নিম্নোক্ত কাব্যগ্রন্থগুলি সাজানো হয়নি

অস্ত্রোপচারের পরে

কী বলতে কী বলি? কীভাবে যে শুরু করি! সমস্যাটা
খোলাখুলি বলা যায়, এখানেই। বিকেল পাঁচটা
বেজে পাঁচ মিনিটে অপারেশান থিয়েটারে আমি
হেঁটে যাই শাদা ঢোলা জামা গায়ে বন্দীর ধরণে।
স্মিতমুখ সার্জন, আরোগ্যাশিল্পী, কান্তিমান; ফিকে
হল্‌দে দস্তানায় মোড়া হাত তাঁর খানিক পরেই
হবে রাঙা হেমোরয়েড রক্তে। লুকিয়ে ভয়ের নীলা
বুকে জননী স্ত্রী কন্যা, ভাইবোন কারুর দিকেই
তাকাইনি ফিরে, তবু একটি মুখের রেখাবলি
আমাকে, চমকে দেয় সৌন্দর্যের গহন পীড়নে।

সবুজ গাউন-পরা তিনজন ধরাধরি ক’রে
আমাকে শুইয়ে দেয় লম্বাটে টেবিলে; মুখ জুড়ে
কালো মাস্ক হাপরের মতো ব্যবহার করে, কোনো
রূপকথা শোনাবার ছলে সন্ধ্যার ঘোমটাময়
জনশূন্য ফুটপাতে ঘুম খুব সহজে পাড়ায়
চন্দনাবিহীন, দিঘি নেই আশেপাশে। তখন আসেনি কানে
বন দোয়েলের শিস। শুধু আর্কল্যাম্পের তলায়
অচৈতন্যে আমার শরীর স্বপ্নহীন স্মৃতিছুট
স্বপ্নময়তায় যেন ভাস্কর্য নিথর। চুপিসাড়ে
অন্য কেউ আমাকে দখল ক’রে নিয়েছে সহসা।

অস্ত্রোপচারের পরে কুয়াশার চিক আলগোছে
সরিয়ে দেখার মতো মনে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ
মীন রূপে সাঁতার কেটেছি অবচেতনের জলে।
ঠিক সঞ্চরণশীল নয় হয়তো; পানি থেকে মাথা
তোলা, ফের অগাধ তলিয়ে যাওয়া, এরকম
আচরণ করেছে আমার সত্তা। চিৎ হ’য়ে, কাৎ
হ’য়ে ভেসে যাচ্ছিলাম ক্লিনিকের বেডে, কিছু মুখ,
স্রোতে ভেসে-যাওয়া ফুল, আমাকে ঈষৎ ছুঁয়ে কার
ফুঁয়ে উড়ে যায় দূরে। স্যালাইন নল দ্রাক্ষালতা,
মদির জীয়নরস চুঁইয়ে পড়ে শিরায়; কে আছে
দাঁড়িয়ে শিয়রে নাগা সন্ন্যাসীর মতো? মেঘে মেঘে
শব্দহীন ঘন্টা বাজে; চোতের হাওয়ায় তৈরি এক
বালিশে গচ্ছিত মাথা। সফেদ ত্র্যাপ্রন গায়ে; চোখে
নীল চশ্‌মা গলায় স্টেথিস্‌স্কোপ, সে কি চেনা কেউ?

নার্সময়তায় চতুর্দিকে হংসীদল। ফিস্‌ফিসে
কথা ভাসে, দ্রুত পদধ্বনি, কারো ছবি কাছে এসে
চিহ্নহীন। দরজার পাশে জবাগাছ কে রেখেছে
পুঁতে এরকম ছন্দোময়? অক্ষরবঞ্চিত বই,
পত্রহীন লেফাফা এবং বীতরাগ গীত ঢোকে
আমার ভেতরে আর পানিমগ্ন ক্যাফেটারিয়ায়
দক্ষকন্যাদের ভিড়। কার কী যে নাম দীপিতার
সঙ্গে কবে শেষ দেখা হয়েছিলো নিঝুম সন্ধ্যায়?
মাথার ভেতরকার মেঘদল ছিঁড়ে যন্ত্রণার
স্খলিত নক্ষত্র ছাই হয়, বড় বেশি ধবধবে
দেয়ালে চঞ্চল ঘাসফড়িঙেরা ক্ষীণ পরমায়ু
নিয়ে করে ওড়াউড়ি। দিকে দিগন্তরে তৃষ্ণার্তের
ওষ্ঠ জেগে থাকে সর্বক্ষণ; কখনো দুলছি খুব
ঢেউলাগা, নৌকো, কখনো বা কৃষকের হাত থেকে
ক্রমাগত ঝ’রে যেতে থাকি,গুঁড়ো হই শস্যবীজ।
তন্দ্রার হরিণ বেডে নিদ্রার বিবাদ রেখে যায়।