(পূর্বলেখ)
এই সেই পৃথিবী অপার মাটি যার এতকাল
সুপুষ্ট স্তনের মতো ফল আর ফাল্গুনের ফুল
করেছে উৎসর্গ নিত্য সন্তানের শ্রম প্রজ্ঞা প্রেমে
পূর্ণ হয়ে দীর্ণ হয়ে? এই সেই পৃথিবী সাবেকি?
দেখেছি সমুদ্রতীরে অস্তরাগে একদা হাওয়ায়
নর্তকী-শিখার মতো সফেদ তরুণ ঘোড়া এক
মেতেছে খেলায়-মনে পড়ে পিছনে এসেছি ফেলে
উজ্জ্বল হরিণ-দিন, উন্মুখতা সজীব গাছের।
এতদা যে-নদী নীলিমাকে ভালোবেসে চেতনায়
নিপুণ শিল্পীর মতো গড়েছে নিবিড় দুই তীর,
তাকে আর পাব নাকো দৃষ্টির রেখায় দীপ্ত, প্রাণে
হবে না মুখর ঝরনা বসন্তের বিফল সম্ভাষে।
যে-চেতনা এল ফিরে দুঃস্বপ্নের কুয়াশাকে চিরে
জীবনে আবার অন্ধ নিয়তির মতো দুর্নিবার
চাইনি এমন আলো অভিসন্ধি যার নিমেষেই
নরকবিলাসী শুধু লুব্ধ এক তৃষিত কোরাসে।
এখন যে-অগ্নিকুণ্ড দাহ আনে কে তাকে নেভাবে
প্রসন্ন রুপালি জলে? সূর্যহীন হয়েছে এখন
যে-হৃদয় অনেক অজ্ঞাতবাসে, অন্ধকারে তার
শুধুই প্রেতের গান-নেই কোনো সমুজ্জ্বল মুখ।
অন্ধকার ভয় ব্যাপ্ত রক্তের ভিতর, সাড়া নেই
লোকালয়ে, এমনকি পাখির চিৎকারে অতর্কিতে
কাঁপে না হাওয়ার ঢেউ, ভয়াবহ স্তব্ধতা পথের।
‘দাঁড়িও সেখানে তুমি’-বলেছিল কেউ-মনে পড়ে,
নিঃশব্দে যেখানে শত হৃতদীপ্তি আত্মার মিছিল
রক্ত আর হলুদ পুঁজের ভাণ্ড তুলে ধরে মুখে।
দারুণ দুঃস্বপ্ন-বিদ্ধ বিকারের ঘোরে তমসায়।
ভুলতে-না-পারা অগণিত স্মৃতির করাল চিহ্নে
কণ্টকিত তাদের বিশীর্ণ সত্তা; দাঁড়িও সেখানে-
তারপর চলে যেও একা তুমি, কোরো না যাচাই।
এ-দৃশ্যের বোধ যাকে পায় সে কি মৃত্যু নয় তবে,
মৃত্যু নয়, মৃত্যু নয়, মরণের অন্য মানে আছে?
মনে হয় আমি যেন সেই লোকশ্রুত ল্যাজারস,
তিনদিন ছিলাম কবরে, মৃত-পুনর্জীবনের
মায়াস্পর্শে আবার এসেছি ফিরে পৃথিবীর রোদে।
পোশাকের জেল্লা তবু পারে না লুকাতে কোনোমতে।
বিকৃত দেহের ক্ষত, লোবানের ঘ্রাণ সহজেই
ডুবে যায় প্রাক্তন শবের গন্ধে; নীল আঙুলের
প্রান্তে বিদ্ধ তিনটি দিনের ক্ষমাহীন অন্ধকার।
ভাস্করের অসম্পূর্ণ মূর্তির মতন ঘুরে ফিরি।
উল্লোল নগরে কত বিলোল উৎসবে; কিন্তু তবু
পারি না মেলাতে আপনাকে প্রমোদের মোহময়
বিচিত্র বিকট স্বর্গে। বিষাক্ত ফুলের মতো কত
তন্ময় রহস্য জ্ব’লে ওঠে আজও দু’চোখে আমার।
সত্তায় এনেছি বয়ে অন্তহীন আশ্চর্য বিষাদ।
সেহেতু সে-বিষাদের বৃন্তে ফোটে আতঙ্কের ফুল,
আমার সান্নিধ্যে কেউ ঘেঁষে না সহজে, ভয়, পাছে
তাদের শিরায় নামে লিথির বিষণ্ন জলধারা।
স্বর্গদীপ্ত প্রাণ নিয়ে এসে এ কোথায় কোন দেশে
হারিয়ে ফেলেছি রূপ পশুর রোমশ অন্ধকারে?
এখানে মরার খুলি ধুলোয় গড়ায় চারদিকে,
খেলার ঘুঁটির মতো অসহায়, ভবিষ্যৎহীন।
মাঝে-মাঝে কৃষ্ণকায় বিকট পাখির লৌহচঞ্চু
মাংস ছিঁড়ে নিতে আসে-আমি তাকে পারি না ফেরাতে।
আর চেয়ে দেখি মৃত্তিকায় করোটিতে জ্যোৎস্না জ্বলে
বিষণ্ন স্মৃতির মতো, দ্বিতীয় মৃত্যুর ধ্বনি ভাসে।