, বিবিধ দানের বিবিধ প্রকার ফলনির্দ্দেশ, সৎপাত্র ও অসৎপাত্রের বিশেষ বিবেচনা, দানবিধানকথন, আচার-বিনির্ণয়, সত্যের স্বরূপ-কথন, গোগণের ও ব্রাহ্মণগণের মহত্বকীর্ত্তন, দেশ কালানুযায়ী-ধর্ম্মরহস্য-কথন ও ভীষ্মের অমরলোকসম্প্রাপ্তি কীর্ত্তিত আছে। ধর্ম্মনির্ণায়ক নানা-বৃত্তান্ত-সঙ্কলিত অনুশাসনাভিধান মহাভারতের ত্রয়োদশ পর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট হইল। এই অনুশাসনপর্ব্বে মুনিসত্তম পরাশরাত্মজ একশত ষট্চত্বারিংশৎ অধ্যায় ও অষ্ট সহস্র শ্লোক নির্ণয় করিয়াছেন।
অশ্বমেধপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অতঃপর আশ্বমেধিক-নামক চতুর্দ্দশ পর্ব্বের বিষয় কথিত হইতেছে। এই পর্ব্বে সংবর্ত্তমুনি ও মরুত্ত রাজার আখ্যান, যুধিষ্ঠিরের হিমালয়স্থিত সুবর্ণস্তূপ-সম্প্রাপ্তি ও পরীক্ষিতের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। পরীক্ষিৎ অশ্বত্থামার অস্ত্রানলে দগ্ধ হইয়াছিলেন; কৃষ্ণ তাঁহাকে জীবিত প্রদান করেন। অত্যুৎকৃষ্ট যজ্ঞ-তুরঙ্গরক্ষার্থ তৎপশ্চাদগামী অর্জ্জুনের নানাদেশে ক্রোধনরাজ-পুৎত্রগণের সহিত সংগ্রাম, চিত্রাঙ্গদার গর্ভে সমুদ্ভুত স্বসুত বভ্রুবাহনের সহিত যুদ্ধে ধনঞ্জয়ের জীবন-সংশয়। মহান্ অশ্বমেধযজ্ঞের সমাপ্তির পর নকুলের বৃত্তান্ত। এই পরমাদ্ভুত আশ্বমেধিক পর্ব্বের বিষয় কথিত হইল। এই পর্ব্বে অশেষ-তত্ত্ববিৎ ভগবান্ পরাশরসূনু ত্র্যধিক শত অধ্যায় ও তিন সহস্র তিন শত বিংশতি শ্লোকের সংখ্যা করিয়াছেন।
আশ্রমবাসিকপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অনন্তর আশ্রমবাসাখ্য পঞ্চদশ পর্ব্ব। এই পর্ব্বে রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যত্যাগ করিয়া গান্ধারী ও বিদুরের সহিত অরণ্যানী [মহাবন] প্রবেশ করিলেন। গুরুশুশ্রূষায় একান্ত অনুরক্তা, সাধ্বী কুন্তীও ধৃতরাষ্ট্রকে বনে গমন করিতে দেখিয়া পুৎত্ররাজ্য পরিত্যাগকরতঃ তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র সমরে নিহত লোকান্তরগত পুৎত্র-পৌৎত্র এবং অন্যান্য ক্ষৎত্রিয় বীরপুরুষগণকে পুনরাগত দেখিলেন। তিনি মহামুনি বেদব্যাসের প্রসাদে এই আশ্চর্য্য ব্যাপার দর্শন করিয়া অবশেষে শোক পরিত্যাগপূর্ব্বক পরমসিদ্ধি লাভ করিলেন। বিদুর ও জিতেন্দ্রিয় গবলগণ-নন্দন সঞ্জয় অমাত্যের সহিত ধর্ম্মপথ অবলম্বন করিয়া চরমে সদ্গতি প্রাপ্ত হইলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তপোধন নারদকে সন্দর্শন করিলেন এবং তৎপ্রমুখাৎ যদুকুলধ্বংসের কথা অবগত হইলেন। এই অত্যদ্ভুত আশ্রমবাসাখ্য পর্ব্বের বিষয় কথিত হইল। মহামুনি বেদব্যাস এই পর্ব্বে দ্বিচত্বারিংশৎ অধ্যায় ও এক সহস্র পঞ্চশত ষট্শ্লোকের সংখ্যা করিয়াছেন।
মৌষলপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
হে তপোধনগণ! অতঃপর দারুণ মৌষল-পর্ব্ব জানিবেন। এই পর্ব্বে লবণ-সমুদ্র-সমীপে ব্রহ্মশাপগ্রস্ত পুরুষসিংহ যাদবগণ আপানে [মদ্যপান – দলবদ্ধ হইয়া যেখানে মদ্যপান করা হয়] –মদ্যপান দ্বারা মত্ত হইয়া দারুণ দৈবদুর্ব্বিপাকবশতঃ এরকা [শরতূণ –শরকাঠি] রূপ বজ্র দ্বারা পরস্পর আঘাত করেন। কৃষ্ণ ও বলভদ্র উভয়ে আপনাদিগের কুলক্ষয় করিয়া পরিশেষে আপনারাও সর্ব্বসংহর্ত্তা সমুপস্থিত কালের করাল কবলে নিপতিত হয়েন। নরোত্তম অর্জ্জুন দ্বারবতী নগরীতে আগমনপূর্ব্বক ঐ নগরীকে যাদবশূন্য নিরীক্ষণ করিয়া বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন। তিনি নরশ্রেষ্ঠ মাতুল বসুদেবের সংস্কার করিলেন এবং তৎপরে কৃষ্ণ ও বলরামের সংস্কার করিয়া পরিশেষে অন্যান্য প্রধান প্রধান বৃষ্ণিগণেরও সংস্কার করিলেন। অনন্তর তিনি দ্বারকা হইতে বৃদ্ধ ও বালকগণকে লইয়া গমন করিতে করিতে ঘোরতর আপৎকালে গাণ্ডীবের প্রভাবক্ষয় ও দিব্যাস্ত্র সমুদয়ের অপ্রসন্নতা দেখিলেন। তৎপরে তিনি যাদবমহিলাগণের নাশ ও প্রভুত্বের অনিত্যতা দর্শনে সাতিশয় নির্ব্বেদ-প্রাপ্ত হইয়া ব্যাসোপদেশে যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিয়া সন্ন্যাসধর্ম্মগ্রহণের বাসনা করিলেন। ষোড়শ-সংখ্যক মৌষলপর্ব্ব কীর্ত্তিত হইল। তত্ত্ববিৎ পরাশরাত্মজ এই পর্ব্বে আট অধ্যায় ও তিনশত বিংশতি শ্লোক গণনা করিয়াছেন।
মহাপ্রাস্থানিকপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
তদনন্তর মহাপ্রাস্থানিক-নামক সপ্তদশ পর্ব্বের বিষয় লিখিত হইতেছে। এই পর্ব্বে পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণ স্বকীয় রাজ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক দ্রৌপদী দেবীকে সমভিব্যাহারে লইয়া মহাপ্রস্থানে প্রস্থিত হইলেন। তাঁহারা লোহিত্যার্ণবের কূলে অগ্নিসন্দর্শন পাইলেন। অর্জ্জুন মহানুভব অগ্নি কর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়া তাঁহাকে পূজা করিয়া অত্যুৎকৃষ্ট গাণ্ডীবধনু প্রদান করিলেন। যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদীকে নিপতিত ও নিহত দেখিয়া তাঁহাদিগের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপও না করিয়া সমস্ত মায়ামোহ পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন। মহাপ্রাস্থানিকাখ্য সপ্তদশ পর্ব কথিত হইল। এই পর্ব্বে অশেষতত্ত্বজ্ঞ ভগবান্ পরাশরনন্দন তিন অধ্যায় ও তিন শত বিংশতি শ্লোক নির্দ্ধারিত করিয়াছেন।
স্বর্গরোহণপর্ব্ব – শ্লোকসংখ্যা
অনন্তর আশ্চর্য্য অলৌকিক স্বর্গপর্ব্ব জানিবেন। এই পর্ব্বে দয়ার্দ্রাচিত্ত মহাপ্রাজ্ঞ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির দেবলোক হইতে আগত দৈবরথে কুক্কুর ত্যাগ করিয়া আরোহণে সম্মত হইলেন না। ধর্ম্ম স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের ধর্ম্মে অবিচলিত অনুরাগ বুঝিতে পারিয়া কুক্কুররূপ পরিত্যাগপূর্ব্বক দর্শন দিলেন। পরম্-ধার্ম্মিক যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের সহিত একরথে উপবিষ্ট হইয়া স্বর্গে গমন করিলেন। দেবদূত ছল করিয়া নরক দর্শন করাইলেন। পরমধার্মিকাগ্রগণ্য যুধিষ্ঠির তৎস্থানস্থিত নির্দেশানুবর্ত্তী ভ্রাতৃগণের করুণ-রসোদ্দীপক ক্রন্দনধ্বনি শ্রবণ করিলেন। ধর্ম্ম ও দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার মনোদুঃখ নিবারণ করেন। তৎপরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সুরদীর্ঘিকায় [স্বর্গনদী–গঙ্গা] স্নান করিয়া মানুষ-কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বর্গে নিজ ধর্ম্মার্জ্জিত স্থান পাইয়া ইন্দ্রাদি দেবগণ কর্ত্তৃক পরম সমাদৃত হইয়া পরমানন্দে কালযাপন করিতে লাগিলেন। হে তপোধনগণ! অশেষধীশক্তিসম্পন্ন নামাতত্ত্বদর্শী মহর্ষি বেদব্যাস এই অষ্টাদশ পর্ব্ব রচনা এবং ইহাতে পাঁচ অধ্যায় ও দুই শত নব শ্লোকের সংখ্যা করিয়া গিয়াছেন।
হরিবংশ – শ্লোকসংখ্যা
এইরূপে অষ্টাদশ পর্ব্ব সবিস্তারে উক্ত হইল। ইহার পর হরিবংশ ও ভবিষ্যপর্ব্ব কথিত আছে। মহর্ষি হরিবংশে দ্বাদশ সহস্র শ্লোকসংখ্যা করিয়াছেন। মহাভারতের পর্ব্বসংগ্রহ নির্দ্দিষ্ট হইল।
পর্ব্বসংগ্রহ-প্রশংসা
যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা আসিয়াছিল। সেই ঘোর সংগ্রাম অষ্টাদশ দিবস ব্যাপিয়া হয়।
যে দ্বিজ অঙ্গ ও উপনিষদের সহিত চারি বেদ উত্তমরূপে অধ্যায়ন করিয়াছেন, কিন্তু মহাভারতাখ্যান জানেন না, তাঁহাকে বিচক্ষণ বলিতে পারা যায় না। অপরিমিত-ধীশক্তিমান্ বেদব্যাস এই ভারতকে অর্থশাস্ত্র, ধর্ম্মশাস্ত্র ও কামশাস্ত্রস্বরূপ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। যেমন পরম সুমধুর পুংস্কোকিলের কলরব শ্রবণ করিয়া কর্কশ কাকধ্বনি শ্রবণ করিতে ইচ্ছা হয় না, সেইরূপ এই আখ্যান শ্রবণ করিলে অন্যশাস্ত্র-শ্রবণে রুচি থাকে না। যেমন পঞ্চভূত হইতে ত্রিবিধ লোকের উৎপত্তি হয়, সেইরূপ এই সর্ব্বোৎকৃষ্ট ইতিহাস হইতে কবিগণের বুদ্ধি উৎপন্ন হয়। হে বিপ্রোত্তমগণ! যেমন জরায়ুজাদি চতুর্ব্বিধ শরীরী অন্তরীক্ষের [আকাশতলের সমগ্র সৃষ্টির] অন্তর্গত, সেইরূপ যাবতীয় পুরাণ এই আখ্যানের অন্তর্ভূত। যেমন বিচিত্রা মানসিক ক্রিয়া সমস্ত ইন্দ্রিয়গণের আশ্রয়, সেইরূপ এই ইতিহাস যাবতীয় দানাধ্যয়নাদি ক্রিয়া ও শমদমাদি গুণের আশ্রয়। যেমন আহার বিনা শরীরীর শরীর ধারণের উপায়ান্তর নাই, সেইরূপ এই সুললিত ইতিহাসান্তর্গত কথা ব্যতিরেকে ভূমণ্ডলে অন্য কথা নাই। যেমন সমুন্নতি-প্রেপসু ভূত্যগণ সদ্বংশজ প্রভুর আরাধনা করে, সেইরূপ কবিবরাগ্রগণ্যগণ এই বিচিত্র ইতিহাসের উপাসনা করিয়া থাকেন। যেমন অন্যান্য আশ্রমাপেক্ষা গৃহস্থাশ্রম উৎকৃষ্ট, সেইরূপ এই কাব্য অন্যান্য কবিকৃতকাব্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
হে মহর্ষিগণ! তোমাদিগের ধর্ম্মে মতি হউক। কারণ, লোকান্তরগত জনের ধর্ম্মই অদ্বিতীয় বন্ধু। অর্থ ও স্ত্রী সাতিশয়ানুরাগপূর্ব্বক সেবিত হইলেও কখন স্থির ও আত্মীয় হয় না। যে ব্যক্তি কৃষ্ণদ্বৈপায়নের ওষ্ঠবিনির্গত অপ্রমেয় পরমপবিত্র পাপনাশক মঙ্গলবিধায়ক পাঠ্যমান ভারত শ্রবণ করে, তাহার পুষ্করজলে স্নান করিবার প্রয়োজন কি? ব্রাহ্মণ দিবাভাগে নিরঙ্কুশ ইন্দ্রিয়গণ-প্রভাবে যে পাপরাশি সঞ্চয় করেন, সন্ধ্যাকালে মহাভারত পাঠ দ্বারা সেই সকল পাপপুঞ্জ হইতে মুক্ত হয়েন; আর নিশাকালে কর্ম্ম, মন ও বাক্য দ্বারা যে সকল পাপ সঞ্চয় করেন, প্রাতঃকালে মহাভারত পাঠ করিয়া সেই সমস্ত পাপ হইতে মুক্ত হয়েন। যে ব্যক্তি বেদজ্ঞ ও বহুশ্রুত ব্রাহ্মণকে কনকমণ্ডিত শত গো-দান করে, আর যে ব্যক্তি পরম পবিত্র ভারত-কথা প্রত্যহ শ্রবণ করে, এই দুইজনের তুল্য ফললাভ হয়। যেমন অর্ণবপোতাদি দ্বারা সুবিস্তীর্ণ অগাধ-জলধি অনায়াসে পার হওয়া যায়, সেইরূপ অগ্রে পর্ব্বসংগ্রহশ্রবণ দ্বারা অত্যুৎকৃষ্ট মহার্থযুক্ত উপাখ্যান সুখবোধ্য হয় জানিবেন।
পর্ব্বসংগ্রহাধ্যায় সমাপ্ত।