‘ঘুমিয়েছিলাম ঘরে গোধূলিবেলায়, ঘুম ভেঙে গেলে দেখি
তিনটি দোয়েল আর তিনটি পাপিয়া
নেচে নেচে ঢুকে পড়ে আমার নিঝুম করোটিতে,
আমার পায়ের তলা ফুঁড়ে বনতুলসীর ঝাড়
নিমেষে গজায়, চণ্ডীদাস রাজহাঁস বুকে চেপে
টেবিলের ওপরে বসেন। ওষ্ঠে তার
কী এক দ্যুতির আসা-যাওয়া; পুরনো দেয়াল থেকে
বেরিয়ে আসেন ভবভূতি
পাণ্ডুলিপি হাতে, চোখে থেকে
ঘুমের কুয়াশা ঝেড়ে অসামান্য অতিথিদ্বয়ের জন্যে দ্রুত
চা করে আনার কথা ভেবে ছুটে যাই
এবং আমার ঘর অকস্মাৎ ঐরাবত হয়ে মেঘলোকে
উড়ে যায়’-এইটুকু লিখে তার নিজের খাতায়
দেয়ালের দিকে চোখ রেখে ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
০২
মলিন ধূসর কবি হেঁটে যেতে যেতে দেখে, ভাবে কী সহজে
অসঙ্কোচে গোল চাঁদ ছায়া ফেলে অসুস্থ ডোবায়
চিরকাল। আহার করেনি কবি দ্বিপ্রহরে, কেবল বিকেল
চা খানায় গলা ভিজিয়েছি। পকেটে পয়সা নয়, কতিপয়
উপমা, মিলের ঝলকানি, চিত্রকল্প নড়ে চড়ে। নিঃসঙ্গ সে
বসে পড়ে ডোবার কিনারে, দেখে জ্যোৎস্নার জোয়ারে
ডোবায় অখ্যাত শোক হয়ে আট্কে আছে
যুবতীর লাশ; এই ছবি
সে হয়তো প্রগাঢ় তুলে নেবে ভিন্ন রূপে তার কবিতায়। তদন্তের
শরীরে দিনের পর দিন শ্যাওলা জমবে যথারীতি।
০৩
কখনও-সখনও লোকটার মনে পড়ে তার মা’র
কবরের কথা, মনে পড়ে যায় কোনও এক বিকেলবেলায়
মা’র কবরের পাশে বসেছিল একা;
দেখেছিল কয়েকটি প্রজাপতি কবরকে হাল্কা চুমো খেয়ে
উড়ে যায় কোন্ অজানায়।
মানুষের শরীরের রূপান্তর তার ভাবনাকে
কেমন ঘোলাটে করে। শরীর একদা সুশ্রী ছিল
মার আর এখন তা বিশীর্ণ কঙ্কাল
এবং মাটির নিচে প্রজাপতি অথবা গোলাপ কিছু নেই,
যা আছে সে-কথা ভাবলেও, হায়, আপন কঙ্কাল কেঁপে ওঠে।
০৪
তার কিছু কিছু কথা লোকে জানে, জানে না সকল
কথা কেউ। লোকটা সহজ, স্বাভাবিক, তবু কিছু
অন্তর্গত ক্ষ্যাপামি রয়েছে। তাকে পথে একা হেঁটে
যেতে দেখা যায়, মাঝেমাঝে পার্কের বেঞ্চিতে বসে চুপচাপ
কী-যে ভাবে, হয়তো কিছু শব্দ তাকে ঠোকরাতে থাকে
চঞ্চল মাছের মতো। তার সঙ্গে প্রায়শ টেবিলে
মুখোমুখি বসে স্তব্ধ গোধূলিতে চা খায় বিষাদ।
বুকে তার একটি অচিন ফুল ফুটে আছে, অনেকের চোখে
পড়ে; আসলে তা ফুল নয়, ক্ষত। শোণিত-বুদ্বুদে
কেমন উথলে ওঠে শব্দরাজি, নবীন প্রতীক। মাঝে মাঝে
ধুলোবালি ঢেকে রাখে তাকে,
কখনও-কখনও আসমানে সে আসীন এক উড়ন্ত ময়ূর-সিংহাসনে।