রক্তাক্ত প্রান্তরে

এখন চরে না ট্যাঙ্ক ভাটপাড়া, ভার্সিটি পাড়ায়
দাগে না কামান কেউ লক্ষ্য করে ছাত্রাবাস আর।
এখন বন্দুক
ভানালার ভেতরে হঠাৎ
দেয় না বাড়িয়ে গলা অন্ধকারে জীবনানন্দীয়
উটের মতন। ফৌজি ট্রাক কিংবা জিপ
রাস্তায় রাস্তায়
পাগলা কুকুরের মতো দেয় না চক্কর। এখন তো
হেলমেটকে মানুষের মস্তকের চেয়ে
বেশি মূল্যবান বলে ভুলেও ভাবি না।

এখন বিজয়ানন্দে হাসছে আমার বাংলাদেশ
লাল চেলী গায়ে, কি উদ্দাম। গমগমে
রাস্তাগুলো সারাক্ষণ উজ্জ্বল বুদ্বুময়। শুধু আপনাকে,
হ্যাঁ, আপনাকে, মুনীর ভাই,
ডাইনে অথবা বাঁয়ে, কোথাও পাচ্ছি না খুঁজে আজ।
আপনার গলার চিহ্নিত স্বর কেন
এ শহরে প্রকাশ্য উৎসবে
শুনতে পাব না আর? সেই চেনা স্বর? ঝরা পাতার ওপর
খরগোশের মৃদু পদশব্দের মতন?
আপনার মতো আরও কতিপয় মুখ
চেনা মুখ আর
এখানে যাবে দেখা, যাবে না কখনো।

মনে পড়ে, জুনে জলে-ঘোলা পচা ডিমের বিশদ
কুসুমের মতো এক ঘোলাটে বিকেলে
এই শক্র প্লাবিত শহরে হ’ল দেখা।

আপনার সঙ্গে পথপার্শ্বে। দেখলাম,
আপনি যেনবা সেই জলচর পাখি,
ডাঙ্গায় চলতে গিয়ে ব্যর্থ,
হোঁচটে হোঁচটে
বিষম ক্ষতবিক্ষত, পরাজিত, দারুণ নিষ্প্রভ।
আমাদের সবার জীবনে
নেমেছে অকালসন্ধ্যা, হয়েছিল মনে,
আপনার চোখে চোখ রেখে।
তখন সে চোখে কবরের পরগাছার কী কর্কশ
বিষণ্ণতা আর হানাবাড়ির আঁধার
লেপ্টে ছিল, বারুদের গন্ধ ছিল সত্তায় ছড়ানো।

‘এই যে, কেমন আছ শামসুর রাহমান, তুমি?
খবর আছে কি কিছু?’-যেন আপনারই ছায়া কোনো
করল প্রশ্ন রক্তাক্ত প্রান্তরে। অসামান্য
বাগ্মীও কেমন আর্ত হন, হায়, বাক্যের দুর্ভিক্ষে,
বুঝেছি সেদিন।

আপনার চোখে বুঝি ফুটেছে অজস্র বনফুল,
নেমেছে জ্যোৎস্নার ঢল মুখের গহ্বরে, প্রজাপতি
পেলব আসন পাতে বৃষ্টি ধোয়া ললাটের মাঠে,
আপনাকে ঘিরে দৈনন্দিন
ঘাস আর পোকামাকড়ের গেরস্থালি।

আপনি মুনীর ভাই কুকুর কি শেয়ালের পায়ের ছাপের
অন্তরালে ঢাকা পড়ে থাকবেন, হায়,
কী করে আপোষ করি এমন ভীষণ অত্যাচারী
ভাবনার সাথে?
বলুন মুনীর ভাই, আপনি কি আগাছার কেউ?
আপনি কি ক্রীড়াপরায়ণ প্রজাপতিটার কেউ?
আপনি কি শেয়ালের? কুকুরের? ঘাসের? পিঁপড়ের?
শকুনের? আপনি কি ক্রূর ঘাতকের?

শুনুন মুনীর ভাই, আপনার বারান্দার নিভৃত বাগান
কেমন উদগ্রীব হয়ে আছে গৃহস্বামীর প্রকৃত
শুশ্রূষার লোভে আজও। একটি বিশুষ্ক ঠোঁট বৈধব্যের ষাটে
জেগে থাকে আপনার উষ্ণ চুম্বনের প্রতীক্ষায়,
একটি টাইপরাইটার আপনার একান্ত স্পর্শের জন্যে
নিঝুম নীরব হয়ে থাকে। ফের কবে
পাতা উল্টাবেন বলে সকালে দুপুরে মধ্যরাতে
পথ চেয়ে থাকে শেল্‌ফময় গ্রন্থাবলি
আপনার পদধ্বনি আবার শুনবে বলে ঐ তো
এখনও ফ্ল্যাটের সিঁড়ি কান পেতে রয় সারাক্ষণ। কোনো কোনো
সভাগৃহ আপনার ভাষণের জন্যে আজও কেমন উৎকর্ণ
হয়ে পড়ে। আপনার অভ্যস্ত ছায়ার জন্যে এখনও পড়ে না
দর্পণের চোখের পলক।

‘আছে কি খবর কিছু?’-আপনার ব্যাকুল জিজ্ঞাসা
সাঁতরে বেড়ায় আজও আমার মগজে ক্ষান্তিহীন।
কেলিপরায়ণ
মাছের মতন কোন সংবাদে লেজ ধরে সেদিন বিকেলে
রক্তাক্ত প্রান্তরে
আপনাকে পারিনি দেখাতে।
অথচ এখন নানারঙা পাখি হয়ে ডেকে যায়
খবরের ঝাঁক ইতস্তত। শুনুন মুনীর ভাই
কালো জঙ্গি পায়ের তলায় চাপা-পড়া
আপনার বাংলাদেশ লক্ষ লক্ষ বুটের চেয়েও
বহু ক্রোশ বড় বলে বর্গীরা উধাও। বহুদিন
পরে আজ আমাদের মাতৃভূমি হয়েছে স্বদেশ,
ইত্যাদি ইত্যাদি
খবর শুনুন।

শুনুন মুনীর ভাই, খবর শুনুন বলে আজ
ছুটে যাই দিগ্ধিদিক, কিন্তু, কই কোথাও দেখি না আপনাকে।
খুঁজছি ডাইনে বাঁয়ে, তন্ন তন্ন, সবদিকে, ডাকি
প্রাণপণে বার-বার। কোথাও আপনি নেই আর।

আপনি নিজেই আজ কী দুঃসহ বিষণ্ন সংবাদ।