৪০তম অধ্যায়
শল্যের কর্ণ-তিরস্কার
“শল্য কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! তোমাকে ছয় হস্তিসংযোজিত সুবর্ণময় রথ প্রভৃতি কিছুই দান করিতে হইবে না। তুমি বালকত্বপ্রযুক্ত কুবেরের ন্যায় ধনদানে প্রবৃত্ত হইয়াছ। আজ অনায়াসেই ধনঞ্জয়কে দেখিতে পাইবে। তুমি অতি অজ্ঞানের ন্যায় প্রভূত ধন দান করিতে ইচ্ছা করিতেছ, কিন্তু অপাত্রে দান করিলে যে সমস্ত দোষ জন্মে, মোহবশতঃ তাহা বুঝিতে পারিতেছ না। তুমি যে সমস্ত ধন বৃথা ব্যয় করিতে উদ্যত হইয়াছ, তদ্দ্বারা বিবিধ যজ্ঞ সুসম্পন্ন করিতে পার। আর তুমি অজ্ঞানতাপ্রাপ্ত কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে বিনাশ করিতে বাসনা করিতেছ, উহা নিতান্ত অসম্ভব। শৃগাল সংগ্রামে সিংহদ্বয়কে নিপাতিত করিয়াছে, ইহা কদাপি আমাদিগের কর্ণগোচর হয় নাই। তোমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তির যাহা অভিলাষ করিবার নহে, তুমি তাহাই অভিলাষ করিয়াছ। তোমার কি এমন কোনও বন্ধু নাই যে, এ সময়ে তোমাকে হুতাশনে পতনোম্মুখ দেখিয়া নিবারণ করে? তুমি কাৰ্য্যাকাৰ্য্য বিবেচনা করিতে সমর্থ হইতেছ না; অতএব নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, তোমার কাল পূর্ণ হইয়াছে। কোন জিজীবিষু [বাঁচিতে ইচ্ছুক] ব্যক্তি অসম্বদ্ধ [অর্থ ও যুক্তিবিহীন] অশ্রোতব্য বাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকে? তুমি যাহা বাসনা করিতেছ, উহা কণ্ঠে মহাশিলা বন্ধনপূর্ব্বক বাহুদ্বয়দ্বারা সমুদ্র সন্তরণ ও গিরিশৃঙ্গ হইতে পতনের ন্যায় নিতান্ত অনর্থকর। এক্ষণে যদি তুমি আপনার মঙ্গল প্রার্থনা কর, তাহা হইলে ব্যহিত যোদ্ধা ও সেনাগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। আমি তোমার প্রতি দ্বেষ করিতেছি না, দুর্য্যোধনের হিতসাধনার্থই এইরূপ কহিতেছি। এক্ষণে যদি তোমার জীবিত থাকিবার বাসনা থাকে, তাহা হইলে আমার বাক্যে আস্থা প্রদর্শন কর।
“কর্ণ কহিলেন, ‘হে শল্য! আমি স্বীয় বাহুবলপ্রভাবে অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রাম করিতে বাসনা করিতেছি। তুমি মিত্ৰতাপূর্ব্বক শত্রুতাচরণ করিয়া আমাকে ভীত করিতে অভিলাষী হইয়াছ। যাহা হউক, এক্ষণে মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, অদ্য ইন্দ্রও আমাকে এই অভিপ্রায় হইতে নিবৃত্ত করিতে পারিবেন না।’
“অনন্তর মহাবীর মদ্রেশ্বর শল্য কর্ণের বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক তাঁহাকে পুনর্ব্বার প্রকোপিত করিবার নিমিত্ত কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! যখন অর্জ্জুনের জ্যানিঃসৃত বেগবান্-নিশিতাগ্র শরজাল তোমার অনুগমন করিবে, যখন সব্যসাচী দিব্যশরাসন গ্রহণপূর্ব্বক কৌরবসেনা তাপিত করিয়া নিশিতশরনিকরে তোমাকে নিপীড়িত করিবে, সেই সময় তোমাকে অনুতাপ করিতে হইবে। বালক যেমন জননীর ক্রোড়ে শয়ান হইয়া চন্দ্র গ্রহণ করিতে বাসনা করে, তদ্রূপ তুমি মোহবশতঃ অদ্য দেদীপ্যমান রথস্থ অর্জ্জুনকে জয় করিতে প্রার্থনা করিতেছ। হে মুঢ়! অদ্য অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে অভিলাষ করাতে তীক্ষ্ণধার ত্রিশূলে তোমার সর্ব্বাঙ্গ ঘর্ষিত করা হইতেছে। ক্ষণজীবী ক্ষুদ্র মৃগশাবক যেমন রোষাবিষ্ট বৃহৎ সিংহকে যুদ্ধার্থ আহ্বান করে, তদ্রূপ তুমি অদ্য অর্জ্জুনকে আহ্বান করিতেছ। অরণ্যে মাংসতৃপ্ত শৃগাল যেমন সিংহের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া বিনষ্ট হয়, তদ্রূপ তুমি মহাবলপরাক্রান্ত রাজপুত্র ধনঞ্জয়কে আহ্বান করিয়া বিনষ্ট হইও না। হে কর্ণ! তুমি শোক হইয়া প্রভিন্নগণ্ড বিশালদশনশালী মহাগজস্বরূপ ধনঞ্জয়কে যুদ্ধার্থ আহ্বান করিতেছ। অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধকামনা করাতে তোমার কাষ্ঠদ্বারা বিলস্থ মহাবিষ ক্রুদ্ধ কৃষ্ণসৰ্পকে বিদ্ধ করা হইতেছে। শৃগাল যেমন কেশরান্বিত ক্রুদ্ধ সিংহকে ও ভুজঙ্গ যেমন আবিনাশার্থ বলবান্ পতগশ্রেষ্ঠ সুপর্ণকে আহ্বান করে, তুমি সেইরূপ ধনঞ্জয়কে আহ্বান করিতেছ এবং প্লবহীন হইয়া চন্দ্রোদয়ে পরিবর্ধিত অসংখ্য মীনসমাকীর্ণ ভীষণ জলনিধি উত্তীর্ণ হইতে উদ্যত হইয়াছ। বৎস যেমন সুতীক্ষ্ণশৃঙ্গশালী, প্রহার সমর্থ বৃষকে যুদ্ধার্থ আহ্বান করে এবং ভেক যেমন বারিপ্রদ নিবিড় মহামেঘের উদ্দেশে ও আত্মগৃহস্থিত কুকুর যেমন অরণ্যচারী ব্যাঘ্রের উদ্দেশে ঘোরতর গর্জন করে, তদ্রূপ তুমি নরশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুনের উদ্দেশে গর্জন ও তাহাকে সমরে আহ্বান করিতেছ। হে কর্ণ! অরণ্যমধ্যে শোকপরিবেষ্টিত শৃগাল যে পৰ্য্যন্ত সিংহ সন্দর্শন করে, তাবৎকাল আপনাকে সিংহের ন্যায় বোধ করিয়া থাকে, তুমিও তদ্রূপ শত্ৰুসূদন নরসিহ ধনঞ্জয়কে না দেখিয়া আপনাকে সিংহ বলিয়া বোধ করিতেছ। যে পৰ্য্যন্ত সূর্য ও চন্দ্রমার ন্যায় প্রভাবসম্পন্ন একরথাধিষ্ঠিত কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে না দেখিতেছ, তাবৎকাল তোমার আপনাকে ব্যাঘ্র বলিয়া বোধ হইতেছে। যে পৰ্য্যন্ত ঘোর সংগ্রামে গাণ্ডীবনির্ঘোষ তোমার কর্ণগোচর না হইবে, তাবৎকাল তুমি যাহা ইচ্ছা, তাহাই কহিতে পারিবে; কিন্তু অর্জ্জুনের রথ ও শরাসনের গভীর নিঃস্বনে দশদিক প্রতিধ্বনিত হইলে তোমাকে নর্দ্দমন শার্দূলদর্শী শৃগালের ন্যায় বিমূঢ় হইতে হইবে। হে মূঢ়! মহাবীর ধনঞ্জয় সিংহের সদৃশ প্রভাবসম্পন্ন; আর তুমি বীরজনের বিদ্বেষ করিয়া শৃগালের ন্যায় লক্ষিত হইতেছ। হে সূক্তপুত্র! মূষিক ও বিড়ালের, কুকুর ও ব্যাঘ্রের, শৃগাল ও সিংহের, শশক ও কুঞ্জরের, মিথ্যা ও সত্যের এবং বিষ ও অমৃতের যেরূপ প্রভেদ, তোমার এবং ধনঞ্জয়েরও তদ্রূপ বিভিন্নতা, সন্দেহ নাই।”