হিংসার দোষ—কার্ত্তবীৰ্য্য-সমুদ্রসংবাদ
“ব্রাহ্মণ বলিলেন, ‘হে বরবৰ্ণিনি! অতঃপর আমি এই উপলক্ষ্যে কাৰ্ত্তবীর্য্য-সমুদ্রসংবাদ নামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
‘পূৰ্ব্বে সহস্রবাহুসম্পন্ন মহারাজ কাৰ্ত্তবীৰ্য্যাৰ্জ্জুন স্বীয় শরপ্রভাবে সসাগরা পৃথিবী পরাজিত করিয়াছিলেন। তিনি একদা সমুদ্রতীরে বিচরণ করিতে করিতে সমুদ্রকে লক্ষ্য করিয়া শত শত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন সমুদ্র মূর্ত্তিমান হইয়া নিতান্ত ব্যথিতচিত্তে তাঁহার সমীপে আগমন করিয়া প্রণতিপুরঃসর কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে কহিলেন, “বীরবর! আপনি আর আমার প্রতি শর নিক্ষেপ করিবেন না, এক্ষণে আমাকে আপনার কোন্ কাৰ্য্যসাধন করিতে হইবে, আদেশ করুন, আমার আশ্রিত জীবজন্তুগণ আপনার ভীষণ শরপ্রভাবে নিহত হইতেছে; এক্ষণে আপনি তাহাদিগকে অভয় প্রদান করুন।”
‘তখন কাৰ্ত্তবীর্য্য কহিলেন, “জলনিধে! আমি এই ভূমণ্ডলমধ্যে আমার সমকক্ষ যোদ্ধা দেখিতে পাই নাই, এই নিমিত্তই তোমার উপর শরনিক্ষেপ করিতেছি। এক্ষণে যদি ইহলোকে কেহ আমার তুল্য ধনুর্দ্ধর বিদ্যমান থাকে, তাহা হইলে তুমি শীঘ্র তাহার নাম নির্দ্দেশ কর, আমি অবিলম্বে তাহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব।”
পরশুরামসহ সমরে কার্ত্তবীর্য্যবধ
‘সমুদ্র কহিলেন, “মহারাজ! আপনি মহর্ষি জমদগ্নির নাম শ্রবণ করিয়া থাকিবেন। তাঁহার পুত্র পরশুরামই আপনার সমকক্ষ।” সমুদ্র এই কথা কহিলে, কাৰ্ত্তবীৰ্য্য তাঁহার বাক্য শ্রবণমাত্র ক্রোধে অধীর হইয়া বন্ধুবান্ধবগণসমভিব্যাহারে পরশুরামের আশ্রমে গমনপূর্ব্বক তাঁহার অনিষ্টাচরণ করিয়া ক্রোধাগ্নি প্রজ্বলিত করিলেন। ঐ সময় তাঁহার কোপানলপ্রভাবে কাৰ্ত্তবীর্য্যের সৈন্যসমুদয় দগ্ধপ্রায় হইতে লাগিল এবং তিনি অচিরাৎ পরশুগ্রহণপূৰ্ব্বক বহুশাখাসমাকীর্ণ বিটপীর ন্যায় সহস্রবাহুসম্পন্ন কাৰ্ত্তবীৰ্য্যকে সহসা ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
‘মহাবীর কাৰ্ত্তবীৰ্য্য নিপতিত হইলে, তাঁহার বান্ধবগণ এককালে সকলে খড়্গ ও শক্তি গ্রহণপূৰ্ব্বক পরশুরামের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর পরশুরামও সত্বর শরাসনগ্রহণপূৰ্ব্বক রথারোহণ করিয়া একাকী তাহাদিগকে কালকবলে নিপাতিত করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভার্গব এইরূপে অলৌকিক বীরত্ব প্রকাশ করিলে, সেই সমরাঙ্গনস্থ হতাবশিষ্ট ও অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণ প্রায় সকলেই সিংহনিপীড়িত মৃগের ন্যায় নিতান্ত ভীত হইয়া গিরিগহ্বরে প্রবেশ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় যেসকল ক্ষত্রিয় গ্রাম বা নগরমধ্যে বাস করিয়াছিলেন, তাঁহারাও পরশুরামের ভয়ে স্ব স্ব কৰ্ত্তব্যকার্য্যের অনুষ্ঠানে সমর্থ হইলেন না। সুতরাং বেদ তিরোহিত প্রায় হইল এবং প্রজাগণ শূদ্রের ন্যায় ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময়ই ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মের ব্যতিক্রমনিবন্ধন দ্রাবিড়, আভীর, পুণ্ড্র ও শবর দেশীয় সমুদয় ব্যক্তিই শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়।
পরশুরামের পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয়করণ
‘এইরূপে ক্ষত্রিয়গণ পরশুরামের হস্তে নিহত ও পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয়া হইলে, ব্রাহ্মণগণ পৃথিবীর দুর্দ্দশানিবারণের নিমিত্ত বিধবা ক্ষত্রিয়াদিগের গর্ভে পুত্রোৎপাদন করিতে লাগিলেন। কিন্তু মহাবীর পরশুরাম তাহাও সহ্য করিতে পারিলেন না। ব্রাহ্মণদিগের ঔরসে যতবার ক্ষত্রিয়সমুদয় সমুৎপন্ন হইতে লাগিল, মহাবীর ভার্গব ততবারই তাহাদিগকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। এইরূপে একবিংশতিবার ক্ষত্রিয়কুল নির্ম্মূল হইলে পর একদা এই আকাশবাণী সবসমক্ষে পরশুরামের কর্ণগোচর হইল যে, “বৎস! বারংবার ক্ষত্রিয়কুল ক্ষয় করাতে তোমার কিছুমাত্র ফলোদয় নাই; অতএব তুমি এ ব্যবসায় হইতে অচিরাৎ নিবৃত্ত হও।”
‘ঐ সময় পরশুরামের পুৰ্ব্বপুরুষ ঋচীক প্রভৃতি মহাত্মারাও আকাশ হইতে তাঁহাকে বারংবার নিবারণ করিয়া কহিলেন, “বৎস! তুমি এক্ষণে ক্ষত্রিয়-বিনাশের সঙ্কল্প পরিত্যাগ কর।” পূৰ্ব্বপুরুষগণ এইরূপে বারংবার ক্ষত্রিয়বধে নিবারণ করিলেও পরশুরাম পিতৃবধজনিত ক্রোধ সংবরণ করিতে পারিলেন না। তখন তিনি তাঁহাদিগকে ও ঋষিগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে পিতৃগণ! আমি ক্ষত্রিয়সংহারে দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়াছি; এক্ষণে আমাকে নিবারণ করা আপনাদিগের কর্ত্তব্য নহে।”