বৃহস্পতিবার রাতে যখন আমার কব্জি ঘড়িতে
কবুতরের চোখের মতো
থরথর করছে দেড়টার সংকেত, যখন আমি
নির্ঘুম চোখে তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে বেড়াচ্ছি
অবচেতনের গহন কুয়াশাচ্ছন্নতায়
একটি চিত্রকপ্ল, যা কাঠবাদামি সমালোচকদের মাথাকে
ক’রে দেবে ঘূর্ণ্যমান লাটিম, অত্যন্ত ঈর্ষুক ক’রে তুলবে
ধামাধরা পেটমোটা ইঁদুর আর মিরকুট্র
গন্ধমূষিকদের মতো কবিকুলকে,
তখন হঠাৎ আমার দৃষ্টির পক্ষে অবিশ্বাস্য
এক দৃশ্যের অবতারণা হ’লো আর আমি ফ্যাল ফ্যাল
তাকিয়ে থাকলাম সামনের দিকে।
একে উপক্রমনিণকা হিশেবে বিবেচনা করাই শ্রেয়,
কোথাও না কোথাও
শুরু তো করতেই হয়। তবে হলফ ক’রে বলতে পারি,
ব্যাপারটা ঘটেছিলো বৃহস্পতিবার ঠিক কাঁটায় কাঁটায়
রাত দেড়টায়, যখন আমি…
সত্যি বলতে, যে দৃশ্যের কথা বলছিলাম
তা’ দেখে আমার দুটো চোখই পাথর,
বুকের হাড়, মাংস আর ত্বক ভেদ ক’রে বেরুতে চাইলো
হৃৎপণ্ড, আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নামলো
এমন শৈত্যপ্রবাহ বা’ আমি ইহজীবনে
অনুভব করিনি, যেন কেউ আমাকে চালান ক’রে দিয়েছে
সুদূর হিমযুগে।
আরে বাবা, দেখি কি আজিমপুর, বনানী, জুরাইন
আর মীরপুরের গোরস্তান থেকে
কবর ফুঁড়ে বেড়িয়ে এসেছে মৃতের মিছিল।
খৃষ্টান সিমেট্রি
থেকেও দলে দলে বেরিয়ে এসেছে ওরা, যারা
লোকান্তরিত হয়েছে।
ধীমান, বিদ্বান, নিরক্ষর, শিক্ষক, নবাব, বিদূষক,
কুলি, কামিন, ওস্তাগার,
ভিস্তি কোচোয়ান, কসাই, সোনারু, কুরূপা, সন্দুরী-
একজনকে দেখে মনে হলো, একদা ছিলেন তিনি
শহরে সুন্দরীতমা, যদিও এখন গালে তার মাটি
লেগে আছে।
এমনকি সেকেলে দালালরাও
উঠে এসেছে পুরানো কবর ছেড়ে।
ওরা আসছে তো আসছেই,
শহর-উপচানো এই মৃতদের দুরু দুরু বুকে, ভয়ার্ত
কন্ঠে প্রশ্ন করি-
আজ রাতে আপনাদের এই
ভয়ানক ভিড় কেন আমাদের শহরে? কী এমন ঘটলো যে
আপনারা সবাই শান্তিময় চিরনিদ্রা ত্যাগ ক’রে
আবার আবির্ভুত হয়েছেন জীবিতের রূপে? তবে কি আজ
অভিশপ্ত এই শহর, আমার প্রিয় শহর,
ওরা গর্জে উঠে বললেন সমস্বরে-
এ শহরে জীবিত কেউ নেই আর, মৃতদের চেয়েও অধিক মৃত
বাসিন্দ্য ভ’রে গেছে ঘরের পর ঘর। তাই, তোমাদের
ঠাঁই হোক গোরস্তানে এবং
তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি জীবিত ব’লে
আমরা দখল করবো তোমাদের ঘরদোর।
আমি বোবার ধরনে আর্তনাদ ক’রে আমার নিঃসাড়
পাড়ায় সাড়া জাগাতে চেষ্টা করলাম সবার
ঘুম ভাঙানোর জন্যে অস্বাভাবিক উঁচু পর্দায়
বাঁধলাম কণ্ঠস্বর, বলতে চাইলাম-
এক্ষুণি আবার দাফন করো ওদের,
ওদের দাফন করো,
দাফন করো। কিন্তু কারো ঘুমের সর এতটুকু
রেখায়িত হলো না এবং আমিও
গোঙাতে গোঙাতে মড়ার মতো ঢলে পড়লাম নীরন্ধ্র ঘুমে।