দরজার সামনে গিয়ে হঠাৎ অপ্রস্তুত হলাম। আগে কখনও
এই দরাজ, সুকান্ত দরজার মুখে এমন কঠিন্য দেখিনি।
আমাকে দেখলেই সে উদ্ভাসিত হতো হাসিতে, ‘এসো, এসো’
ধ্বনি বেজে উঠত ওর কণ্ঠে বাঁশির সুরের মতো। প্রতিহত
আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থতা
আমার মুখ ম্লান করে দেয়। অন্দর মহলে খবর পাঠাবার
জো নেই। বিরূপ দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার পথ চলা।
বহুদূর হেঁটে হেঁটে এক বিরান জায়গায় চোখে পড়ে কার্ডফোনের
বুথ। আশান্বিত আমি ক্ষণকাল পরে বুঝতে পারি টেলিফোন
বিকল; পথে নামতেই মাথার ওপর এক বদমেজাজি পাখির পাখসাট।
আবার সেই দরজার উদ্দেশে যাত্রা। চেনা বাড়িতে ঢুকতে না
পারলে আমার স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। গন্তব্যে পৌঁছে দেখি,
এবার দরজা খানিক খোলা। মনে চকিতে কিসের দোলা লাগে,
তাহলে দরজার কাঠিন্যের বরফ গলেছে। একটু চাপ দিতেই
খুলে যায় দোর। পা বাড়াই। ভেতর মহল বড়ো সুনসান। নিদ্রায়
নিঝুম কি সবাই? সিঁড়ি পাশে রেখে ড্রইং রুমে প্রবেশ
করতে যার, পথ আগলে প্রসারিত মাকড়সার জাল। এই জাল
এমন শক্ত হতে পারে জানা ছিল না। জাল ছিঁড়ে এগোই।
অন্ধকার সোফায় সেই মানবীকে দেখি, যার জন্যে এখানে
আমার আসা। আমার উৎসুক প্রশ্ন ‘কেমন আছো?’ নিরুত্তর
সে। খুব কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখি, যেন রক্তমাংসের কেউ নয়,
পাথরের মূর্তি। মূর্তির শীতলতায় আমার হিমপ্রবাহ। হঠাৎ
একটা শব্দে ঘরের নীরবতা আক্রান্ত। দেয়াল থেকে পড়ে যাওয়া
বস্তুটি কুড়িয়ে নিয়ে দেখি সেই মানবীর কৈশোরের কোমল
ছবি। ভালো করে দেখে, খানিক আদর বুলিয়ে ওর শৈশবকে
টেবিলে রেখে পাথরের মূর্তির দিকে তাকাই আবার।
শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমি ঘরে আলো জ্বালতে অক্ষম। হিংসুটে
অন্ধকার তার দাঁত বসিয়ে রেখেছে সারা ড্রইং রুমে। আমার
ঠোকর খেয়ে মেঝেরে কার্পেট কী যেন কাৎরে ওঠে। ঝুঁকে আবিষ্কার করি
আমারই লেখা কবিতার বই, আরশোলার মল আর কীটের কামড়ে
ভীষণ জব্দ, আহত। এই জখমি বইটিকে কোথায় রাখব ভেবে
পাই না। টেবিলে রাখব? নাকি মেঝেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে
থাকবে, যেমন দুর্ঘটনায় পথচারী? ভেবে পাই না। আমার
পা একটু টলে যায়। বইটি টেবিলে রাখলে মানবীর কৈশোরের
পাশে ওকে মানাবে না। আমার হাতেই রয়ে যায়। বইয়ের পাতাগুলো
থেকে উঠে আসা আর্তনাদ শুনে মনে হলো আমার অন্তর্গত
হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে সারা বাড়ির আনাচে কানাচে। বিকেলে
ড্রইং রুমের পাথরের মূর্তির চোখে সন্ধ্যার শিশির।