মিহির, তোমার কি মনে পড়ে
জামিলের কথা?
হ্যাঁ, আমিই সেই জামিল,
যে তোমার, বলা যেতে পারে,
প্রায় অষ্ট প্রহরের
সঙ্গী ছিল। ওরা বলতো,
আমরা দু’জন মানিকজোড়।
এক সঙ্গে আমরা যেতাম
স্কুলে, খেলার মাঠে,
কখনো যেতাম বেলাবেলি
পাশের গাঁয়ের মেলায়।
গুরুজনদের চোখ ফাঁকি দিয়ে
দেখতে যেতাম যাত্রা
কুয়াশাঢাকা পথে
আমরা জু’জন হাত ধরাধরি
ক’রে। যখন
যে যার বাড়িতে ফিরতাম,
তখন ঘাসের ডগায়
চিকচিক করছে ভোরের
শিশির, তোমার মনে পড়ে
মিহির?
আমি, আজকের জামিল
আখতার,
কিছুতেই ভুলতে পারি না
সেসব দিনের কথা।
রাজহাঁসের মতো
গ্রীবা উঁচিয়ে আমার দিকে
এগিয়ে আসে অনেকগুলো
বছর।
মিহির, তোমাদের বাড়ির
সমুখে ছিল
কনকচাঁপার গাছ। একবার
এক স্বর্ণলতা আমাকে
জড়িয়ে ধরেছিল অবিকল
তোমারই মতো। তুমি মৃদু
হেসে
আমাকে নিয়ে গেলে তোমার
পড়ার ঘরে। কাকিমা,
মানে তোমার মা আমার
জন্যে ঝকঝকে কাঁসার
বাটিতে
নিয়ে এলেন নারকেলের নাড়ু
আর মোয়া। কাকিমার মুখ
মনে পড়লেই দেখি আকাশের
কিনারে
কল্যাণ ছড়িয়ে রয়েছে।
আত্মভোলা কাকা বাবু
তোমার বাবা, আমার
অজান্তেই আমাকে জীবনের
গভীর সবক দিয়েছিলেন তাঁর
উদার দৃষ্টি,
নিষ্কম্প মানবিকতাবোধ এবং
জন্মভূমির প্রতি
আরাধনাপ্রতিম ভালোবাসা
দিয়ে? কী ক’রে ভুলব
তাঁর কথা? জানি না, তিনি
বেঁচে আছেন কি না,
থাকলেও
তিনি কোনোদিন জানবেন না,
আমি একলব্যের মতো
আজো দূর থেকে অনুসরণ
করে চলেছি তাঁর নীতি।
মিহির,
তোমাকে কোনোদিন বলি নি
এ-কথা।
মিহির, তুমি কী সুন্দর আবৃত্তি
করতে জীবনানন্দের কবিতা,
আমি তন্ময় হ’য়ে শুনতাম
আর চলে যেতাম
রাঙা রাজকন্যাদের দেশে। বন
জ্যোৎস্নায়, স্পষ্ট দেখতে
পেতাম,
ভেসে উঠছে মৃণালিনী
ঘোষালের শব। মিহির,
তুমি, হ্যাঁ তুমিই আমাকে
দীক্ষিত করেছিলে আধুনিক
কবিতায়।
বাংলা কবিতা যে কী মধুর
সঙ্গীতময়, তা আমি
জেনেছিলাম
তোমার আবৃত্তির গুণে,
কবিতার পংক্তিমালা আমার
চিত্তে বয়ে যেতো ঢেউয়ের পর
ঢেউয়ের মতো,
আমি শুধু অবাক হ’য়ে
শুনতাম। তোমার সুরেলা
কণ্ঠস্বর
আজো আমার স্মৃতিতে গুণীর
তান।
এর পরের ঘটনা বর্ণনা করার
মুখ নেই
আমার কলমের। ধর্মান্ধতা
মানুষকে কীভাবে অমানুষ
ক’রে তোলে,
একে অন্যের গলায় ছুরি
চালায়, সম্ভ্রম লুট করে
সস্তা পণ্যের মতো, ভাই
ভায়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে
উল্লাসে ফেটে পড়ে, এ-কথা
আমরা এই উপমহাদেশের
অসহায় মানুষ জেনেছি চড়া
দামের বিনিময়ে। দাঙ্গা
অসংখ্য মানুষের ঘর ভাঙার
কলংকিত ইতিহাসই শুধু নয়,
মানবতার কুৎসিত হন্তারকও
বটে।
তোমরা, মিহির, দেশান্তরী
হ’লে তোমার বোন শেফালী
যেদিন হ’য়ে গেল দলিত
শিউলির মতো। আমার প্রিয়
দেশ থেকে
সংখ্যালঘুদের এই নীরব
প্রস্থান কী ক’রে ঠেকাবো
কোন্ আশ্বাসের দেয়ালি
জ্বেলে? দস্যুরা কখনো সবচনে
কর্ণপাত করে না। ওদের
বর্শার ফলায়
বিদ্ধ হয় মৈত্রী এবং
সহমর্মিতার হৃৎপিণ্ড।
মিহির, সেদিন, তোমাদের
বাস্তুভিটায় গিয়ে দেখলাম,
সেখানে আমাকে গ্রীবা
বাড়িয়ে
স্বাগত জানানোর মতো
কোনো রাজহাঁস নেই।
সেখানে এখন
এক ধুরন্ধর শেয়াল তার
পরিবার নিয়ে বাস করছে।
আরেকটি খবর তোমাকে না
ব’লে পারছি না,
এখন নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের
কায়ক্লেশে ভোটকেন্দ্রে
যেতে হয় না আর, অদৃশ্য
সংকেতে
অন্যেরা তাদের ভোট দিয়ে
দেয় মহানন্দে, সগৌরবে!
কী অদ্ভুত বিবেচনা! চাঁদের
কষ্ট হবে ভেবে হয়ত একদিন
ওরা তাকে নিজেরাই ঠেলে
ঠুলে আসমানের এপার থেকে
ওপারে পাঠিয়ে দেবে।
২৯.৩.৯৪