১ম অধ্যায়
আরণ্যকপর্ব্বাধ্যায়
নারায়ণ, নরোত্তম নর, দেবী সরস্বতী এবং বেদব্যাসকে প্ৰণাম করিয়া জয় উচ্চারণ করবে।
জনমেজয় বৈশম্পায়নকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে দ্বিজরাজ! দুরাত্মারা অমাত্যগণ-সমভিব্যাহারে আমার পূর্ব্বপিতামহ পাণ্ডবগণকে কপটদ্যূতে পরাজিত করিয়া নানাবিধ পরুষবাক্যপ্রয়োগ দ্বারা তাঁহাদের সহিত বৈরভাব উদ্ভাবিত করিলে পর তাঁহারা রোষাবেশে কি করিয়াছিলেন? সেই ইন্দ্রসদৃশ প্রতাপশালী পাণ্ডুনন্দনগণ সহসা ঐশ্বৰ্য্যভ্রষ্ট ও দুঃখাৰ্ণবে নিমগ্ন হইয়া কি প্রকারে অরণ্যমধ্যে কালব্যাপন করিলেন? তৎকালে কোন্ কোন্ ব্যক্তি তাঁহাদের অনুবর্ত্তী হইয়াছিলেন? সেই শৌৰ্য্যশালী মহাত্মারা কোন বনে কোন স্থানে কিরূপ আচরণে দ্বাদশ বৎসর অতিবাহিত করিলেন? কি প্রকারেই বা সকল রমণীর শিরোমণি, রাজপুত্রী, পতিপরায়ণা, মহাভাগা দ্রৌপদী নিতান্ত সুখোচিতা হইয়াও নিদারুণ বনবাসক্লেশ সহ্য করিয়াছিলেন? হে তপোধন! এই সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তরে কীর্ত্তন করুন। আপনার নিকট সেই অমিততেজাঃ বীরপুরুষগণের চরিত্র শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত কৌতূহল হইতেছে।
পাণ্ডববনগমনে পুরবাসীদিগের খেদ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্ৰতনয়েরা কপটদ্যূতে পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিলে পর তাহারা জাতক্ৰোধ হইয়া শস্ত্রগ্রহণপূর্ব্বক দ্রৌপদী-সমভিব্যাহারে বর্দ্ধমান পুরদ্বার দিয়া হস্তিনানগর হইতে বহির্গত হইয়া উত্তরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। ইন্দ্ৰসেন প্রভৃতি চতুর্দ্দশ ভৃত্য স্ত্রীগণ-সমভিব্যাহারে সত্বর রথে আরোহণপূর্ব্বক তাহাদের অনুগামী হইল। পুরবাসিগণ তাঁহাদের বনগমনবার্ত্তা-শ্রবণে নিতান্ত শোকসন্তপ্ত হইয়া নিৰ্ভয়চিত্তে ভীষ্ম, বিদুর, দ্রোণ ও কৃপাচাৰ্য্যকে বারংবার নিন্দা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “যেখানে শকুনির নিকটে শিক্ষিত দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন কর্ণ ও দুঃশাসনের সাহায্যে রাজ্য করিতে অভিলাষী, সেখানে আমাদের কুল ও গৃহ প্রভৃতি সমুদয়ই নষ্ট হইয়াছে। পাপসহায় পাপাত্মা দুৰ্য্যোধন যেখানে রাজ্য করে, সেখানে সুখের কথা দূরে থাকুক, কুল, আচার, ধর্ম্ম, অর্থ প্রভৃতি কিছু থাকে না। ঐ পাপাত্মা গুরুজনদ্বেষী, আচারভ্রষ্ট, সৌহার্দ্যশূন্য, অর্থলুব্ধ, অহষ্কৃত, নীচপ্রকৃতি ও নিষ্ঠুর। ঐ দুরাত্মার শাসনে সমুদয় মেদিনীমণ্ডল একেবারে উৎসন্ন হইবে, সন্দেহ নাই; অতএব করুণাদ্রা-হৃদয়, জিতেন্দ্ৰিয়, কীর্ত্তিমান, ধর্ম্মচারপরায়ণ, মহাত্মা পাণ্ডবগণ যেখানে গমন করিতেছেন, আমরাও সকলে সেইখানে গমন করি।” পৌরগণ এই কথা বলিয়া পাণ্ডবগণের সমীপে গমনপূর্ব্বক বদ্ধাঞ্জলিপুটে কহিতে লাগিল, “হে ক্ষমাস্পদ মহাত্মাগণ! আপনারা এই দুঃখভাগীদিগকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গমন করিবেন? আমরাও আপনাদের অনুগামী হইব। নির্দ্দয় শত্ৰুগণ অধর্ম্মাচরণপূর্ব্বক আপনাদিগকে পরাভব করিয়াছে, শ্রবণ করিয়া আমরা সাতিশয় শঙ্কিত হইয়াছি। আমরা আপনাদিগের ভক্ত, অনুরক্ত, সুহৃদ, প্রিয়কারী এবং সতত শুভানুধ্যায়ী; আপনারা আমাদিগকে পরিত্যাগ করিবেন না। আমার সেই ন্যায়পরাঙ্মুখ কুরুরাজের অধিকারে বাস করিলে নিশ্চয়ই সমূলে বিনষ্ট হইব। হে পাণ্ডবগণ! গুণ ও দোষ, সৎ ও অসৎ সংসৰ্গ হইতে যেরূপ সংক্রামিত হয়, শ্রবণ করুন। যেমন বস্ত্ৰ, জল, তিল ও ভূমি কুসুমসংসর্গে সুরভিত হইয়া উঠে, সেইরূপ সংসৰ্গজনিত গুণ অন্যকেও গুণবান করিতে পারে। মূঢ়সমাগম কেবল মোহজালের আকর আর নিত্য সাধুসমাগম কেবল ধর্ম্মের আবহ [আনয়নকারী]; অতএব প্রজ্ঞাশীল বৃদ্ধ, সুশীল ও শমপরায়ণ সাধুগণের সহবাসই কর্ত্তব্য। যাহাদিগের কুল, কর্ম্ম ও বিদ্যা এই তিনই পরিশুদ্ধ, তাহাদিগেরই সেবা করা উচিত; তাহাদিগের সহবাস শাস্ত্রালোচনা অপেক্ষাও গরীয়ান। আপনারা পূণ্যশীল, আমরা সৎকর্ম্মপরিবর্জ্জিত হইলেও পূণ্যশীলগণের সহবাসে পূণ্যলাভ করিতে পারিব, কিন্তু পাপসেবায় নিরত থাকিলে আরও পাপপঙ্কে পতিত হইতে হইবে। অসাধু ব্যক্তিকে দর্শন, স্পর্শ এবং তাহার সহিত আলাপ ও সহবাস করিলেই ধর্ম্মভ্রষ্ট হইতে হয়। পুরুষগণের বুদ্ধি অধমসমাগমে অধম, মধ্যমসমাগমে মধ্যম ও উত্তমসমাগমে উত্তম হইয়া উঠে। মহাত্মগণ যে সকল গুণ ধর্ম্মকামার্থসম্ভূত, লোকাচারনিয়ন্ত্রিত, বেদোক্ত এবং শিষ্টসম্মত বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন, আপনারা সেই সমস্ত গুণে গুণবান; আমরা শ্রেয়োভিলাষী, সুতরাং আপনাদের সহিত বাস করিতে বাসনা করি।”
যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে পৌরগণের সহগমননিবৃত্তি
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “আমরাই ধন্য, কেন না, আমাদের যে সকল গুণ বাস্তবিক নাই, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি প্ৰজাগণ স্নেহ ও কারুণ্যরসপরবশ হইয়া তাঁহাও কীর্ত্তন করিতেছেন; অতএব আমি ভ্রাতৃগণের সহিত সকলকে যাহা নিবেদন করিতেছি। আপনারা আমার প্রতি স্নেহ ও অনুকম্পা করিয়া তাহার অন্যথা করিবেন না। পিতামহ ভীষ্ম, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, জননী কুন্তী এবং অনেকগনেক বন্ধু-বান্ধবগণ হস্তিনানগরে রহিলেন। তাঁহারা শোকসন্তাপে অত্যন্ত কাতর হইয়াছেন, আপনারা সকলে মিলিত হইয়া অন্ততঃ আমাদের হিতকামনায় তাহাদিগকে যত্নপূর্ব্বক রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন। আমি বন্ধুবান্ধবগণকে আপনাদের সমীপে সমৰ্পণ করিলাম, আপনারা তাঁহাদের প্রতি স্নেহান্বিত হইয়া আমাদের সহগমনে নিবৃত্ত হউন; তাহা হইলেই আমার তুষ্টিসাধন ও সৎকার করা হয়।”
ধর্ম্মরাজ প্ৰজাগণকে এইরূপ আমন্ত্ৰণ করিয়া বিদায় করিলে তাহারা একত্র হইয়া “হা, রাজনী!” বলিয়া অতি করুণস্বরে আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল এবং কৌন্তেয়গণের গুণরাশি স্মরণপূর্ব্বক অতি কাতরচিত্তে অগত্যা প্রতিনিবৃত্ত হইল। পৌরগণ প্রতিনিবৃত্ত হইলে পাণ্ডবেরা রথরোহণপূর্ব্বক জাহ্নবীতীরে প্রমাণনামক মহাবট লক্ষ্য করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। দিব্যাবসানে তথায় উপস্থিত হইয়া পবিত্ৰ জল স্পর্শ করিলেন এবং কেবল ঐ জলমাত্ৰ পান করিয়া অতি কষ্টে সেই রাত্ৰি তথায় অতিবাহিত করিলেন। কতকগুলি সাগ্নিক ও অনগ্নিক ব্ৰাহ্মণ স্নেহবশতঃ বন্ধুবান্ধব-সমভিব্যাহারে তাঁহাদের অনুগামী হইয়াছিলেন; রাজা যুধিষ্ঠির সেই সকল ব্ৰহ্মবাদিগণে পরিবৃত হইয়া সাতিশয় শোভা পাইতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণগণ হোমাগ্নি প্রজ্বালনপূর্ব্বক ব্ৰহ্মবাদসহকৃত আলাপ করিতে আরম্ভ করিলেন এবং আশ্বাসনবাক্য কুরুকুলচূড়ামণি ধর্ম্মরাজের চিত্তবিনোদন করিয়া রজনী অতিবাহিত করিলেন।