বাঁচা গেলো, অবশেষে শল্যপর্ব হলো শেষ।
চল্লিশ বছর ধরে যে বিষাক্ত ফুল
পরেছি গোপনে
মুলে ভুল ক’রে তা নির্মল হলো এতদিনে ভেবে
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ি। অবলীলাক্রমে এক জোড়া
শব্দ বাঁচা গেলো’ উচ্চারণ
করলাম বটে, তবে তার কোনো মানেই হয় না। একবার
যার ভাগ্যে জোটে
বন্য কুকুরের তাড়া, তার
প্রকৃত নিস্তার নেই কোনোদিন। হলদে রবারের হাত
নিপুণ শিল্পের সহযোগিতায় দ্রুত
পচনপ্রবণ অতিরিক্তি মাংসপিণ্ড আমার এ শরীরের
উপড়ে ফেলেছে কিন্তু তার
ধকল চলেছে সাতদিন পরও, হয়তো
চলবে অধিককাল। ক্ষত সারাবার জন্যে আরো কিছু
কারুকার্য বাকি আছে, অবশিষ্ট আরো কিছু আঁচ।
যে গন্ধ আমাকে খুব দূরে
সরিয়ে রেখেছে হাসপাতালের থেকে রবাবর,
সে গন্ধ এখন
আমার ভেতর থেকে, মনে হয়, বেরুচ্ছে সর্বদা।
প্যাথেড্রিন শিরাপুঞ্জে ঘুমপাড়ানিয়া
গান গায়, তবু মাঝে-মাঝে দূরতম
পূর্বপুরুষের
যন্ত্রণা জাগিয়ে রাখে। উঠে দাঁড়ালেই হাঁটু কাঁপে,
দু’পা এগোলেই ভাবি আবার নতুন করে যেন
হাঁটতে শিখছি, এ রকম
নড়বড়ে আপাতত আমার চলন,
এখন আমার পথ্য তরল আহার্য কতিপয়।
কখনো কখনো গীতবিতানের আছে মৃত্যু আছে
দুঃখ এই শব্দগুচ্ছটিকে সাময়িকভাবে
মিথ্যে করে দিয়ে ডেকে ওঠে শহুরে কোকিল।
এই সে সময়
যখন কাঁচের গ্লাসে টলটলে জল
দেখে, হরলিক্সভরা পেয়ালায় খানিক চুমুক
দিলে, ভিজিটিং আওয়ারের
উপহারগুলি বাদশাহ সুলেমানের খনির
রাশি রাশি রত্নের চেয়েও দামী মনে হয় বলে
কপালে অথবা চুলে কারো স্পর্শ পেলে
সিস্টারের হাত থেকে ক্যাপসুল, নিদ্রাবড়ি
তুলে নিলে ভালো-লাগা নূপুরের মতো
বেজে ওঠে। এই সে সময়
যখন ক্লিনিক বড় তন্দ্রাতুর। তরতাজা যে যুবক
বেহালা-বাদক
অন্ত্রে দুষ্ট ক্ষত নিয়ে এসেছে এখানে,
এখন কেবিন তার কবরের মতো
অত্যন্ত নিশ্চুপ। শাদা ত্র্যাপ্রনের জুতোর ঈষৎ
শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই-
না বৃদ্ধের গোঙানি না নব্জাতকের
চিৎকার, কিছুই নেই। দূরে
সিস্টার আলোয় মিশে বলপেন দিয়ে
লিখছেন রুগীর রিপোর্ট, কাকে কোন্ বেলা
কী কী ওষুধ খাওয়াবেন, সযত্নে মিচ্ছেন টুকে।
আমি নিদ্রাহীন অলক্ষ্যে বেরিয়ে আসি শূন্য বারান্দায়
আরোগ্যশালার নানা রুগীময় কেবিন পেরিয়ে
বারান্দায় এসে
অকস্মাৎ দেখি দূরবর্তী মিনারের কিনারায়
ডাগর ক্ষতের মতো চাঁদ,
বিশদ আবৃত্তি করে ক্ষুধা, ব্যাণ্ডেজে লুকানো ক্ষত
নিয়ে ভাবি সারা দেশ আমার মতোই খুব অসুস্থ অসুখী।