নিম্নোক্ত কাব্যগ্রন্থগুলি সাজানো হয়নি

নোটবুক থেকে

এক

সে-রাতে ছিলাম বসে আমি একা কাঠের চেয়ারে।
হাতে ছিল কবিতার বই, পংক্তির গুঞ্জন ছিল
মগজের কোষে কোষে। এবং কুয়াশাময় দূর
শতাব্দীর বেদনায় ছায়া নামে হৃদয়ে আমার;
শুনতে চেয়েছি বুঝি কীট্‌সের মতো আমি সেই
হৈমন্তিক অনশ্বর পাখিটির গান, সুর যার
পাতার আড়ালে বয়ে যায় চিরদিন, হয়ে ওঠে
কীর্তনের যোগ্য আর সে সুরের বিশ্রুত কম্পন
কেমন সৃজনশীল প্ররোচনা দ্যায়, অবিনাশী
ওড পুর্নজন্মে মুঞ্জরিত হয় মগ্ন চেতনায়,
অথচ খাতার পাতা শস্যহীন ক্ষেতের মতন
থেকে যায় খুব কাছে ছায়াচ্ছন্নতায় যেন কার
উপস্থিতি টের পাই, অথচ যায়না দেখা তাকে,
অন্তরালে ক্ষয়রুগী দীপ্ত কবি মুচকি হাসেন।

দুই

পুরোনো দেয়ালে শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরে
অবিরল, সেই কবেকার কারো পতিগ্ররহে-যাত্রা মনে পড়ে।

তিন

মাঝে-মধ্যে মধ্যরাতে কামনার ধুলি
ব্যাকুল ওড়াই,
কোজাগরী পূর্ণিমায় দেহাত্মবাদের টানে চার্বাকের খুলি
এল কি আমার ঘরে? ওড়ে কিছু দর্শনের ছাই?

চার

একালে হাফিজ মহাকবি হলে,
তোমাকে দেখলে নতুন গজলে
বলতেন তিনি, বলতেন স্রেফ-
দয়িতা আমার তুমিতো আলেফ।

পাঁচ

আমার মননে ব্যাপ্ত বস্তুত ছিলেন
মহান লেনিন, বুদ্ধ, বনলতা সেন।

ছয়

এখানে রোজ বসি কিসের টানে?
শুক্‌নো পাতা, পাথর এবং কণ্টকিত বেড়ার ধারে
পাইনা খুঁজে বসে থাকার মানে।
চক্ষু বুজে দিই কাটিয়ে নিমেষগুলি।
কখন সূর্য ওঠে কিংবা কখন যে যায় অস্তপারে,
পাইনাকো টের, অঙ্গে ঝরে স্বপ্নধূলি।
দিগন্তের ঐ গভীর করুণ গানে
প্রাণ ডুবিয়ে আছি বসে জাগর অন্ধকারে
ট্রেন-না-থানা অচিন ইষ্টিশানে।

সাত

মনের ভেতর নিত্য জমে
কত কথকতা।
তোমার দিকে মুখ ফিরিয়ে
বলতে গেলাম কথা।

কিন্তু আমার কথকতার
হারিয়ে গেল খেই।
তোমার দিকে চোখ ফিরিয়ে
দেখি তুমি নেই।

আট

চঞ্চুতে গোলাপ গুঁজে, শাদা গম্বুজের ছায়া ছেড়ে নিরালায়
কে এক অঁচিন পাখি খুব একা উড়ে যায় সদর রাস্তায়।

নয়

সব কিছু আমি খুব কাছ থেকে দেখতে চেয়েছি
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে,
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে,
যেমন স্যাঁকরা দ্যাখে কোনো অলংকার।

এত কাছ থেকে
স্পষ্ট কিছু দেখা যায় কিনা,
তা’ নিয়ে চায়ের কাপে তর্কের তুফান;
বস্তুত দৃশ্যের চেয়ে অদৃশ্যই থেকে যায় বেশি।

তবু চোখ তীক্ষ্ম করে ঈগলের মতো
অথবা দর্জির মতো
দেখিছে অনেক কিছু বেশ কাছ থেকে বারংবার।
চৈত্রের দুপুরে কিংবা মাঘের সন্ধ্যায়
আমিতো দেখেছি তাকে গাঢ় অনুরাগে,
অথচ প্রকৃত দেখা হয় না কখনো।

দশ

এখন আমার হাতে ফুলের স্তবক নেই, নেই অনুপম
পাখির পালক,
তবু কী বিস্ময় নিয়ে চোখে আমারই হাতের দিকে চেয়ে থাকে
একটি বালক।
আমার চোখের জ্যোতি আগের মতন নেই আর, আমি ক্ষয়ে-
যাওয়া তরবারি,
তবুও অগাধ পানি নিয়ে চোখে আমাকেই দেখে বারংবার
একজন নারী।

এগারো

যখন তোমার দিকে বাগানের সবচে’ সুন্দর ফুলগুলি
এগিয়ে দিলাম, বিষপিঁপড়ে ভেবে তুমি
চকিতে সরিয়ে নিলে হাত;
নীরবে তাকিয়ে দেখি আভাময় ধূলি।
তোমার নরম ওষ্ঠে কিছু স্বর্গ শিশির ছড়াতে
চাইলাম, কালকূট ভেবে অকস্মাৎ
হে নারী সরিয়ে নিলে তুমি ঠোঁটের সুস্নিগ্ধ ভূমি
ভালোবাসাময় এই দীপান্বিতা রাতে।