ঋগ্বেদ সংহিতা – অষ্টম মণ্ডল
১ সূক্ত
ইন্দ্র দেবতা। কণ্বগোত্র মেধ্যাতিথি ও মেধাতিথি ঋষি; আদি ঋকদ্বয়ের ঘোরেরপুত্র ঋষি; পরে ভ্রাতা কণ্বের পুত্রতাপ্রাপ্ত প্রগাথনামে ঋষি; ত্রিংশ হইতে চারিটী ঋকের ঋষি অসঙ্গনামে রাজপুত্র; চতুত্রিংশ ঋকের ঋষি অসঙ্গের ভার্য্যা অঙ্গিরার কন্যা শশ্বতী
১. হে সখা সকল! তোমরা অন্যের স্তোত্র উচ্চারণ করিও না, হিংসিতা হইও না, সোম অভিষুত হইলে অভীষ্টবর্ষী ইন্দ্রকে একত্র হইয়া স্তব কর এবং মুর্হু মুর্হু উক্থ সকল উচ্চারণ কর।
২. বৃষভের ন্যায় শত্রুদিগের হিংসাকারী ও জরারহিত ও বৃষভের ন্যায় মনুষ্যদিগের পরাভবকারী ও শত্রুদিগের বিদ্বেষ্টা ও স্তোত্রগণের সংভজনীয় এবং উভয় প্রকার ধনবিশিষ্ট দাতৃতম ইন্দ্রকেই স্তব কর।
৩. হে ইন্দ্র! এই জনগণ যদিও রক্ষার্থে পৃথক্ পৃথক্ তোমায় স্তব করিতেছে, তথাপি আমাদের এই স্তোত্রই সর্ব্বকালেই তোমার বর্দ্ধক হউক।
৪. হে ভগবান ইন্দ্র! তোমার পণ্ডিত স্তোতাগণ শত্রুগণের কম্প উৎপাদন করতঃ সর্ব্বদা আপদ হইতে উত্তীর্ণ হয়। আমাদের নিকট আগমন কর, তৃপ্তির জন্য বহুরূপবিশিষ্ট নিকটস্থিত অন্ন আমাদিগকে প্রদান কর।
৫. হে বজ্রবান ইন্দ্র! তোমাকে মহামূল্যেও বিক্রয় করি না। হে বজ্রহস্ত! সহস্রসংখ্যক ও অযুতসংখ্যক ধনের জন্যও করি না এবং হে বহুধন! অপরিমিতধনের জন্যও করি না।
৬. হে ইন্দ্র! তুমি আমার পিতা হইতেও অধিক ধনবান, অপালনকারী ভ্রাতা হইতেও অধিক ধনবান। হে বসু! আমার মাতা ও তুমি সমান হইয়া আমার ব্যাপ্তিবিশিষ্ট ধনলাভার্থ পূজিত কর।
৭. হে ইন্দ্র! তুমি কোথায় গিয়াছ, কোথায় আছ, তোমার মন নানা দিকে। হে যুদ্ধকুশল, যুদ্ধকারী পুরন্দর! আগমন কর, গায়ত্রগণ তোমার স্তব করিতেছেন।
৮. এই ইন্দ্রের উদ্দেশে গায়ত্র গান কর, পুরন্দর ইন্দ্র সকলের সংভজনীয়, যে ঋক্সমূহদ্বারা কণ্বপুত্রের যজ্ঞস্থলে বজ্রযুক্ত হইয়া গমন করিয়াছিলেন এবং যাহাদের দ্বারা পুরী ভেদ করিয়াছিলেন, সেই ঋকে গায়ত্র গান কর।
৯. হে ইন্দ্র! তোমার যে দশমযোজনগামী শতসংখ্যক ও সহস্রসংখ্যক অশ্ব আছে, তাহারা সেচনসমর্থ ও শীঘ্রগামী। সেই অশ্বের সাহায্যে শীঘ্র আগমন কর।
১০. অদ্য দুগ্ধদায়িনী, প্রসংশনীয় বেগযুক্তা, সুখে দোহন সমর্থাধেনুর স্তব করি, এতদ্ভিন্ন বহুধারাযুক্ত, বাঞ্ছনীয়, বৃষ্টিরূপ পর্য্যাপ্তকারী ইন্দ্রকে স্তব করি (১)।
১১. সূর্য্য যখন এতশকে পীড়া দিয়াছিলেন, তখন বক্রগামী ও বায়ুসদৃশগমনশীল অশ্বদ্বয় অর্জ্জুনপুত্র কুৎস ঋষিকে বহন করিয়াছিল। শতক্রতু গন্ধর্ব্ব (২) ও অহিংসিত সূর্য্যকে ছদ্মবেশে আক্রমণ করিতে গিয়াছিলেন।
১২. যে ইন্দ্র সন্ধান দ্রব্য ব্যতিরেকেই গ্রীবা হইতে রুধির নিঃসরণের পূর্ব্বেই সন্ধির সংযোজনা করেন, ক্ষমবান্, বহুধন সেই ইন্দ্র বিচ্ছিন্নকে পুনঃ সংস্কার করিয়া দেন।
১৩. হে ইন্দ্র! তোমার অনুগ্রহে আমরা যেন নীচ না হই, যেন দুঃখী না হই, আরও প্রক্ষীণ বলের ন্যায় (আমরা যেন পুত্রপৌত্রাদিবিযুক্ত না হই)। হে বজ্রবান ইন্দ্র! অন্যে আমাদিগকে দগ্ধ করিতে পারে না, গৃহে নিবাস করতঃ আমরা তোমার স্তব করিব।
১৪. হে বৃত্রহণ! সত্বর ও উগ্রতাশূণ্য হইয়া আমরা ধীরে ধীরে তোমার স্তব করিব। হে শূর! তোমার জন্য একবার প্রভূত ধনের সহিত সুন্দর স্তোত্র অনুমোদন করিব।
১৫. ইন্দ্র যদি আমাদের স্তোত্র শ্রবণ করেন, তাহা হইলে তখনই যেন আমাদের সোম সকল তাঁহাকে হর্ষিত করিতে পারে, উহারা তীর্য্যকভাবে অবস্থিত পবিত্রের সহিত সম্পর্কযুক্ত হইয়াছে ও বসতীবরী প্রভৃতি জলের দ্বারা বর্দ্ধমান, অতএব শীঘ্র মদজনক হইয়াছে।
১৬. হে ইন্দ্র! তোমার সেবাকারী স্তোতার সংমিলিত স্ততির অভিমুখে অদ্য শীঘ্র আগমন কর; অন্য হবিষ্মান্দিগের স্তোত্র তোমার নিকট গমন করুক; অধুনা আমিও তোমার সুস্তুতি কামনা করি।
১৭. তোমার প্রস্তরদ্বারা সোম অভিষব কর, ইহাকে জলে ধৌত কর, গোচর্ম্মের ন্যায় মেঘের দ্বারা শরীর আচ্ছাদন করিয়া মরুৎগণ নদীগণের জন্য জল দোহন করিতেছেন।
১৮. হে ইন্দ্র! পৃথিবী হইতে, অন্তরীক্ষ হইতে, অথবা বৃহৎ দীপ্তপ্রদেশ হইতে আগমন করতঃ আমার এই বিস্তৃত স্তুতিদ্বারা বর্দ্ধিত হও। সে সুক্রুতু! আমাদের উৎপন্ন লোক সকলকে অভিলষিত ফলে পূর্ণ কর।
১৯. তোমরা ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে সর্ব্বাপেক্ষা মদকর বরণীয় সোম অভিষব কর। শত্রু সমস্ত ক্রিয়াদ্বারা প্রীতি উৎপাদক অন্নাভিলাষী যজমানকে বর্দ্ধিত করেন।
২০. হে ইন্দ্র! সবনসমূহে সোম স্রাবণ ও স্তুতিযুক্ত হইয়া সর্ব্বদা প্রার্থনা করতঃ আমি যেন তোমাকে কুপিত না করি। তুমি ভর্ত্তা ও সিংহের ন্যায় (ভয়ঙ্কর), কে তোমার নিকটা যাঞ্চা না করে।
২১. উগ্রবলযুক্ত ইন্দ্র, মদোৎপাদক স্তোতাদ্বারা প্রেরিত মদকর সোন পান করুন। তিনি সোমজনিত হর্ষ উৎপন্ন হইলে আমাদিগকে শত্রুগণের জেতা ও তাহাদের গর্ব্ব খর্ব্বকারী পুত্র প্রদান করেন।
২২. ইন্দ্রদেব সুখোৎপাদক যজ্ঞে হব্যদায়ী (যজমানের) উদ্দেশে বহুবরণীয় ধন দান করেন। তিনিই সোমাভিষবকারী ও স্তোত্রকারীকে ধনু প্রদান করেন। তিনি সর্ব্বকার্য্যে উদ্যোগী ও স্তোতাগণের প্রশংসনীয়।
২৩. হে ইন্দ্র! আগমন কর, হে দেব! তুমি বিচিত্র ধনদ্বারা হৃষ্ট হও, একত্র পীত সোমদ্বারা তোমার বিস্তীর্ণ বৃদ্ধ উদর সরোবরের ন্যায় পূর্ণ কর।
২৪. হে ইন্দ্র! শতসংখ্যক ও সহস্রসংখ্যক অশ্ব হিরণ্ময় রথে সোমপানার্থ ইন্দ্রকে বহন করুন। উহারা প্রভুযুক্ত ও কেশরযুক্ত।
২৫. শ্বেতপৃষ্ঠ, ময়ুরবর্ণরূপবিশিষ্ট অশ্বগণ তোমাকে মধুর স্তুতিযোগ্য সোম পানার্থে হিরণ্ময় রথে বহন করুন।
২৬. হে স্তুতিযোগ্য! শীঘ্র এই অভিযুক্ত সোম প্রথম সোমাপায়ীর ন্যায় (৩) পান কর; ইহা পরিস্কৃত ও রসবিশিষ্ট। এই আসবমদকর ও চারু, ইহা মত্ততার জন্য সম্পন্ন হয়।
২৭. যে ইন্দ্র একাকী আপন কর্ম্মদ্বারা সকলকে পরাভব করেন, যিনি কর্ম্মদ্বারা মহান্ উগ্র এবং শিরস্রাণবিশিষ্ট, সেই ইন্দ্র আগমন করুন। তিনি যেন পৃথক না হন। আমাদের স্তোত্রাভিমুখে আগমন করুন। তিনি যেন আমাদের ত্যাগ না করেন।
২৮. হে ইন্দ্র! তুমি শুষ্কের সঞ্চরণশীল নিবাসস্থান বজ্রের দ্বারা সংচূর্ণ করিয়াছিলে, তুমি দুই প্রকারের (স্তোতা ও ষষ্টার) দ্বারা আহ্বানযোগ্য, তুমি দীপ্তমান হইয়া তাঁহারা অনুগমন করিয়াছিলে।
২৯. সূর্য্য উদিত হইলে, তুমি আমার স্তোত্র সকল আবর্ত্তিত কর। দিবসের মধ্যাহ্নে আমার স্তুতি আবর্ত্তিত কর। দিবসের অবসান হইলে আমার স্তোত্র আবর্ত্তিত কর। শর্ব্বরী সময়েও আমার স্তোত্র সকল আবর্ত্তিত কর।
৩০. হে মেধ্যাতিথি! পুনঃ পুনঃ আমাকে স্তব কর, আমাকে প্রশংসা কর, আমরা ধনবানদিগের মধ্যে তোমার প্রতি সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ধনদাতা। আমার বীর্য্যে অন্যের অশ্ব নির্ম্মিত হয়, আমার পথ উৎকৃষ্ট আয়ুধ উৎকৃষ্ট।
৩১. আমি শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া আহারান্তে অশ্বদিগকে তোমার রথে যোজনা করিয়াছিলাম। আমি মনোহর ধন (দান করিতে জানি); আমি যদুবংশোৎপন্ন (৪) ও পশুমান্।
৩২. যিনি গমশীল ধন হিরণ্ময় চর্ম্মাস্তরণের সহিত আমাকে প্রদান করিয়াছিলেন, তিনি শব্দায়মান্ রথযুক্ত হইয়া (শত্রুদিগের) সমস্ত ধন অভিভব করুন।
৩৩. হে অগ্নি! প্লয়োগেরপুত্র আসঙ্গ দশ সহস্ত্র (গাভী দানের) দ্বারা দাতাগণকে অতিক্রম করিয়া দান করিয়াছিলেন। অনন্তর সেই সেচনসমর্থ ও দীপ্যমান্ (পশু সকল) সরোবর হইতে নলের ন্যায় নির্গত হইয়াছিল।
৩৪. ইহার সম্মুখভাগে স্থূল দেখা যাইতেছে, উহা অস্থিরহিত, বিস্তীর্ণ এবং নিম্নমুখে লম্বমান। শশ্বতীনাম্নী নারী উহা দেখিয়া বলিলেন (৫), আর্য্য! উত্তম ভোগসাধন বস্তু ধারণ করিতেছ।
—————-
(১) এই ঋকে ইন্দ্রকে ধেনু ও বৃষ্টিরূপে স্তব করা হইতেছে।
(২) “গন্ধর্ব্ব” শব্দে গবাং রশ্মীনং ধত্তারং। সায়ণ।
(৩) বায়ু সকল দেবতার পূর্ব্বে সোম পান করিয়া থাকেন। সায়ণ।
(৪) মূলে “যাদ্বঃ” আছে।
(৫) প্লযোগনামক রাজারপুত্র অসঙ্গ শাপগ্রস্থ হইয়া স্ত্রী হইয়া যান, পর মেধাতিথির প্রভাবে পুরুষত্ব লাভ করেন। সায়ণ। অঙ্গিরার কন্যা শশ্বতী তাঁহার ভার্য্যা। সেই শশ্বতী এই ঋকের বক্তা এবং ঋষি।