আধ্যাত্মিক যজ্ঞ
“ব্রাহ্মণ বলিলেন, ‘হে প্রিয়ে! অতঃপর চাতুর্হোত্রবিষয়ক রহস্য কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কারণ, কৰ্ম্ম, কৰ্ত্তা ও মোক্ষ এই চারটি হোতা বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। নাসিকা, জিহ্বা, চক্ষুঃ, ত্বক, শ্রোত্র, মনঃ ও বুদ্ধি এই সাতটির নামকরণ; ইহারা অবিদ্যা হইতে উৎপন্ন হয়। গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ, শব্দ, সংশয় ও নিশ্চয় এই সাতটির নাম কৰ্ম্ম; ইহারা পাপপুণ্য হইতে উৎপন্ন হয়। ঘ্রাতা, ভক্ষয়িতা, দ্রষ্টা, স্পর্শকারী, শ্রোতা, সংশয়কৰ্ত্তা ও নিশ্চয়কৰ্ত্তা এই সাতটির নাম কৰ্ত্তা; ইহরা পূর্ব্বতন কৰ্ম্মানুরূপ শব্দাদির উৎপাদনকৰ্ত্তা জীব হইতেই উৎপন্ন হয়। আর ঐ ঘ্রাতা, ভক্ষয়িতা প্রভৃতি সাতজন যখন ভেদজ্ঞানশূন্য হইয়া চিন্মাত্ররূপে অবস্থান করে, তখন ঐ সাতজনকে মোক্ষ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। ঘ্রাণাদি ক্রিয়ার অভিমান পরিত্যাগই উহাদের উৎপত্তির কারণ।
‘যেসকল তত্ত্ববেত্তা পণ্ডিত ঘ্রাণাদির বিষয় বিশেষরূপে অবগত হয়েন, তাঁহাদের নাসিকাদি ইন্দ্রিয়সমুদয়ই গন্ধঘ্রাণ প্রভৃতি ক্রিয়া-সমুদয় সম্পাদন করিয়া থাকে; জীবাত্মা কখনই উহাতে লিপ্ত হয় না। অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই শব্দাদির উপভোগ করিতে বা উপভোগের নিমিত্ত প্রস্তুত করাইতে প্রবৃত্ত হইয়া “আমরা গন্ধাদি উপভোগ করিতেছি; আমাদিগের নিমিত্ত গন্ধাদি প্রস্তুত হইতেছে” বিবেচনা করিয়া মমতানিবন্ধন মৃত্যুমুখে প্রবেশ করে। ঐরূপ অভিমানযুক্ত ব্যক্তিদিগকেই অভক্ষ্যভক্ষণ ও অপেয়পাননিবন্ধন নরকে নিপতিত হইতে হয়। উহারাই বিষয়ভোগনিবন্ধন বারংবার মৃত্যুমুখে প্রবেশ ও বারংবার জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে; কিন্তু যেসকল মহাত্মা তত্ত্বজ্ঞানপ্রভাবে জগতের সমুদয় পদার্থের মর্ম্ম সবিশেষ অবগত হইয়া নির্লিপ্তভাবে বিষয়ভোগ করেন, তাঁহাদিগকে কখনই জন্মমৃত্যুর বশীভূত হইতে হয় না। তাঁহারা অলৌকিক শক্তিপ্রভাবে অনায়াসে বিষয়সমুদয়ের সৃষ্টি করিতে পারেন। বিষয়ভোগনিবন্ধন তাঁহাদের কিছুমাত্র দুরদৃষ্ট জন্মে না। অতএব মনঃ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়সমুদয়কে সংযত করিয়া মন্তব্য, বক্তব্য, শ্রোতব্য, দৃশ্য, স্পশ্য ও ঘ্রেয় বিষয় সমুদয় ব্রহ্মাগ্নিতে আহুতিপ্রদান করা সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেয়ঃ।
‘আমার অন্তঃকরণে সতত যোগরূপ যজ্ঞের অনুষ্ঠান হইতেছে। পরব্রহ্ম ঐ যজ্ঞের অগ্নি, প্রাণ উহার স্তোত্র, অপান উহার শাস্ত্রমন্ত্র, সৰ্ব্বত্যাগ উহার দক্ষিণা, সত্যবাক্য প্রশাস্তার [যজ্ঞবিধিসমূহের পরিচালকের] বাক্য ও অপবর্গ [মোক্ষ] উত্তরাঙ্গ [চরম ক্রিয়া] কৰ্ম্মস্বরূপ। অহঙ্কার, মনঃ ও বুদ্ধি ইহারা হোতা, অধ্বর্য্যু ও উদ্গাতার স্বরূপ হইয়া ঐ যজ্ঞে স্তবপাঠ করিতেছে। হে প্রিয়ে! আমি এক্ষণে যেরূপ যজ্ঞবিধি কীৰ্ত্তন করিলাম, ঋগ্বেদে এই জপই কীৰ্ত্তিত হইয়াছে; সামবেদেও অন্তর্যাগানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক নারায়ণের উদ্দেশে পশুস্বরূপ রিপুসমুদয়ের ছেদন করিবার বিধি বিহিত আছে। ভগবান নারায়ণই সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্ব্বময়।