১৪শ অধ্যায় – সমবেত কুরুবীরগণসহ অর্জ্জুন-যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এ দিকে মহাবীর অর্জ্জুন অশ্বত্থামা ও তাঁহার অনুচর ত্রিগৰ্ত্তদেশীয় মহারথগণকর্ত্তৃক শরনিকরে বিদ্ধ হইয়া তিনয়বাণে দ্রোণপুত্রকে ও দুই-দুই শরে অন্যান্য বীরগণকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহাদিগের উপর অনবরত শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ অবিরতনিক্ষিপ্ত শরজালে কণ্টকিতকলেবর হইয়াও ধনঞ্জয়কে পরিত্যাগ করিলেন না, প্রত্যুত তাঁহাকে রথসমূহে পরিবেষ্টন করিয়া তাঁহার সহিত ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন অর্জুনের রথ সেই বীরগণের সুবর্ণজালজড়িত শরজালে এককালে সমাচ্ছন্ন হইয়া উল্কাপাত-পরিশোভিত ভূতলস্থিত বিমানের ন্যায় শোভা বরণ করিল। মহারথগণ ধনুর্ধরাগ্রগণ্য ধনঞ্জয় ও বাসুদেবকে শরনিকরে ক্ষতবিক্ষতকলেবর দেখি একান্ত হৃষ্ট হইলেন। ঐ সময় অর্জুনের রথকূবর, রথচক্র, ঈষা, যোক্ত্র, যুগ ও অনুকর্ষ সমুদয়ই শরময় বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। হে মহারাজ! তৎকালে আপনার পক্ষীয় বীরগণের সহিত অর্জুনের যেরূপ সংগ্রাম হইয়াছিল, তাদৃশ সংগ্রাম আমরা আর কথন দর্শন বা শ্রবণ করি নাই।
অর্জ্জুন–অশ্বত্থামার যুদ্ধ
“অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় জলধর যেমন মহীধরের উপর জলধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ সেই কৌরবসৈন্যগণের প্রতি সন্নতপৰ্ব্ব শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। সেনাগণ পার্থনামাঙ্কিত শরসমূহে সমাহত হইয়া সমস্তই অর্জ্জুনময় নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর পার্থ হুতাশনের ন্যায় শরজালে আপনার সৈন্যগণকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ধনঞ্জয়ের রথমার্গে রাশি রাশি রথচক্র, যুগ তৃণীর, পতাকা, ধ্বজ, ঈষা, অনুক, ত্রিবেণু, অক্ষ, যোক্ত্র, প্রতোদ [চাবুক] এবং কুণ্ডলসমলঙ্কৃত উষ্ণীষধারী ছিন্ন মস্তক, হস্ত, স্কন্ধ, ছত্র, চামর ও মুকুট নিপতিত হইতে লাগিল। মাংসশোণিতজনিত কমে পার্থের গমনপথ নিতান্ত দুর্গম হইয়া রুদ্রদেবের ক্রীড়াভূমির ন্যায় অতি ভীষণ বেশ ধারণ করিল। এইরূপে মহাবীর ধনঞ্জয় বীরত্ব প্ৰকাশপূর্ব্বক দুইসহস্র রথী সংহার করিয়া ক্রোধে চরাচর-বিশ্বদহন ধূমশূন্য দহনের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হইতে লাগিলেন। ঐ সময়ে মহাবীর অশ্বত্থামা রণস্থলে অর্জুনের পরাক্রম অবলোকন করিয়া বিচিত্র পতাকাপরিশোভিত রথে আরোহণপূর্ব্বক তাঁহার নিবারণে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন সেই মহাধনুর্দ্ধর বীরদ্বয় পরস্পরে সংহারে নিতান্ত অভিলাষী হইয়া পরস্পরের প্রতি গমন করিলেন। তাঁহাদের শরাশন হইতে বর্ষাকালীন মেঘনির্ম্মুক্ত বারিধারার ন্যায় অনবরত শরধারা নিপতিত হইতে লাগিল। অনন্তর বৃষদ্বয় যেমন শৃঙ্গদ্বারা পরস্পরকে প্রহার করে, তদ্রূপ সেই বীরদ্বয় স্পৰ্দ্ধাপ্রকাশপূর্ব্বক সন্নতপৰ্ব্ব শরনিকরে পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে সেই বীরদ্বয়ের ঘোরতর সংগ্রাম হুক্ষণ সমভাবে হইতে লাগিল।
অশ্বত্থামার অস্ত্রে সুরথসংহার
“অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা সুতীক্ষ্ণ দ্বাদশশরে অর্জ্জুনকে ও দশশরে বাসুদেবকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় হাস্যমুখে গাণ্ডীবশরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক প্রথমতঃ গুরুপুত্রের উপর শরনিক্ষেপ না করিয়া তাঁহার অশ্ব ও সারথিকে বিনষ্ট করিলেন এবং তৎপরে মৃদুভাবে তাঁহাকে বারংবার প্রহার করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর দ্রোণাত্মজ সেই অশ্বশূন্যরথে অবস্থান করিয়াই হাস্যমুখে অর্জুনের প্রতি এক পরিঘাকার মুষল নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর পার্থ সেই হেমপট্টসমলঙ্কৃত মুষল তাঁহার প্রতি আগমন করিতেছে দেখিয়া অবিলম্বে উহা সাতখণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সমরবিশারদ দ্রোণতনয় তদ্দর্শনে নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অৰ্জ্জুনের প্রতি এক গিরিশিখরসদৃশ ভয়ঙ্কর পরিঘ নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন সেই ক্রোধপরতন্ত্র অন্তসদৃশ পরিঘ নিরীক্ষণপূর্ব্বক সত্বর উহা পাঁচশরে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। দ্রোণপুত্রনিক্ষিপ্ত পরিঘ অর্জ্জুনের শরে ছিন্ন হইয়া মহীপালগণের হৃদয় বিলোড়িত করিয়াই যেন ভূতলে নিপতিত হইল। অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় তিনভল্লে অশ্বত্থামাকে বিদ্ধ করিলেন। দ্রোণাত্মজ মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয়ের শরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়াও স্বীয় পুরুষকার প্রকাশপূর্ব্বক অবিচলিতভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন। পরে তিনি ক্ষত্রিয়গণসমক্ষে পাঞ্চালদেশীয় সুরথের প্রতি শরনিকর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহারথ সুরথ মেঘগম্ভীরনির্ঘোষ রথে আরোহণপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন এবং সুদৃঢ় ভারসহ শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার উপর আশীবিষসদৃশ নিতান্ত ভীষণ শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা সুরথকে ক্রোধভরে আগমন করিতে দেখি দণ্ডঘটিত উরগের ন্যায় ক্রোধে একান্ত অধীর হইয়া উঠিলেন এবং ললাটে ত্ৰিশিখ ভ্রূকুটি বিস্তারপূর্ব্বক সূক্কণী লেহন করিয়া তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া এক যমদণ্ডোপম সুতীক্ষ্ণ নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। দ্রোণাত্মজনিক্ষিপ্ত নারাচ সুরথের হৃদয় ভেদ করিয়া বজ্রের ন্যায় মহাবেগে ধরণীতলে প্রবেশ করিল। মহারথ সুরথও সেই নারাচে সমাহত হইয়া কুলিশবিদলিত অচলশিখরের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইলেন।
“অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা সত্বর সুরথের রথে আরোহণ পূর্ব্বক সংশপ্তকগণসমভিব্যাহারে অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে ভগবান ভাস্কর গগনমণ্ডলের মধ্যস্থলে অবস্থান করিতেছেন; তৎকালে আমরা মহাবীর অর্জ্জুনকে বহুসংখ্যক বীরের সহিত যুদ্ধ করিতে দেখি যারপরনাই বিস্মিত হইলাম। পূৰ্ব্বে দেবরাজ ইন্দ্রের সহিত দৈত্যসৈন্যগণের যেমন যুদ্ধ হইয়াছিল, এক্ষণে সেই একমাত্র অর্জুনের সহিত কৌরবগণের তদ্রূপ যমরাষ্ট্রবিবর্ধন অতি ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল।”