ঋগ্বেদ ১০।০৪০
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ১০ম মণ্ডল সূক্ত ৪০
অশ্বিদ্বয় দেবতা। ঘোষা ঋষি(১)।
১। হে কৰ্ম্মসমূহের উপদেশকারী অশ্বিদ্বয়! তোমাদিগের প্রকাণ্ড রথ যখন প্রাতঃকালে গমন করে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট ধন বহন করিয়া লইয়া যায়, তখন সেই সমুজ্জ্বল রথকে কোন যজমান আপনার যজ্ঞের সাফল্য সম্পাদন করিবার জন্য স্তব করে? তোমাদিগের সেই রথ কোথায় যায়?।
২। হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা দিবাভাগে, কি রাত্রিকালে কোথায় গতিবিধি কর? কোথায় বা কালযাপন কর? যেরূপ বিধবা রমণী শয়নকালে দেবরকে সমাদর করে (২), অথবা কামিনী নিজ কান্তকে সমাদর করে, যজ্ঞস্থলে তদ্রুপ সমাদরের সহিত কে তোমাদিগকে আহ্বান করে?।
৩। তোমরা যেন বৃদ্ধ দুই রাজার তুল্য, তোমাদিগের নিদ্রাভঙ্গের জন্য যেন প্রাতঃকালে স্তুতি পাঠ করা হইয়াছে। প্রতিদিন তোমরা যজ্ঞ পাইবার জন্য কাহার ভবনে যাইয়া থাক? কাহার পাপ ধবংস করিয়া থাক? হে কর্মে উপদেশকারীদ্বয়! কাহার যজ্ঞে দুটী রাজ পুত্রের ন্যায় যাইয়া থাক?
৪। যেরূপ ব্যাধেরা বৃহৎ বৃহৎ মৃগদিগকে(৩) বাঞ্ছা করে, তদ্রূপ তোমাদিগকে আমি দিন রাত্রি যজ্ঞের দ্রব্য লইয়া আহ্বান করিতেছি। হে উপদেশকারীদ্বয়! কালে কালে তোমাদিগের উদ্দেশে লোকে হোম করিয়া থাকে,তোমরাও লোকদিগের নিকট অন্ন বহন করিয়া লইয়া যাও, কারণ তোমরা তাবৎ কল্যাণের অধিপতি।
৫। হে অশ্বিদ্বয়! হে উপদেশকারীদ্বয়! আমি রাজকন্যা ঘোষা, আমি চতুর্দিকে গমন পূর্বক তোমাদিগের কথাই কহি, তোমাদিগের বিষয়ই জিজ্ঞাসা করি। কি দিন, কি রাত্রি আমার নিকট তোমরা অবস্থিতি কর, রথারূঢ় ও ঘোটকসম্পন্ন আমার যে ভ্রাতুষ্পুত্র তাহাকে দমন করিয়া রাখ।
৬। হে কবিদ্বয়! তোমরা রথের উপর আরোহণ করিয়াছ। হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা কুৎসের ন্যায় রথে আরোহণ পূর্বক স্তবকারী ব্যক্তির ভবনে গমন কর, তোমাদিগের যে মধু আছে, তাহা এত প্রচুর যে মক্ষিকাগণ মুখে গ্রহণ করিতে থাকে। যেরূপ কোন নারী ব্যভিচারে রত হয় (৪), তদ্রূপ মক্ষিকাগণ তোমাদিগের মধু গ্রহণ করে।
৭। হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা ভুজ্যু নামক ব্যক্তিকে সমুদ্র হইতে উদ্ধার করিয়াছিলে, তোমরা বশ নামক রাজাকে এবং অত্রিকে এবং উশনাকে উদ্ধার করিয়াছিলে। যে ব্যক্তি দাতা, সেই তোমাদিগের বন্ধুত্ব প্রাপ্ত হয়,তোমাদিগের আশ্রয়ে যে সুখ প্রাপ্ত হওয়া যায়, আমি তাহাই কামনা করি।
৮। হে অশ্বিদ্বয়! তোমরাই কৃশ নামক ব্যক্তি এবং শ্বৈয়ুব এবং তোমাদিগের পরিচর্যাকারী ব্যক্তি এবং বিধবাকে রক্ষা করিয়াছিলে। তোমরাই যজ্ঞকর্তা ব্যক্তিদিগের নিমিত্ত মেঘ বিদীর্ণ করিয়া দাও, তখন সেই মেঘ শব্দ করিতে করিতে সাত মুখ উদঘাটন পূর্বক বৃষ্টি বর্ষণ করে।
৯। আমি ঘোষা, আমি নারীলক্ষণ প্রাপ্ত হইয়া সৌভাগ্যবতী হইয়াছি, আমাকে বিবাহ করিবার নিমিত্ত বর আসিয়াছে। তোমরা বৃষ্টিবর্ষণ করাতে, তাঁহার জন্য শস্যাদি উৎপন্ন হইয়াছে। নদীগণ নিম্নাভিমুখ হইয়া ইহার দিকে প্রবাহিত হইতেছে। ইনি রোগশূন্য, ঐ সকল সুখভোগ করিবার উপযুক্ত সামর্থ ইহার জন্মিয়াছে।
১০। হে অশ্বিদ্বয়! যে সকল ব্যক্তি আপন বনিতার প্রাণ রক্ষার জন্য রোদন পর্যন্ত করে, বনিতাদিগকে যজ্ঞকার্যে নিযুক্ত করে, তাহাদিগকে সুদীর্ঘকাল নিজ বাহুদ্বারা আলিঙ্গন করে এবং সন্তান উৎপাদনপূর্বক পিতৃলোকের যজ্ঞ করিতে নিযুক্ত করে, সেই সমস্ত বনিতাগণ পতির আলিঙ্গনে সুখী হয়।
১১। হে অশ্বিদ্বয়! তাহাদিগের সেই সুখ আমি অবগত নহি। তোমরা সেই সুখের বিষয় উত্তমরূপে বর্ণনা কর, অর্থাৎ যুবাস্বামী ও যুবতীস্ত্রীর পরস্পর সহবাসে কি প্রকার সুখ হয়, তাহা আমাকে বুঝাইয়া দাও। হে অশ্বিদ্বয়! স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত বলিষ্ঠ স্বামির গৃহে গমন করি, ইহাই আমার কামনা।
১২। হে অন্নসম্পন্ন, ধনসম্পন্ন অশ্বিদ্বয়! তোমরা উভয়ে আমার প্রতি সদয় হও, আমার মনের অভিলাষ সমস্ত পূর্ণ হউক। তোমরা উভয়ে কল্যাণ বিধানকর্তা, অতএব আমার রক্ষকস্বরূপ হও। আমরা যেন পতিগৃহে গমন পূৰ্ব্বক পতির প্রিয়পাত্র হই।
১৩। আমি তোমাদিগকে স্তব করিয়া থাকি, অতএব তোমরা আমার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া আমার পতির ভবনে ধনবল ও লোকবল বিধান কর। হে কল্যাণকর বিধাতাদ্বয়! আমি যে তীর্থে জল পান করি, তাহা সুবিধাযুক্ত করিয়া দাও। আমার পতিগৃহে যাইবার পথে যদি কোন দুষ্টাশয় বিঘ্ন করে, তবে তাহাকে বিনাশ কর।
১৪। হে প্রিয়দর্শন অশ্বিদ্বয়! হে কল্যাণকর বিধাতদ্বয়! অদ্য তোমরা কোথায়? কোন ব্যক্তির ভবনে আমোদ আহ্লাদ করিতেছ? কে তোমাদিগকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে? কোন বুদ্ধিমান যজমানের গৃহে তোমরা গমন করিয়াছ?
————
(১) কক্ষীবান ঋষির কন্যা ঘোষা কুষ্ঠরোগগ্রস্থা হওয়ায়, তাঁহার বিবাহ হয় নাই, পরে অশ্বিদ্বয় তাঁহার রোগ ভাল করিয়া দিলে, তিনি পতিলাভ করেন, তাহা ১।১১।৭ ঋকের টিকায় বলা হইয়াছে, সেই ঘোষা এই সূক্তের ঋষি। (ঘোষা নামে প্রকৃত কোন নারী ছিলেন কি না সন্দেহ, ঘোষাকর্তৃক এ সূক্ত রচিত, তাহা বোধ হয় না, তাঁহার গল্প অবলম্বন করিয়া এবং অশ্বিদিগের সম্বন্ধে অন্যান্য গল্প অবলম্বন করিয়া এই সূক্ত রচিত হইয়াছে, সুতরাং ঘোষারই নাম এই সূক্তের ঋষিস্থলে সন্নিবেশিত হইয়াছে।) ১।১১২ ও ১।১১৭ সূক্তের টীকায় অশ্বিদিগের সম্বন্ধে অনেকগুলি গল্প বিবৃত হইয়াছে, সেগুলি পুনরায় এখানে বিবরণ করিবার আবশ্যকতা নাই।
(২) এতদ্বারা বোধ হয়, বিধবার অসচ্চরিত্র অবলম্বন করা প্রকটিত হইতেছে না, স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্বামীর ভ্রাতাকে বিবাহ করিবার প্রথাই এই ঋকে উল্লিখিত হইতেছে । মনু ৯।৬৯ ও ৭০ দেখ। পণ্ডিতবর Roth এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। Illustrations of the Nirukta, p. 32.
(৩) মূলে “মৃগাবারণা” আছে। ইহার অর্থ কি হস্তী? ব্যাধগণ কি হস্তী ধরিত?।
(৪) মূলে “নিষ্কৃতং ন ঘোষণা” আছে। এই মণ্ডলের ৩৪।৫ ঋকের টীকা দেখ।