সাধের তবিলদারি নিশ্চিত ঠেকেছে তলানিতে,
উপরন্তু দেনায় ডুবেছে মাথা, তবু হু-হু আভিজাত্যে মজে
মাকড়সা, আরশোলাময় অন্ধকার ঘরে বসে
মন উচাটন। ওরে আমি অসময়ে কোথা যাবো?
আমিতো দাসানুদাস, খাস তালুকের প্রজা, জানি
রতন মাণিক্য কতো প’ড়ে আছে সেই জলে, অথচ কখনো
পারিনি তুলতে একরত্তি। বাজারে বাজার করো মন বলে
এ-পাড়া ও-পাড়া করি, আদা কাঁচকলা কিনে থলির দীনতা
সযত্নে লুকোই আর কোনোমতে আধপেটা খেয়ে শতচ্ছিন্ন
কম্বল সম্বল করে শোধনবাদের ছিদ্র খুঁজি, গুলতাপ্পি,
কটুকাটব্যের ঝড় তুলি নিত্য ধারের বুলির ভরসায়।
আর কী মজার কাণ্ড, দু’হাতে রোখেন যারা ক্ষিপ্র আগামীকে,
তারাই সহজে আজ মাথায় বুলিয়ে হাত প্রগতির পথ বাৎলান।
পুরোনো কুকুর-ঘরে গুমনাম স্বপ্ন কতিপয়
রেখেছি গচ্ছিত, তারই প্ররোচনা হৃদয়ের চোরকুঠরিতে
চৈত্ররজনীর স্মৃতি আনে মধ্যে মধ্যে-দেখি, তুমি আছো এই আটত্রিশ
বছরের অভিজ্ঞ পাঁজর ঘেঁষে, উন্মোচিত শরীরের দীপ্ত রাজধানী।
চোখের পাতায় জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্না চুল, স্নিগ্ধ বাহু, মিনার-গ্রীবায়-
জ্যোৎস্নায় বাসনা চরে, যেন রাজহাঁস,
রক্তিম চঞ্চুর আভা ছড়িয়ে হাওয়ায় লীলায়িত।
সোনালি বৃক্ষের ডাল থেকে পাখি নেমে এসে
গান গায় হৃদয়ের উন্মুক্ত খাঁচায়,
বাঁচায় অতনু অতীতকে। অথচ ফেরালে মুখ
চাঁদের ফালিটি দেখি হৃদয়ের ভরা
ক্ষতকে খোঁচায় কৌতুকের বক্রতায়।
প্রচুর আদর খেয়ে প্রকৃতির বসন্তের পেছনে পেছনে
করি ধাওয়া, খুঁজি তাকে দিনমজুরের
খুপরিতে, রেশনের দোকানের দীর্ঘ পাঁচমিশেলী কাতারে,
মুদীর চালায়, কারখানায়,
আর ঢেউ-খেলানো টিনের ছাদে, ডোবার কিনারে।
সেখানে বসন্ত কৈ? বস্তুত অধুনা
বসন্ত প্রতিষ্ঠা খোঁজে তারুণ্যের উদ্দাম মিছিলে,
সংস্কৃতির উচ্চকিত স্বাধিকারে, পর্বত-টলানো হরতালে।
ধরনি ন জাই অনীতি ঘোর নিশাচর জো করহিঁ,
হিংসা পর অতি প্রীতি তিন্হ কে পাপহি করনি মিতি।
বাঢ়ে খল বহু চোর জুআরা।
যে লম্পট পর ধন পর দারা।।
মানহিঁ মাতু পিতা নহি দেবা।
সাধুন্ হ সন কব্রারহিঁ সেবা।।
আমাদের শতকের শোক, জরা, ব্যাধি বড় বেশি
ভাবিত, বিপন্ন করে। দীর্ঘদেহী ইতিহাস অবেলায়
ছায়া ফেলে যায় যুগান্তের করিডরে। প্রত্যুষের শাদা
মোরগের কিরীটের মতো সূর্য আমরা দেখিনি
কতকাল, কতকাল নৈঃসঙ্গ্যের ক্রুশকাঠ বয়ে
ফুটিয়েছি কতো রক্তগোলাপ পাথুরে মৃত্তিকায়
ওরা পা রাখবে বলে। অথচ এখনো স্পষ্ট কোনো
পদধ্বনি এ শহরে আমরা শুনিনি। চাঁদটাকে
কে যেন করবে গ্রাস, প্রাগৈতিহাসিক জন্তুগুলি
দলে দলে তৃণহীন মাটি ফুঁড়ে অতৃপ্ত ক্ষুধায়
আবার জেগেছে যেন।
ত্রাসের রথের চাকা দ্রুত
দলিত খণ্ডিত করে, আমাদের নগ্ন কাঁধে কোনো
দেবদূত ভুলক্রমে মহিমার হাত রাখলেও
ভাসে না আনাড়ি চোখে স্বর্গোদ্যান আজ।
সেদিন দেখেছি স্বপ্নে আবার এলেন তিনি ম্লান
জটিল পাঁচিল ঘেঁষে-এলেন আমার পিতা, মৃত,
ক্রুদ্ধ, অনুযোগে কম্পমান। তবে কি বেয়াড়া কিছু
ঘটেছে শহরে?
তবে কি আমার কাছে চান কোনো প্রতিকার অশরীরী পিতা?
তেমন যোগ্যতা নেই, বুঝি তাই ভয়ার্ত ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি
চকিতে উঠলো কেঁপে রাত্রির হাওয়ায়,
কেবলি প্রেতের সঙ্গে জমাই আলাপ।
কারাগারে, কখনো-বা চোরকুঠরিতে
ভাঁড় আর ঘাতকের, কপট বন্ধুর কাঁধ ঘেঁষে
লুকিয়ে বুকের ক্ষত হাঁটি একা নিদ্রাতুর এই
শহরের অলিতে-গলিতে। দৃশ্যান্তরে
উন্মাদিনী কাঁদে, ভাসে জলের ভিতরে,
লতাগুল্মে নিদ্রায় নিথর!
শবাকীর্ণ মঞ্চে আমি ভীষণ দোমনা, নিরুপায়।
তবে কি কৃপার পাত্র আমি? পাদপ্রদীপের নিচে
চিরদিন অভ্যর্থনাহীন?
এখানে কোথাও কেউ কারো প্রতি নয় মনোযোগী,
অথচ বচসা করে অবোধ্য ভাষায়, রাতারাতি বাচম্পতি
হতে চায় দায়িত্বের চন্দচর্চিত ললাটের মহিমায়।
আপন-বাঁচার যোগী এখানে সবাই
আজকাল। জীবনের উঁচু উঁচু ডালের অতীব
পুরুষ্ট ফলের গুচ্ছে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে
ক্লান্ত হলে ঘরে ফেরে, করে খুনসুটি
খানিক স্বপ্নের সঙ্গে। অথচ এদিকে
দেনায় ডুবেছে মাথা, ঘরের খুঁটিতে ঘুণ, ভিত টলোমলো।