ঋগ্বেদ ১০।০১৮

ঋগ্বেদ ১০।০১৮
ঋগ্বেদ সংহিতা।। ১০ম মণ্ডল।। সূক্ত ১৮
মৃত্যু, ধাতা, ত্বষ্টা, অগ্নিসংস্কার ইহারা দেবতা। সংকুসুক ঋষি।

১। হে মৃত্যু! তুমি আর এক পথে ফিরিয়া যাও, দেশলাকে যাইবার যে পথ, তাহা ত্যাগ করিয়া অন্য পথে যাও। তোমার চক্ষু আছে, তুমি শুনিতে পাও, সেই নিমিত্ত তোমাকে কহিতেছি। আমাদিগের সন্তানসন্ততি, বা লোক জনকে হিংসা করিও না।

২। তোমরা মৃত্যুর পথ ছাড়িয়া যাও, তাহা হইলে উৎকৃষ্ট ও অতিদীর্ঘ আয়ুঃ প্রাপ্ত হইবে; মোদিগের গৃহ, সন্তানসন্ততি ও ধনে পরিপূর্ণ হইবে; তোমরা শুদ্ধ ও পবিত্র ও যজ্ঞানুষ্ঠানকারী হও।

৩। এই সকল ব্যক্তি জীবিত আছে, ইহারা মৃতদিগের নিকট প্রত্যাগমন করিয়াছে, আমাদিগের যজ্ঞ অদ্য কল্যাণকর হইয়াছে। আমরা প্রকৃষ্টরূপে নৃত্য ও হাস্য করিতে থাকি, আমরা উৎকৃষ্ট ও অতিদীর্ঘ আয়ু প্রাপ্ত হইয়াছি।

৪। যাহারা জীবিত আছে, তাঁহাদিগের চতুর্দিকে এই বেষ্টন দিতেছি, ইহাতে মৃত্যুকে রোধ করা হইবে। ইহাদিগের মধ্যে আর কেহ যেন এই অবস্থা অর্থাৎ মৃত্যু প্রাপ্ত না হয়। ইহার শত বৎসর জীবত থাকুক। মৃত্যু যেন এই পর্বতের দ্বারা রুদ্ধ হইয়া নিকটে না আসিতে পারে।

৫। যেরূপ পরে পরে দিন সকল যায়, যেরূপ ঋতুর পর অবাধে চলিয়া যায়, যেমন যে শেষে আসিয়াছে, সে অগ্রে মরে না। হে বিধাতঃ! ইহাদিগের আয়ু এইরূপ কর।

৬। তোমরা জরাদ্বারা আচ্ছন্ন হও, দীর্ঘপরমায়ুর উপর আরোহণ কর। জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠের নিয়মে অগ্র পশ্চাৎ হইয়া কৰ্ম্মকাৰ্য সম্পন্ন কর। এই স্থানে সুজন্মা ত্বষ্টাদেব তোমাদিগের সহিত একত্র হইয়া তোমাদিগের দীর্ঘ আয়ু করিয়া দিতেছেন, তাহা হইলেই তোমরা জীবিত থাকিবে।

৭। এই সকল নারী বৈধব্য দুঃখ অনুভব না করিয়া, মনোমত পতি লাভ করিয়া অঞ্জন ও ঘৃতের সহিত গৃহে প্রবেশ করুন। এই সকল বধূ অশ্রুপাত না করিয়া, রোগে কাতর না হইয়া উত্তম উত্তম রত্ন ধারণ করিয়া সর্বাগ্রে গৃহে আগমন করুন (১)।

৮। হে নারি! সংসারের দিকে ফিরিয়া চল, গাত্রেত্থান কর, তুমি যাহার নিকট শয়ন করিতে যাইতেছ, সে গত অর্থাৎ মৃত হইয়াছে। চলিয়া এস। যিনি তোমার পাণিগ্ৰহণ করিয়া গর্ভাধান করিয়াছিলেন, সেই পতির পত্নী হইয়া যাহা কিছু কর্তব্য ছিল, সকলি তোমার করা হইয়াছে (২)।

৯। মৃত ব্যক্তির হস্ত হইতে ধনু গ্রহণ করিলাম, ইহাতে আমাদিগের তেজঃ ও বল লাভ হইবে। হে মৃত! তুমি এই স্থানেই অর্থাৎ শ্মশানে থাক, আমরা অনেক বীরপুরুষের সহিত একত্র হইয়া যাবতীয় আস্পর্ধাকারী শত্রুকে যেন জয় করিতে পারি।

১০। হে মৃত! এই জননীস্বরূপা বিস্তীর্ণা পৃথিবীর নিকটে গমন কর, ইনি সৰ্বব্যাপিনী, ইঁহার আকৃতি সুন্দর। ইনি যুবতী স্ত্রীর ন্যায় তোমার পক্ষে যেন রাশীকৃত মেঘলোমের মত কোমল স্পর্শ হয়েন। তুমি দক্ষিণা দান অর্থাৎ যজ্ঞ করিয়াছ, ইনি যেন নিঋতি হইতে তোমাকে রক্ষা করেন।

১১। হে পৃথিবি! তুমি এই মৃতকে উন্নত করিয়া রাখ, ইঁহাকে পীড়া দিও না। ইহাকে উত্তম উত্তম সামগ্রী, উত্তম উত্তম প্রলোভন দাও। যেরূপ মাতা আপন অঞ্চলের দ্বারা পুত্রকে আচ্ছাদন করেন, তদ্রূপ তুমি ইহাকে আচ্ছাদন কর।

১২। পৃথিবী উপরে স্তূপাকার হইয়া উত্তমরূপে অবস্থিতি করুন। সহ ধূলি এই মৃতের উপর অবস্থিতি করুক। তাহারা ইহার পক্ষে পূর্ণ গৃহ স্বরূপ হউক, প্রতিদিন এই স্থানে তাহারা ইহার আশ্রয় স্থানস্বরূপ হউক (৩)।

১৩। তোমার উপর পৃথিবীকে উত্তম্ভিত করিয়া রাখিতেছি। তোমার উপরে এই একটী লোষ্ট্র অৰ্পণ করিতেছি, তাহাতে মৃত্তিকা, তোমার মধ্যে প্রবেশ করিয়া তোমাকে নষ্ট করিতে পারিবে না। এই স্থূনা অর্থাৎ খুটীকে পিতৃলোকগণ ধারণ করুন। যম এই স্থানে তোমার বাসস্থান নিরূপণ করিয়া দিন।

১৪। যেমন বাণের উপর পর্ণ বক্রভাবে সংস্থাপন করে, তদ্রূপ আমি এই বক্র অর্থাৎ ক্লেশকর দিবসে অর্পিত হইলাম। যেরূপ ঘোটককে রশ্মিদ্বারা রুদ্ধ করে, তদ্রূপ আমি দুঃখের বাক্য রোধ করিয়া রাখিলাম।

———

(১) মুলে এই ঋকের শেষে এই শব্দ গুলি আছে, “আরো হন্তু জনয়ঃ যোনিং অগ্রে।“ শেষ শব্দটীর একটা বিস্ময়কর ইতিহাস আছে। ঋগ্বেদে সতীদাহের উল্লেখ নাই। কিন্তু অগ্রে শব্দের পরিবর্তে “গেঃ” শব্দ পাঠ করিয়া আধুনিক পণ্ডিতগণ সতীদাহ প্রথা বেদসম্মত, এইরূপ বিবেচনা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের ভ্রম এখন সংশোধিত হইয়াছে।

২) ইহা মৃত ব্যক্তির বিধবার প্রতি শ্মশানে প্রবোধবাক্য, সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল না তাহ এই ঋকে প্রমাণ হইতেছে।

(৩) সায়ণের মতে ১০, ১১, ১২ এই তিন ঋকের তাৎপৰ্য্য এই যে যখন মৃতব্যক্তিকে দাহ করিয়া তাহার অস্থি সঞ্চয় করা হয়, তখন ঐ ঋক কয়েকটা পাঠ করা হয়, কিন্তু মুলে অস্থির উল্লেখ নাই। ঋকগুলি পাঠ করিলে বোধ হয় যেন মৃতব্যক্তির শরীরই মৃত্তিকার নীচে স্থাপন করা হইত।