ঋগ্বেদ ১০।০৩৪
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ১০ম মণ্ডল সূক্ত ৩৪
অক্ষ (অর্থাৎ খেলিবার পাশা) ও দ্যুতকার দেবতা(১)। কবষ ঋষি।
১। বড় বড় পাশাগুলি যখন ছকের উপর ইতস্থত সঞ্চালিত হয়, দেখিয়া আমার বড়ই আনন্দ হয়। মূজবান্ নামক পৰ্বতে যে চমৎকার সোমলতা জন্মে(২), তাহার রস পান করিতে যেমন প্রীতি জন্মে, বিভিতককাষ্ঠনির্মিত অক্ষ আমার পক্ষে তেমনি প্রীতিকর ও তদ্রুপ আমাকে উৎসাহিত করে।
২। আমার এই রূপবতী পত্নী কখন আমার প্রতি বিরাগ প্রদর্শন করে নাই, কখন আর নিকট লজ্জিত হয় নাই। সেই পত্নী আমার নিজের ও আমার বন্ধুবর্গের বিশেষ সেবাশুশ্রষা করিত। কিন্ত কেবল মাত্র পাশার অনুরোধে আমি সেই পরম অনুরাগিণী ভার্য্যাকে ত্যাগ করিলাম।
৩। যে ব্যক্তি পাশক্রীড়া করে, তাহার শ্বশ্রূ তাহার উপর বিরক্ত, স্ত্রী তাহাকে ত্যাগ করে, যদি কাহারও কাছে কিছু যাচ্ঞা করে, দিবার লোক কেহ নাই। যেরূপ বৃদ্ধ ঘোটককে কেহ মূল্য দিয়া ক্রয় করে না, সেইরূপ দ্যূতকার কাহারও নিকট সমাদর পায় না।
৪। পাশার আকর্ষণ বিষম কঠিন, সব কাহারো ধনের প্রতি পাশার লোভ দৃষ্টি পতিত হয়, তাহা হইলে উহার পত্নীকে অন্যে স্পর্শ করে (৩)। তার পিতা, মাতা, ভ্রাতাগণ তাহাকে দেখিয়া কহে আমরা ইহাকে চনি, ইহাকে বাধিয়া লইয়া যাও।
৫। আমি যখন মনে ভাবি, আর এই পাশাখেলা করব না, তখন খেলার সঙ্গীদিগকে দেখিলে তাহাদিগের নিকট হইতে সরিয়া যাই। কিন্তু পাশাগুলি সুন্দর পিঙ্গলমূর্তিতে ছকের উপর বসিয়া আছে দেখিয়া আর থাকতে পারি না। যেরূপ ভ্ৰষ্টানারী উপপতির নিকট গমন করে (৪), আমিও তদ্রূপ খেলার সঙ্গী দিগের ভবনে গমন করি।
৬। দযূতকার আপনার বুক ফুলাইয়া আস্ফালন করিতে করিতে ক্রীড়া সভায় আসে, কহে, আমি জিতিব। পাশা গুলি কখন ইহার অভিলাষ পূর্ণ করে; সে বিপক্ষ দ্যূতকারের প্রতি যাহা কিছু অভিপ্রায় করে, সকলি কখন সিদ্ধ হইয়া যায়।
৭। কিন্তু কখন সেই পাশা যেন অঙ্কুশযুক্ত, অর্থাৎ যেন আকুশিদ্বারা আকর্ষণ করিতে থাকে, তাহারা যেন বাণের ন্যায় বিদ্ধ করিতে, ছুরিকার ন্যায় কৰ্ত্তন করিতে এবং তপ্ত বস্তুর ন্যায় সন্তাপ দিতে থাকে। যে জয়ী হয়, তাহার পক্ষে পাশা গুলি যেন পুত্রজন্মের তুল্য, যেন মধুময়, যেন তাহাকে মিষ্টবাক্যে সম্ভাষণ করে, আর পরাজিত ব্যক্তিকে তাহারা যেন নিধন করে।
৮। এই যে তিপ্পান্নটী পাশার দল দেখিতেছ, ইহারা মিলিত হইয়া ছকের উপর বিহার করিয়া বেড়ায়, যেমন সত্যস্বরূপ সূর্যদেব বিশ্বভুবনে বিহার করেন। যিনি যত বড় দুর্ধর্ষ হউন, ইহারা কাহারও বশীভূত নয়। রাজা পৰ্যন্ত ইহা দিগকে নমস্কার করে।
৯। ইহারা কখন নীচে নামিতেছে, কখন উপরে উঠিতেছে। ইহাদিগের হাত নাই, কিন্তু যার হাত আছে, সে ইহাদিগের নিকট পরাজয় স্বীকার করে। ইহারা দেখিতে শ্ৰীযুক্ত, জলন্ত অঙ্গারের ন্যায় ছকের উপর বসিয়াআছে। স্পর্শ করিতে শীতল, কিন্তু হৃদয়কে দগ্ধ করে।
১০। দ্যূতকারের স্ত্রী দীনহীনবেশে পরিতাপ করে। পুত্র কোথায় বেড়াইতেছে, ভাবিয়া তাহার মাতা ব্যাকুল। যে তাহাকে ধার দেয়, সে আপন ধন ফিরিয়া পাইব কি না এই ভাবিয়া সশঙ্কিত। দ্যূতকারকে পরের বাটীতে রাজি যাপন করিতে হয়।
১১। আপনার স্ত্রীর দশা দেখিয়া দ্যূতকারের হৃদয় বিদীর্ণ হয়, অন্যান্য ব্যক্তির স্ত্রীর সৌভাগ্য ও সুন্দর অট্টালিকা দেখিয়া তাহার পরিতাপ হয়। সে হয়ত প্রাতে সুশ্রী ঘোটক যোজনাপূৰ্ব্বক গতিবিধি করিয়াছে, কিন্তু সন্ধ্যার সময় নীচলোকের ন্যায় তাহাকে শীত নিবারণের জন্য অগ্নি সেবা করিতে হয়।
১২। হে পাশাগণ! যে তোমাদিগের দলের মধ্যে প্রধান ও সেনাপতি ও রাজার তুল্য, আম তাঁহার প্রতি আমার এই দশ অঙ্গুলি একত্র করিয়া প্রণাম করিতেছি, আমি তোমাদিগের নিকট অর্থ চাহি না, ইহা সত্য করিয়া কহিতেছি।
১৩। হে দ্যুতকার! পাশা কখন খেলিও না, বরং কৃষিকাৰ্য্য কর(৫)। তাহাতে যাহা লাভ হয়, সেই লাভে সন্তুষ্ট হও ও আপনাকে কৃতার্থ বোধ কর। তাহাতে পত্নী পাইবে ও অনেক গাভী পাইবে। এই যে প্রভু সূৰ্য্যদেব, ইনি আমাকে ইহা বলিয়া দিয়াছেন।
১৪। হে পাশাগণ! আমাদিগের উপর বন্ধুত্বভ’ব ধারণ কর, আমাদিগের কল্যাণ কর। তোমাদিগের দুর্ধর্ষ প্রভাব আমাদিগের প্রতি প্রয়োগ করিও না। আমাদিগের শত্রুই যেন তোমাদিগের কোপ দৃষ্টিতে পতিত হয়। অপরে যেন তোমাদিগকে ব্যবহার করিতে ব্যাপৃত থাকে।
————
(১) এই সূক্তে পাশা খেলার অলঙ্ঘনীয় ইচ্ছা এবং ভয়ানক ফল সুন্দররূপে বর্ণিত হইয়াছে।
(২) মৃজবান্ নামক পর্বতে সোমলতা জন্মে।
(৩) অর্থাৎ পত্নী ব্যভিচারিণী হয়।
(৪) মূলে “নিস্কৃতিং জারিণী ইব” আছে।
(৫) মূলে এই আছে “অক্ষৈঃ মা দীব্যঃ কৃষিং ইৎ কৃষম্ব।“