গোলাপ সুন্দরী – ০৮
বিলাস এখন আপনার ঘরে জানালা খুলিয়া দাঁড়াইয়াছিল। এমত সময়, প্রবল মেঘ-ঘর্ষণ শুনিল ; সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিল যেটুকু আলো ছিল তাহাও নাই এবং কে যেন ত্রাসে ভয়ে এইমাত্র দ্রুত পদক্ষেপে যাওয়া-আসা করিতেছে । যে দরজাকে সে একদা ভয় করিয়াছে সেই দরজার দুই পাশ ধরিয়া দাঁড়াইল । বুঝিল মনিক এই অন্ধকারে ঘুরিয়া বিভ্রান্ত হইতেছেন, আর যে তিনি ভীত কণ্ঠে কহিলেন “আলো নিভে গেছে” । বিলাস এ কথায় এক মুহূৰ্ত্ত দেরী করিল না, দেশলাই খুঁজিতে লাগিল । আঁধারে আর এক নিদ্রিত অবস্থা, অন্ধের মত হস্তদ্বারা সমস্ত বস্তু স্পর্শ করিতে করিতে চলিয়াছে, অনেক দূর, না অনেক সময়ের পারে সে গিয়াছে, ইতিমধ্যে একবার মনে হইল মনিকও দেশলাই খুঁজিতেছেন। এইভাবে খুঁজিতে খুঁজিতে যে হাতে বিলাসের একদা কাঁটা ফুটিয়াছিল, যে হাতে গ্রন্থ ধরিয়া শ্লোক পাঠ করে, সেই নিমিত্তমাত্র হাতে, উষ্ণতার স্পর্শ লাগিল মানবীর দেহ অথবা নিশ্বাস। বাষ্পসম্ভূত মেঘ, মেঘ উৎপন্ন আলোকে…ভাস্কর্য্যের বিপুলতা বিলাস দেখিল । এইটুকু দেখা লইয়া তাহার মনে হয় যে ঘুম ভাল ।
“আমাকে ছেড়ে যেও না. আমি ভীত” এবং ইহার পর মাথা নত করিয়া মনিক বলিতে চাহিয়াছিলেন যে শুদ্ধ বস্ত্র পরিবর্ত্তনকালে আলো নিভিয়া যায় ফলে…।
মনিকের কথার উত্তরে বিলাস গভীর কণ্ঠে বলিল “গোলাপ সুন্দরী” এ কথা সত্যই অনুক্ত ছিল, সে কেবল মাত্র তাহার দিকে চাহিয়াছিল । পুনরায় মনিকের কণ্ঠস্বর “গোলাপের মধ্যে আমারই ক্ৰন্দন…যে কান্না আমি বহুকাল ধরে কাঁদছি । তোমাকে আমি…”
ইহার পর—মুহুর্ত্তের জন্য দুজনকে পরাজিত করিবার চেষ্টা করিল, একে অন্যের দেহের সুমধুর আনন্দধারা নিঃশেষ করিয়া শুষিয়া লইতে চাহিল । সহসা অশরীরী বজ্রাঘাতে দুইজনেই বিক্ষিপ্ত হয়। সহসা যেমত পাখী ডাকিয়া উঠিল, লজ্জা আসিল । বিলাসচকিতে উঠয়া শায়িতা বিপুল রমণীকে দেখিয়া যেন শিহরিয়া উঠিল । সত্বর সে কক্ষ ত্যাগ করে। হলে আসিয়া যেখানে সে হাত রাখিল সেখানেই দেশলাই ছিল, বাতি জ্বালিয়া সে মাথায় হাত দিয়া বসিয়াছে। এমত সময় তিনি, মনিক, এই আলোতে আসিয়া এমন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চাহিলেন যাহার অর্থ “আমি কি অপূৰ্ব্ব সুন্দরী নই, গোলাপ সুন্দরী নই” মনিক পুনরায় তাঁহার হাত ধরিল, বিলাস আপনার কথা স্মরণ করিয়া তাহার দিকে লক্ষ্য করিল, নিরাভরণ দেহের সমস্ত রোমকূপ দিয়া মহা উল্লাস নিঃস্থত হইতেছে।
বিলাস যেন কহিল “বেশ, এখানে দাঁড়ান” বলিয়া সে তাঁহাকে মৰ্ম্মর মূৰ্ত্তির ভঙ্গিমায় দাঁড় করাইয়া ড্রয়ার খুলিয়া মোহিতদার জন্য রক্ষিত সিগারেটের টিন কাটিয়া, সিগারেট ধরাইয়া, অনিমেষ নেত্রে তাঁহাকে যেমন বা অনুসন্ধান করিতে লাগিল । মনিক আপনার পদদ্বয় ঈষৎ বিভক্ত করিয়া তুই হস্তে সমস্ত কেশরাশি ধরিয়া স্থির। সিগারেট ফেলিয়া ঝটিতি বিলাস তড়িৎ বেগে তাঁহার নিকটে গিয়া একটি নিশ্বাস ফেলিল । তাহার স্পর্শে মৰ্ম্মর মূৰ্ত্তিও রক্তমাসের দেহ পরিগ্রহ করিল। মনিক অদ্ভুতভাবে হাসিলেন।
* * *
“এখন ঘুমান যাক”
“পৃথিবীতে কি ঘুম আছে”
বিলাস এই জাড্যবিজড়িত উক্তিতে বিছানায় উঠিয়া বসিল—বহুদিন পূৰ্ব্বে যে এপিটাপ তাহার— স্কাঁরোর লিখিত-—মুখস্থ ছিল যাহা সে ভুলিয়াছিল তাহা স্মরণে দ্বিপ্রহরের চেতনা হইতে রাত্রের চেতনা পারবারের মধ্যে জাগিয়াছিল—আসিল “পথিক শব্দ করিও না কারণ এই প্রথম রাত্রে স্কাঁরো ঘুমায়” ।
“ওঠো” মনিক কহিলেন ।
‘হল-ঘরে’ বলিয়া শ্লথপদে ক্লান্ত বিলাস তাহাকে অনুসরণ করিল।
দুজনে এখানে আসিয়া স্তম্ভিত ; বিলাস সম্পূর্ণ শান্ত, গতিরহিত—কিন্তু বিলাস অত্যন্ত আধুনিক, একটু পোর্ট ঢালিয়া, সিগারেট ধরাইল, এবং মনিককে নিরীক্ষণ করিতে করিতে সিগারেটটি তাহার হাতে দিয়া কহিল “প্লিস আমার দিকে চাও… মানে তাদের মত করে অর্থাৎ… ”
মনিকের নিকট হইতে যাহা সে আশা করিয়াছিল, অর্থাৎ বেশ্যার মত তাহাকে প্রলুব্ধ করিবে তাহা শতগুণ সে পাইল, মনিক আশ্চর্য্যভাবে সিগারেট ধরিয়া এক মহার্ঘ্য আবেশে আপনাকে পূর্ণ করিলেন, এখন স্তন বহিয়া সিগারেটের নীল ধোঁয়া ছত্রাকার হয়…কেমন একভাবে মনিক—যিনি সুন্দরী সুলক্ষণা—আপনার জঙ্ঘায় জঙ্ঘায় সশব্দ আঘাত করিলেন যে অধুনা ধর্ষিত পৃথিবীর মেরু পর্যন্ত কম্পিত হয়, আর যে তাঁহার সুরম্য ঊরু যুগকে আশ্রয় করিয়া আলো উঠা নামা করে ।
ক্লান্ত বিলাসও অস্থির ।