সেতো আজকের নয়, বেশ ক’যুগ
আগেকার কথা; তখন আমি
কৈশোর আর যৌবনের মোহনায় দাঁড়ানো
পুরনো ঢাকার গলির এক বুড়ো সুড়ো বাড়িতে
আমরা থাকি। কোনও কোনও গোধূলিবেলায় অথবা
সন্ধ্যারাতে লম্বা বারান্দার এক কোণে একলা
বসে খানিক সময় যাপন করতাম। আমাকে
অমন দেখে বাবা অপ্রসন্ন হতেন, মনে হতো। তিনি
যখন জিগ্যেস করতেন, ‘কী করছিস তুই এখানে’, হতচকিত আমি
বোবা হয়ে থাকতাম, যেন হাতে-নাতে-নাতে ধরা-পড়া চোর।
না, আমি বাবার পকেট থেকে টাকাকড়ি
সরাইনি কখনও, মায়ের হাত বাক্সেও করিনি হামলা। নিশ্চুপ
বারান্দার নির্জন কোণে বসে আকাশ কুসুম ভাবতাম,
চুরি করতাম, গোওধূলিবেলার রঙ, সেসব
পাখির উড়াল, যাদের ডানায় নীড়ে ফেরার ব্যাকুলতা,
হাল্কা হাওয়ার রেশমি আরাম আর সন্ধ্যাতারার আলো।
বাবার নারাজ মুখ দেখে নিরুত্তর আমি
বারান্দায় নির্জনতা ছেড়ে চলে যেতাম
আরেক নির্জনতায়, যেখান থেকে অন্তহীন টানেলে
অথবা জটিল অরণ্যে প্রবেশ করে হরিণীর চোখের কোমলতা
বুনো গাছের শিহরণ আর জ্যোৎস্নার ঘ্রাণ
লুট করলে কেউ আমাকে পাকড়াও করবে না
কোন অছিলায়, যেখানে অসীম নিঃসঙ্গতা সখীকে
বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকব।
এখন এতকাল পরে, যখন সময়
তার মুঠোয় আমার চুল ধরে টেনে নিচ্ছে বার্ধক্যের
দোরগোড়ায়, আমি নির্দ্ধিধায় একলা
বসে থাকতে পারি ইচ্ছে মতো আমার বারান্দায়। আজ আমাকে
কেউ প্রশ্ন করতে আসবে না কেন আমি
এভাবে বড় একা নীরবতায় এলিয়ে রয়েছি।
আজকাল নিঃসঙ্গতা বড়ই বিপন্ন করে তুলছে;
যখন ঘরে নিঃসঙ্গ বসে থাকি,
দুর্ভাবনা সন্ত্রাসীর মতো অস্ত্র চেপে ধরে আমার
স্পন্দিত বুকে, ক’জন মুখোশধারী
আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ভাগাড়ে,
গলায় কাটা মুণ্ডের মালা ঝুলিয়ে
এক পাষণ্ড আমার মুখে লাথি মারছে ক্রমাগত।
অথচ এই মুহূর্তে কেউ এসে আমাকে
জিগ্যেস করছে না, এই অন্ধকার ঘরে
একা-একা কী করছিস তুই? মরহুম আব্বার মুখে
ক’যুগ আগের সেই অবাক-করা প্রশ্ন শোনার জন্যে
আজ আমি বড়ই ব্যাকুল, তৃষিত আর অর্থসন্ধানী হয়ে আছি।