আজ রাতে নাগরিক নিসর্গ বিষয়ে একটি কবিতা
লেখার কথা ভাবছিলাম,
আমার কলম শাদা কাগজের বুকে অক্ষর সাজানোর
অতিপ্রায়ে উন্মুখ, ঠিক তখনই আমার গলির গাছপালা,
ফুলের বাগান, নিশীথ-জড়ানো আসমানের
রহস্যময় সৌন্দর্য লেখনীর গতি রুদ্ধ করে বলল-
‘আজ আমরা তোমাকে আমাদের কথা
লিখতে দেবো না। কবি, আজ তুমি লেখো তোমার
প্রিয়তম জন্মশহরের সেই ছাত্রাবাসের কথা, যেখানে
সশস্ত্র পুলিশের বুটের আঘাতে নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্রদের
ভাতের থালা শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে
মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে,
যেখানে মেধাবী শিষ্টাচারপরায়ণ
শিক্ষার্থীর হাত-পা ভেঙে বন্দুকের বাঁট দিয়ে
বর্জ্যের মতো ছুঁড়ে ফেলেছে থানায়,
যেখানে ছাত্রদের কাঁটাতারে বেঁধে পিটিয়ে
আধমরা করে ফেলা হয়েছে,
যে-শিক্ষার্থী ঘুমের ভেতর সুখস্বপ্ন দেখছিল,
সে ভীতসন্ত্রস্ত জেগে উঠল হায়েনার হামলায়
ঘোর দুঃস্বপ্নে, সে বুঝতেই পারল না,
কেন তাকে সইতে হচ্ছে কসাইখানার নিপীড়ন।
আজ রাতে একটি প্রেমের কবিতা লিখব বলে
মনস্থির করলাম। গৌরীর মুখ আমার চোখে ভেসে উঠল।
তার উদ্দেশে কবিতা রচনার জন্যে কলম ধরতেই,
গৌরী, যে এখন এই শহরে নেই, আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
হাত থেকে বলপেন প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলল-
‘আজ আমার উদ্দেশে কোনো কবিতা
লেখার প্রয়োজন নেই।
কবি, বরং আজ তুমি লেখো সেই মায়ের
অশ্রুধারার কথা, যার ছেলের পাঁজর গুঁড়িয়ে গ্যাছে
অত্যাচারী বুটের আঘাতে, তুমি লেখো সেই
বিধবার কথা, যার বুক আজ শস্য-কাটা ক্ষেতের মতো,
যার স্বামীকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসের কর্কশ হাত।
গম্ভীর কণ্ঠস্বরে সুপ্রিয়া গৌরী বলল-
‘কবি, তুমি আজ তোমার কলম থেকে নিঃসৃত হ’তে দাও
লানতের পঙ্ক্তিমালা
লানত দাও তাদের, যারা তোমার প্রিয়তম শহরকে
একাত্তরের ধরনে বন্দশিবির বানিয়ে
প্রেতনৃত্যে মেতে উঠতে চায়।
লানত দাও তাদের, যারা গণতন্ত্রকে সঙ সাজিয়ে
শহরে ও গ্রামে ভড়ং দেখাচ্ছে সং বিধান রক্ষার,
কবি, তুমি লানত দাও তাদের, যাদের হাত থেকে ঝরছে রক্ত,
যাদের হাতে লাশের গন্ধ,
লানত দাও তাদের যারা ‘মালাউন’ গাল পেড়ে মুক্তিযুদ্ধের
রণধ্বনি এবং জয়ধ্বনি জয়বাংলা ছাত্রদের পায়ুপথে
ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছি বীভৎস উল্লাসে,
লানত দাও তাদের, যাদের কপালে মহাকাল
ফ্যাসিবাদের সীলমোহর এঁকে দিয়েছে;
কবি, তোমার কলম থেকে আজ ফুল-চন্দন নয়,
এই ঘোর অমাবস্যায় ঝরুক
জালিমদের কেল্লা-পোড়ানো স্ফুলিঙ্গ।